Inqilab Logo

রোববার, ২৩ জুন ২০২৪, ০৯ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আমানতের নড়াচড়া বাড়লেও কমেছে ঋণপ্রবাহ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

আমানতে ছয় শতাংশ ও ঋণে নয় শতাংশ সুদের হার নির্ধারনের পর ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। তবে কমে গেছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক কম।
মুদ্রানীতির সবশেষ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুন থেকে আগস্ট সময়ে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশ কমেছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এই সময়ে সরকারের ঋণ তেমনটা বাড়েনি। ফলে সার্বিকভাবে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। যা মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণের চেয়েও ১ দশমিক ৯ শতাংশ কম। নির্বাচনের আগে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ার কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তাই বছর শেষে ব্যাংকের মুনাফাও অনেক কম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে উদ্যোক্তারা এখন বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। বিনিয়োগ না হওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জানান বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়েই সবচেয়ে বেশি কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই তিন মাসে এই খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে মাত্র এক দশমিক ২৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল তিন দশমকি ২৪ শতাংশ। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বরে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল এক দশমিক ৩৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে আগস্ট এ দুই মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে পাঁচ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ৩৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত আগস্টে আমদানি ব্যয় বাড়ার পরিবর্তে কমেছে পাঁচ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছরের আগস্টে বেড়েছিল ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি বেড়েছিল। ওই বছরে আমদানি ব্যয় ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছিল। এর মধ্যে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ ছিল বেশি। সেগুলো দিয়ে পণ্য তৈরি করে নির্বাচন কেন্দ্রিক পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার আগেই উদ্যোক্তারা ক্রেতার রফতানি অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যস্ত। যে কারণে এই সময়ে এসে রফতানি আয় বেড়ে গেছে আগের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে রফতানি আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ আয় বেড়েছিল সাত দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ আয় বাড়ার পরিবর্তে কমেছিল নয় দশমিক ৮৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, বেসরকারী খাতের ঋণ যোগানের মতো সামর্থ্য অনেক ব্যাংকেরই নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংক ঋণের নয়-ছয় সুদ হারের প্রভাব ও নির্বাচনী আবহের কারণেই কমছে ঋণ প্রবাহ। টাকা গতি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে প্রতি ছয় মাসে একবার মুদ্রা কৌশল নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক খাতে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণ যাওয়ার কিছুটা চিন্তিতই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্ত এবার হঠাৎ করেই ঋণ প্রবাহ কমে গেছে বেসরকারী খাতের।
এদিকে সরকার ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) উদ্যোগে সুদহার নির্ধারণ করার পর আমানতের নড়াচড়া আগের চেয়ে বেড়েছে। বিএবির সিদ্ধান্ত মেনে গত জুলাই থেকে আমানতে ছয় শতাংশ ও ঋণে নয় শতাংশ সুদের ঘোষণা দেয় ব্যাংকগুলো। এ সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের সুদহারও ছয় শতাংশ ঠিক করে দেওয়া হয়। তবে সব ব্যাংক তা মানেনি। এরপরই আমানত নিয়ে টানাটানি শুরু হয়।
ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১০ লাখ ৮৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা, জুলাইয়ে তা কমে হয় ১০ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়ে হয় যথাক্রমে ১০ লাখ ৮৩ হাজার ৪২৯ কোটি ও ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৮ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের আমানত গত জুনে ছিল ২৯ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। জুলাইয়ে কমে হয় ২৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, আগস্টে আরও কমে হয় ২৮ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। একইভাবে এনসিসি ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে কমে হয় ১৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা, আগস্টে আরও কমে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। ইস্টার্ণ ও দি সিটি ব্যাংকের আমানত অবশ্য জুলাইয়ে কমলেও আগস্টে বেড়েছে। আবার জুনের চেয়ে জুলাই ও আগস্টে আমানত বাড়ে ডাচ্বাংলা, এক্সিম, আল-আরাফাহ্, পূবালী, সিটিব্যাংক এনএ, এইচএসবিসি ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের।
জানা যায়, গত জুলাইয়ে সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের আমানত কমে গেলেও আগস্টে বেড়ে যায়। তবে জনতা ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে ৬২০ কোটি ও আগস্টে ১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা কমে যায়। বিডিবিএলের আমানতও কমেছে ওই দুই মাসে।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস ছালাম আজাদ বলেন, আমানতে কিছুটা টান পড়লেও এখন ঠিক হয়ে এসেছে। আগের চেয়ে আমানত বেড়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম বলেন, প্রথমে আমানত কিছুটা কমলেও পড়ে অনেক বেড়েছে।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে জুলাই ও আগস্টে এবি ব্যাংকের আমানত বেড়েছে যথাক্রমে ২১৫ ও ৬৭০ কোটি টাকা। আর সিটি ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা কমলেও আগস্টে ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বাড়ে। একইভাবে ইস্টার্ণ ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা কমলেও আগস্টে বেড়ে যায় ৯৯৩ কোটি টাকা। তবে আইএফআইসির আমানত জুলাইয়ে ৫৩৪ কোটি টাকা বাড়লেও আগস্টে কমে ৫৮ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে ৫২৩ কোটি ও আগস্টে ১১৯ কোটি টাকা কমে যায়। ঢাকা ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে বাড়লেও আগস্টে কমে ৪৮৬ কোটি টাকা। ওয়ান ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে ১ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা বাড়লেও আগস্ট কমে যায় ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংকের আমানত আগস্টে ৭৬৮ কোটি টাকা কমলেও আগস্টে বাড়ে ১৩৭ কোটি টাকা।
নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে মেঘনা ব্যাংকের আমানত জুলাইয়ে ১১৯ কোটি ও আগস্টে ৮৬ কোটি টাকা কমে যায়। মধুমতি ব্যাংকের আমানতও জুলাইয়ে ১৭৫ কোটি টাকা ও আগস্টে ৭৬ কোটি টাকা কমে যায়। তবে বিএবির সুদহারের সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েনি বিদেশি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ