পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঘুষের মধ্যে লুকিয়ে আছে যতসব ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক। মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি এই ঘুষ আজ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কমবেশি স্থানভেদে প্রচলিত। ঘুষের ছোবলে দিশেহারা বর্তমান সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের অধীনস্থ নৈতিক মান-হুঁশ সম্বলিত মানুষ। ঘুষ যে বহুমাত্রিক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। ঘুষদাতা ও গ্রহীতার কাছে ঘুষ একটি স্বাভাবিক লেনদেন বলে মনে হলেও আসলে ঘুষ হচ্ছে, স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে যা কিছু পাওয়া যায় তার বাইরে অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। সমাজে এক অলিখিত নিয়মে ঘুষের রমরমা কারবার কমবেশি সর্বত্র। ঘুষের টাকা বিভিন্ন নামে যেমন-উৎকোচ, মাল, উপঢৌকন, বকশিশ, পার্সেন্টেজ, টাকা, ডলার, খরচ, টু-পাইস, মাসোহারা, চাঁদা, সাহায্য, উপরি আয়, ট্যাক্স, কম্প্রোমাইজ, সম্মানি, এক্সট্রা পারিশ্রমিক, বখরা ও টিপস ইত্যাদি নামে পরিচিত। তবে যে নামেই প্রচলিত হোক না কেন, ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া মারাত্মক অন্যায়।
ঘুষের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের ব্যাপকতা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈধ-অবৈধতার বালাই নেই। সবাই যেন টাকার পেছনে ছুটছে। যেভাবেই হোক, টাকা উপার্জন করতে হবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সরকারি চাকরিতে বেতন যাই হোক, উপরি কত সেটাই অনেক সময় মুখ্য বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি চাকরিজীবী পাত্রের কাছে কনে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও একাংশ অভিভাবক জানতে চান, বেতনের সঙ্গে উপরি আছে তো? এভাবে অনেক সময় আমাদের হীন মানসিকতা সমাজে অন্যায় সৃষ্টির মূল কারক হয়ে থাকে। যৌতুক প্রথাকেও পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ঘুষ বলা যেতে পারে। বস্তুত আমাদের দেশের বিভিন্ন সরকারি উপরমহল থেকে একেবারে নীচমহল পর্যন্ত কমবেশি ঘুষের দায়ে অভিযুক্ত।
দুর্নীতিপরায়ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তি পর্দার অন্তরালে প্রদান করা ঘুষকে নিজের অধিকার মনে করে থাকেন। ওসমান গনীর মতো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির গ্রেফতারের পর থেকে দেশের মানুষ বুঝেছে, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের লোভের শিকার হয়ে দেশের প্রকৃত মানব সম্পদের উপযুক্ততার মূল্যায়নে অর্থের লেনদেনা নিঃসন্দেহে গোটা প্রজন্মকে পিছনে ঠেলবে। দুর্নীতি আর অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের রমরমা ধান্দা, নিরীহ গরিব মানুষের শোষণ ইত্যাদিতে সত্যিই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বিশুদ্ধতা আজ বিরাট প্রশ্নের মুখে! বিশেষ করে সরকারি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একজন পিয়োন পর্যন্ত সবাই এর সাথে কমবেশি জড়িত। চাকরি দেওয়া, সুপারিশ করা, কোনো উদ্দেশ্য হাসিল কিংবা কার্যসিদ্ধির জন্য ঘুষ প্রধান করতে হয়। আমাদের দেশে বড়ো বড়ো আমলার অফিসে বিভিন্ন দরকারি ফাইল আটকে থাকে, ঘুষ দিযে ফাইল মুক্ত করতে হয়। ঘুষ একটি অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। শিক্ষিত মানুষের বিবেকহীন কার্যকলাপে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
‘অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’ এই উক্তিটি আজ ঘুষের বাজারে পদে পদে লাঞ্ছিত। কথাটি অপ্রিয় হলেও বাস্তব আঙ্গিকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। ঘুষ-দুর্নীতির দুর্বিপাকে যারা বিরুদ্ধে স্লোগান তোলেন সে সব- সংস্থা বা ব্যক্তিকেও অনেক সময় সমঝোতার সহায়তা নিতে বা দিতে হয়। প্রত্যক ধর্মেই ঘুষ অপরাধ হিসাবে বিবেচ্য হলেও নৈতিক অবক্ষয়ে ধর্মীয় বাধা-বিপত্তিকে আজকাল কেউ পরোয়া করে না। দেশের উন্নয়ন এই দুর্নীতির আড়ালে চাপা পড়ছে।
মোদ্দা কথা, ঘুষের এই ব্যাপক বিস্তার হঠাৎ করে রোধ করা কম্পিনকালেও সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জনগণ ও সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। অবশ্য অস্বীকার করছি না, সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই ঘুষখাদক নয়, বরং অনেক সৎ মানুষও নিজের কর্মতৎপরতা সততার সঙ্গে সম্পাদন করে যাচ্ছেন বলে মূল্যবোধ এখনো টিকে আছে। ঘুষ, উপরি বা উৎকোচ যে নামেই ডাকি না কেন, দেশের অন্যতম প্রধান এই সমস্যা প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ঘুষগ্রহীতা কখনও এককভাবে দোষী নয়, মদতদাতাও সমান দোষী। নাগরিক ও সরকারি আমলা সবাইকে কাজ করতে হবে সততার সঙ্গে। শুধু মুখে প্রতিবাদ নয়, আন্তরিকভাবে ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করতে হবে দেশের আমজনতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ দেশদরদী প্রতিটি বাংলাদেশীকে ভাবিয়ে তুলেছিল। দুর্নীতির মূলে ছিল বৃটিশ ও পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান আমলে সৃষ্ট দারিদ্র। দারিদ্র আর দুর্নীতিকে রাজনৈতিকভাবে আড়াল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হাটবাজার-মাঠ-ময়দানে এ শব্দ দুটো শোনা যাচ্ছে সততই। গেল ক’বছর আগেও প্রশাসন এবং সমাজের প্রায় সকল পর্যায়ে দুর্নীতি ছিল স্বাভাবিক বিষয়। সাধারণ নাগরিকদের প্রতি ফুলঝুরি দেওয়া হলেও এ সব দূরীকরণের নামে চলছিল প্রহসন, চলছিল ভেলকিবাজি, চলছিল মোহ সৃষ্টির দৌড়-প্রতিযোগিতা। স্বাধীনতার পরবর্তী ৪৪ বছর পর আজ আওয়ামীলীগও তাদের মিত্র দল ক্ষমতায়। এ সময়েই দুর্নীতি পৌঁছেছিল সর্বোচ্চ মাত্রায়। বর্তমান সরকার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দূর্নীতি মুক্ত করতে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেছে। এছাড়া দুর্নীতি নির্মূলে নানাভাবে আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ ছাড়াও গণ সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে অব্যহতভাবে। এজন্য তারা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি কিছুমাত্র কমছে না, বরং বাড়ছে। ডানপন্থী, উদার পন্থী, বামপন্থী, নরমপন্থী সব দলই ক্ষমতায় থেকে বা না থেকেই স্বীকার করেছে যে, দারিদ্র আর দুর্নীতি সমাজ ও দেশকে গ্রাস করেছে অক্টোপাশের মত। জাতীয় পূর্ণগঠনের সুফল গ্রাস করেছে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। ওরা রক্ত নিংড়ে খাচ্ছে আর গরীব আরো গরীব হচ্ছে।
দুর্নীতিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় অনায়াসেই। উচ্চতর ও নিম্নস্তর। নিম্নস্তরের দুর্নীতি আমজনতাকে আঘাত করে সরাসরি। উৎকোচ বিনা কোনো কাজই হাসিল বা আদায় করা কঠিন বা অসম্ভব। যদিও বা চাকুরী নিয়ম বহির্ভূত স্বার্থ কিছু কিছু আদায় হয় উৎকোচের বিনিময়ে, তবে তার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অতি কম। কেননা এ ক্ষেত্রে উৎকোচের পরিমাণ অধিকাংশ বেলায়ই লক্ষাধিক। সাধারণের ক্ষমতার বাইরে। দুর্নীতিগ্রস্তরাই এ সুযোগ গ্রহণে সক্ষম। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির অগ্রগতি হচ্ছে তাল মিলিয়ে অভিনব সব পন্থায়। স্বজনপ্রিয়তা দুর্নীতির আশ্রয়ে পুষ্ট। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট, চাকুরী, প্রয়োজন বদলী, ভূয়ো মার্কশীট, সার্টিফিকেট, হাসপাতালে ভর্তি এমনকি অপারেশন প্রভৃতি সবই দুর্নীতিতে ঘেরা। প্রচলিত আইন লঙ্ঘন, প্রশাসনযন্ত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ফলে প্রশাসন যন্ত্র হয়ে পড়েছে দুর্নীতিপরায়ন ও অকেজো। কিছু সৎ লোক থাকলেও তারা এসব দেখে ও শুনে কথা বলতে পারে না। এ সুযোগে প্রশ্রয় পাচ্ছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ মাদকদ্রব্যের বহুল ব্যবহার ও নানা সামাজিক অপরাধ। রাজনৈতিক আশ্রয়পুষ্ট দেশপ্রেমিক ও তকমাধারী দালাল শ্রেণিই সর্বেসর্বা। দুর্নীতির আশ্রয় বিনা কোনো কিছু আদায় করা কল্পনাতীত। ফলে সামাজিক শান্তিশৃংখলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরাসরি প্রতিবাদ প্রতিরোধ না হলেও ক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে দিনে দিনে।
দারিদ্র দূরীকরণ, দুর্নীতি দূরীকরণে সতত দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো আজ দেশবাসী বিশেষভাবে যুব সমাজের কাছে ধোকাবাজির শামিল। মনে রাখতে হবে, স্বল্প সময়ের জন্য প্রতারিত করা যায়, বিভ্রান্ত করা যায় কিন্তু স্থায়ীভাবে সম্ভব নয়। কথাটি চিরন্তন সত্য। এ থেকে শিক্ষা নেয়ার সময় অতিক্রমের পথে জাতীয় বিপর্যয়ের উপক্রম হয়েছে। তাই দুর্নীতি নির্মুল করার সংগ্রাম ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা দেশদরদী, গণদরদী ব্যক্তি ও দলের কাছে আজ অতি জরুরী। ফ্যাসীবাদী মনোভাব বৃদ্ধিকে রোধ করার হাতিয়ার তো বটেই। গেল গেল বলে নিস্ক্রিয় থাকা অপরাধের শামিল হবে ইতিহাসের কাছে। তা না হলে জাতীয় প্রগতি শুধু বিলম্বিত নয়- পুরো ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিশ্ব খেতাব অর্জন অসাধ্য হলেও দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে ছিল বেশ ক’বছর। জাতীয় কলঙ্ক আর কাকে বলে? বস্তুত দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জাতীয় স্বার্থে আজ পবিত্র কর্তব্য। নিষ্ঠার সাথে এ কাজ গ্রহণকারী দলসমূহের পক্ষে জনমত অনুকূলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ মুহূর্তে আশু জাতীয় কর্তব্য হলো: ১) রাজনীতিকে দুর্নীতি মুক্ত করা। দুর্নীতিকে কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় না দেয়া। ২) দুর্নীতিকে ঘৃণ্যতম জাতীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন প্রনয়নের মাধ্যমে কঠিনতম দন্ডদান। ৩) দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যক্তিত্বকে জাতীয় সম্মান প্রদান করা। ৪) সংসদে গ্রহীত আইন মোতাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কর্মকর্তাদের আয় সম্পদ এবং কর পরিশোধের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা। ৫) দুর্নীতিমূলক কাজে লিপ্ত অভিযুক্তদের রক্ষায় প্রশাসন বা বিচার বিভাগের কাজে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিকে অপরাধ বলে আইন মাফিক ঘোষণা করা। ৬) প্রচলিত আইন মোতাবেক অভিযুক্তদের বিচারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ, প্রভাব বিস্তার অপরাধ বলে গণ্য করা। ৭) আইন ভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা। ৮) রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে সামাজিক ঘৃন্যতম অপরাধ বলে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমক্ষে ঘোষণা করা। ৯) দুর্নীতিকে ঘৃণ্যতম অপরাধবোধে সামাজিক চেতনা বৃদ্ধি করা। ১০) আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ১১) দুর্নীতি দমন কমিশনে সৎ, দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দান। যুক্তিসম্মতভাবে একথা বলা চলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি এবং শাসন স্থায়ী করা অসম্ভব। আধুনিক কালের ইতিহাস এ সাক্ষ্যই দেয় যে, দক্ষিণপন্থী, উদারপন্থী, বামপন্থী যে রাজত্বই হোক না কেন, দুর্নীতি দমনের নামে প্রহসন ব্যুমেরাং হওয়ার আগেই জাতীয় স্বার্থে নড়েচড়ে বসা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।