Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ঠেকাবে ইএমভি প্রযুক্তি

ভারতে পুরাতন ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড বন্ধ হচ্ছে জানুয়ারিতে, বাংলাদেশেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০১৮, ৮:৪৫ পিএম | আপডেট : ৮:৫৫ পিএম, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮

ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের জালিয়াতি রোধ এবং লেনদেনকে নিরাপদ করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইএমভি (ইউরোপে, মাস্টারকার্ড ও ভিসা) প্রযুক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়ছে। ইএমভি হলও ইউরোপে, মাস্টারকার্ড ও ভিসার সমন্বিত রূপ, যা আর্থিক লেনদেনের আন্তর্জাতিক মান হিসেবে স্বীকৃত।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক নতুন এ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করলেও অধিকাংশ ব্যাংকই এখনো পিছিয়ে রয়েছে। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জোরালো কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। তবে এনিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এরই মধ্যে নড়ে-চড়ে বসেছে। বর্তমান প্রচলিত ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের বদলে ইএমভি ব্যবহারে নির্দেশনা জারি করেছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। গত শনিবার দ্য টাইম অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, নতুন বছরে দেশের অধিকাংশ এটিএম কাউন্টার বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েক ধরণের ডেবিট, ক্রেডিট কার্ডও কাজ করবে না বলে জানা গেছে। যে সব ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে চুম্বকীয় ক্ষেত্র রয়েছে, সেই কার্ডগুলি ১ জানুয়ারি থেকে বিকল হয়ে যাবে। ব্যাংকটির তরফ থেকে বলা হয়েছে, যত শিগগিরই সম্ভব পুরনো কার্ড ব্যাংকে গিয়ে বদল করে নিন। ইএমভি চিপ বসানো ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বেশি সুরক্ষিত এবং এই কার্ড ব্যবহারে প্রতারণাও অনেক কমবে বলে আশা করছে আরবিআই।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ইএমভি কার্ড প্রচলনের পরিকল্পনা আছে। তবে পুরোপুরিভাবে তা বাস্তবায়নে অনেক সময় লাগবে। তবে ভারতের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশেও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। খুব শিগগিরই এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আলোচনা করবে করে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এটিএম বুথে কার্ডের তথ্য ও পিন চুরি করে, নকল কার্ড বানিয়ে গ্রাহকদের হিসাব থেকে কয়েক লাখ টাকা তুলে নেয় অসাধু চক্র। এ ক্ষেত্রে এটিএমে দ্রুত তথ্য পাঠ করতে পারে এমন যন্ত্রাংশ বসিয়ে ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ-যুক্ত (চৌম্বকীয় চিহ্ন বা দাগ) কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় দশ হাজার এটিএম বুথ আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড হয় দুই ধরনেরÑ ম্যাগনেটিক স্ট্রিপযুক্ত কার্ড ও কম্পিউটার চিপযুক্ত কার্ড। ‘ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ডের’ পেছনে কালো রঙের যে চৌম্বক ফিতা বা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থাকে, তাতে গোপনীয় তথ্যাবলি বা ডেটা সংরক্ষিত থাকে। আর কম্পিউটার চিপযুক্ত ‘চিপ কার্ড’-এর ডেটা সংরক্ষিত থাকে কম্পিউটার মাইক্রো চিপে; এটা খুবই নিরাপদ ভাবে সংরক্ষিত। যেহেতু পৃথিবীর সব এটিএম এবং পস টার্মিনাল আজও চিপ ডেটা রিড করার উপযোগী নয় (অর্থাৎ ইএমভি কমপ্লায়েন্ট নয়), তাই চিপ কার্ডের গ্রহণযোগ্যতার কথা বিবেচনা করে এর ডেটা মাইক্রো চিপের পাশাপাশি ম্যাগনেটিক স্ট্রিপেও রাখা হয়।

স্কিমিং ডিভাইস একটি কার্ডের শুধু ‘ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ’ অংশ থেকে ডেটা পড়তে পারে, আর প্রতারকেরা ওই ডেটা দিয়ে শুধু ‘ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ’ কার্ডই তৈরি করতে পারবে। কাজেই যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ ডেবিট কার্ড দিয়ে থাকে, তাদের কার্ড থেকে ডেটা চুরি করা এবং তা দিয়ে ডুপ্লিকেট কার্ড তৈরি করে এটিএম বুথ থেকে টাকা উঠিয়ে নেওয়া প্রতারকদের পক্ষে সম্ভব।

প্রতারকেরা সমস্যায় পড়ে, যখন কার্ডটিতে চিপ থাকে, অর্থাৎ কার্ডটি ইএমভি কার্ড হয়। স্কিমিং ডিভাইস কোনোভাবেই চিপ থেকে ডেটা পড়তে বা চুরি করতে পারে না। আর প্রতারকদের পক্ষে চিপ-সংবলিত কার্ড তৈরি করাও সম্ভব নয়। তাই প্রতারকেরা কার্ডের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থেকে ডেটা চুরি করে ডুপ্লিকেট ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ডই (ম্যাগ-স্ট্রিপ কার্ড) তৈরি করে থাকে। পরে তা ব্যবহার করে ‘নন-ইএমভি এটিএম’ থেকে টাকা চুরি করে।

উল্লেখ্য, ডুপ্লিকেট ম্যাগ-স্ট্রিপ কার্ড দিয়ে প্রতারক ইএমভি কমপ্লায়েন্ট এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারবে না, যদি এটিএম-এ ফল ব্যাক ট্রানজেকশন বন্ধ করা থাকে।

একটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রতারণায় সম্প্রতি এমনটিই ঘটেছে। ব্যাংকটির স্কিমিং করা কার্ডগুলো ইএমভি কমপ্লায়েন্ট হলেও তার ডুপ্লিকেট কার্ড ব্যবহার করে ‘নন-ইএমভি এটিএম’ থেকে টাকা তোলা হয়েছে। কাজেই দেশের সব কার্ড ইএমভি এবং সব এটিএম ও পস টার্মিনাল ইএমভি কমপ্লায়েন্ট হলে স্কিমিং পদ্ধতিতে ডুপ্লিকেট কার্ড তৈরি করে গ্রাহকের টাকা চুরি করা সম্ভব নয়।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরীন বলেন, ভিসা মাস্টারকার্ড কিন্ত অ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইসকে তার আমলে নিয়ে লায়াবিলিটি (যোগ্যতা) শিফট করে। লায়াবিলিটি শিফটের যে নিয়ম করা হয়েছে যে কে টাকা দেবে, সেটা কিন্ত করা হয়েছে ইএমভির ওপর নির্ভর করে। এর মানে আমাদের নিরাপত্তার জন্য প্রাধান্য দিতে হবে ইএমভিকে। অবশ্যই চিপ কার্ড করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন অ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস।

বিশ্বব্যাপী এটিএম জালিয়াতির কারণে ইউরো পে, মাস্টারকার্ড ও ভিসা-এ তিনটি প্রতিষ্ঠান এক হয়ে একটি গবেষণা করে। এর ফলাফল হিসেবে ১৯৯৩ সালে তারা চিপযুক্ত ইএমভি কার্ডের প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে খরচ বেশি হওয়ার কারণে সব দেশে এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশে ও কিছু ব্যাংক ইএমভি কার্ড চালু করলেও বেশির ভাগ বুথই এখনো ইএমভি গ্রহণের অযোগ্য। এখানে ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ কার্ডের প্রচলনই বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ইএমভি চিপযুক্ত কার্ড করলেই হবে না, বুথও ইএমভিতে রূপান্তর করতে হবে। কিন্ত এটা তো একদিনে সম্ভব নয়। তবে আমাদের ধীরে ধীরে ওই দিকেই যেতে হবে। কবে নাগাদ ওই দিকে যাওয়া যাবে, তার পরিকল্পনা করতে হবে। যতই ডিজিটাইজেশনের দিকে যাওয়া হবে, ততই কিন্ত নিরাপত্তার হুমকি আসছে। ফলে আরও শক্ত হতে হবে। এটি ধারাবাহিকভাবে করা হচ্ছে।

কনা সফটওয়্যারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তৌহিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, মানুষ এখনো নগদ লেনদেন বেশি করে থাকে। গত তিন বছরে ই-কমার্সে ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবহার বাড়লেও কমে যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার। এর কারণ কার্ডভিত্তিক প্রতারণা। তবে ইএমভি প্রযুক্তি এবং টু-লেয়ার অথেন্টিকেশনে আগ্রহী হচ্ছে ব্যাংক। ইএমভি প্রযুক্তিভিত্তিক কার্ডে ডেটা চিপ থাকে বলে তা ক্লোন করা কঠিন।

যদিও জালিয়াতি রোধে সব কার্ড চিপ ও পিন যুক্ত করাসহ এটিএমগুলোতে কার্ড পাঞ্চ করার স্থানে বিশেষ প্রতিরোধক অ্যান্টি-স্কিমিং ব্যবস্থার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ লাখ ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক রয়েছে। আর ডেবিট কার্ড রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ। দেশের ৫৭ ব্যাংকের মধ্যে ৩৯টি ব্যাংক কার্ড সেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) জরিপ বলছে, প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো বেশ দুর্বল। বিআইবিএমের জরিপে অংশ নেয়া ৩৬ শতাংশ ব্যাংক মনে করে, যেকোনো মুহূর্তে তাদের তথ্য চুরি হতে পারে। এছাড়া ৩২ শতাংশ ব্যাংক কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। আর কম ঝুঁকিতে আছে ১২ শতাংশ ব্যাংক।

এ অবস্থায় দেশের সব ব্যাংককে তাদের নিজ নিজ এটিএম, পস ও কার্ডগুলো ইএমভিতে রূপান্তরিত করতে ভারতের আদলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সক্রিয় হতে পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কার্ড জালিয়াতি

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ