Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পরিকল্পিতভাবে ঢাকার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপির শতকার ৪০ ভাগ যোগান দিচ্ছে ঢাকা। দেশের অর্থনীতির মূল প্রাণকেন্দ্রও এ নগরী। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে অবাসযোগ্য নগরীর তালিকায় এ নগরী দ্বীতিয় স্থানে রয়েছে। এই দুর্নাম গোছানোর জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। সীমাহীন দুর্ভোগ ও দুর্দশার মধ্যেই বছরের পর বছর ধরে নগরবাসী ঢাকায় বসবাস করছে। তাদের ভাগ্যে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা জুটছে না। ঢাকাকে যদি মোটামুটি বাসযোগ্য করে তোলা যেত তাহলে দেশের অর্থনীতির ভিতটা কত শক্তিশালী হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। এক যানজটে বছরে যে ক্ষতি হয় (প্রায় এক লাখ কোটি টাকা) তা অর্থনীতিতে যুক্ত হলে দেশের চেহারাটাই বদলে যেত। আমরা দু’দশকওয়ারি ঢাকাকে উন্নত করার পরিকল্পনার কথা শুনে আসছি। ২০ বছর মেয়াদি এসব পরিকল্পনায় অনেক সুন্দর সুন্দর কথা থাকে। ২০ বছর মেয়াদ শেষে দেখা যায়, পরিকল্পনা তো বাস্তবায়ন হয়ইনি, উল্টো এর অধঃপতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বছর কয়েক আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় রাজউক ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি ‘নগর উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল দেড় কোটি, ২০৩৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৬০ লাখ। এই জনসংখ্যা বিবেচনা করে সেবা সংস্থাগুলোর প্রসার ও বিন্যাসের কথা চিন্তা করা হয়েছে। পরিকল্পনায় পুরো ঢাকা মহানগরকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন স্তরের নগর কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এর মধ্যে মূল ঢাকাকে ঘিরে গড়ে উঠবে আরও পাঁচটি অঞ্চল। এগুলো হলো, গাজীপুর সদর উপজেলা নিয়ে উত্তরাঞ্চল, রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ নিয়ে পূর্বাঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর ও সোনারগাঁ নিয়ে দক্ষিণাঞ্চল, কেরাণীগঞ্জ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং সাভার এলাকা নিয়ে হবে পশ্চিমাঞ্চল। পরিকল্পনায় চারটি সিটি করপোরেশন যেমন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরস্থ পাঁচটি পৌরসভা এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার ৭০টি ইউনিয়ন পরিষদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে রাজধানীর আয়তন কত হবে, তা নির্দিষ্ট করে করা হয়নি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ‘সিটি করপোরেশন এলাকা, ঢাকা মহানগর উন্নয়ন প্রকল্পের এলাকা, রাজউকের নির্ধারিত এলাকা থাকলেও, কোন এলাকাকে রাজধানী ধরা হবে? আগে ধরা হতো রাজউকের এলাকাই রাজধানী। এখন রাজউকের মানচিত্রে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাহলে কি নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরও ঢাকা হবে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পরিকল্পনায় নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী, যেভাবে ঢাকার বিস্তৃতি ধরা হয়েছে, এ বিস্তৃতি যে এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর আয়তন হবে ১৬২৪ বর্গকিলোমিটার। দেখা যাবে, ভবিষ্যতে ঢাকার আশপাশের আরও জেলা যুক্ত হবে। তখন এর আয়তন কত হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
দুই.
যে কোনো দেশের রাজধানীর চিত্র সেদেশের সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। চেহারায় যেমন মানুষের মনের ভাব ফুটে উঠে, তেমনি রাজধানীর চিত্র দেখে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যায়। ঢাকার চেহারা দেখলে অনেকের কাছেই তা পরিত্যক্ত নগরীর মতো মনে হবে। অথচ, বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকা এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেগুলোর রাজধানীর চিত্র ঢাকার চেয়ে সুশৃঙ্খল, পরিপাটি ও বাসযোগ্য। মেট্রোপলিটান সিটি বা মাদার সিটি বলতে যা বোঝায়, ঢাকায় তার সবকিছু থাকলেও সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত নয়। একটি মেট্রোপলিটান সিটি’র মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া। সুদীর্ঘকাল ধরে ঢাকা মেগা বা মাদার সিটি হিসেবে পরিচিতি পেলেও এর গঠন ও বিন্যাস অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। পরিকল্পনা নিলেও তার কার্যকর উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। ফলে যে যেভাবে পারছে অপরিকল্পিতভাবে এর বিস্তৃতি ঘটিয়ে চলেছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত মানের নয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ৫৫টি প্রতিষ্ঠান দুর্বল, তাদের কাজের সমন্বয়ের কৌশল অকার্যকর। ঢাকার উন্নয়নের জন্য যেসব পরিকল্পনা অতীতে নেয়া হয়েছে, সেগুলো আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, রাজধানীর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ নগরবাসীকে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। তারা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। ঢাকাকে নিয়ে প্রথম মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এরপর ১৯৯৫ সালে ২০ বছর মেয়াদের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কয়েক বছর আগে আগামী ২০ বছর সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বরাবরের মতো এ পরিকল্পনাতেও আকর্ষণীয় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ঢাকার প্রত্যেক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নগর হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ঐসব অঞ্চলে নাগরিক ও কর্মসংস্থানের সুবিধা বিবেন্দ্রীকরণ করা হবে। ঢাকা শহরে দ্রুতগামী পরিবহণসুবিধা থাকবে। চারদিকে থাকবে বৃত্তাকার সড়ক। মূল শহরের সঙ্গে অঞ্চলগুলোর সংযোগও থাকবে। ভূমি স্বল্পতাকে বিবেচনায় নিয়ে এসব পরিকল্পনা করা হবে। শহরের চারপাশে থাকবে বিশেষায়িত জোন। ট্রানজিট স্টেশনকে কেন্দ্র করে কর্মক্ষেত্রের চারপাশে মানুষের বসতির সুযোগ থাকবে। প্লটের পরিবর্তে বøক হাউজিং গুরুত্ব দেয়া হবে। নদী, খাল, জলাশয়, সংরক্ষণ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখা হবে। এসব পরিকল্পনার কথা শুনলে যে কারও মনে কোনো বেসরকারী আবাসন কোম্পানির আকর্ষণীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপনচিত্র ভেসে উঠতে পারে। পরিকল্পনায় কেবল রাজধানীকে প্রসারের ওপর গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজধানীর বিদ্যমান সমস্যাগুলোর ওপর তেমন কোনো আলোকপাত করা হয়নি। এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হবে, তার কোনো দিক নির্দেশনা নেই। রাজধানী যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে রয়েছে, তা কীভাবে সমাধান হবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেই। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঝারি ধরনের বন্যা হলে ঢাকার ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যাবে। অন্যদিকে বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ঢাকার ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭৮ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ। তারা বলছেন, প্রতিদিনই ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। আগামী কয়েক দশকে এই চাপ আরও বাড়বে। অপরিকল্পিত ভবন, অবকাঠামো নির্মাণ, জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে বিশ্বের অন্য বড় শহরের তুলনায় ঢাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট এসব ঝুঁকির কারণে বিপুল প্রাণহানি ঘটতে পারে। নতুন পরিকল্পনায় এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ঢাকার নতুন কাঠামো পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সেসময় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মেয়র ও বিশেষজ্ঞরা এ পরিকল্পনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এ পরিকল্পনা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে এ পরিকল্পনা বাস্তবমুখী নয়। ঢাকার সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে রাজউকের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের যে সমন্বয় প্রয়োজন, তার প্রতিফলন এখানে নেই। বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন, আগে যারা ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন, তারা ঢাকাকে ভালভাবে দেখেননি। ঘরে বসে লাইন টেনে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এভাবে ঘরে বসে লাইন টেনে পরিকল্পনা করলে হবে না। সবার মতামতের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
তিন.
নগর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় যে নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা, নাকি কেবল পরিকল্পনার মধ্যে সমীমাবদ্ধ থাকবে, তা নিয়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। কারণ আগে বিভিন্ন মেয়াদী যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেগুলো কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, এ ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। নতুন পরিকল্পনা পেশ করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তা জনগণকে জানায় না। ঢাকার সীমাহীন সমস্যা নিয়ে বহু লেখালেখি ও বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন, ভবিষ্যতেও দেবেন। তবে এসব মতামত পরিকল্পনাকারীরা এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুব একটা আমলে নেয় বলে মনে হয় না। তারা তাদের মতো করেই কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কর্মকান্ড নগরবাসীর উপকারের পরিবর্তে বছরের পর বছর ভোগান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। যে যানজটে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, তার সাথে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীন ও অসময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি যুক্ত হয়ে এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে। এমনিতেই রাজধানীর ৮০ শতাংশ সড়ক সরু ও অপরিকল্পিত। তার উপর যদি বছরের পর বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলে, তবে নগরবাসীর যন্ত্রণা কমার কোনো কারণ থাকতে পারে না। যানজটের প্রধান কারণ সম্পর্কে নগরবিদরা বলছেন, পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়কের সংযোগ না থাকা, রিং রোডের অনুপস্থিতি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ প্রযুক্তির অভাব, পার্কিংয়ে কোনো শৃঙ্খলা না থাকা। এর পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে অসঙ্গতি যুক্ত হচ্ছে। যানজট সমস্যার সাথে বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিয়ে বহু ধরনের কথা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাজধানীতে ৬০ শতাংশ এলাকায় ওয়াসার কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। কোনো দেশের মেগাসিটিতে ড্রেনেজ সিস্টেম এমন হতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। যুগের পর যুগ ধরে কাজ করা ওয়াসা কী করল, তাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করতে না পারুক, রাজধানীতে প্রাকৃতিক যেসব খাল, পুকুর ছিল নিদেনপক্ষে সেগুলো তো সংরক্ষণ ও সংস্কার করতে পারত। এ কাজটি করতে পারলে রাজধানীতে পানিবদ্ধতা বলে কিছু থাকত না। ওয়াসার হিসাব মতেই রাজধানীতে ৪৩টি খাল ছিল। এর মধ্যে ১৭টির কোনো খোঁজ নেই। বাকি ২৬টি খালের ৫টি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে নিয়েছে অসাধু চক্র। কী তাজ্জব কথা! ওয়াসার সম্পদ দখল-বেদখল হয়ে যাচ্ছে, আর তারা তা রক্ষা করতে পারছে না। দখল হয়ে যাওয়া খালও উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাহলে এমন সংস্থা আছে কি জন্য? অন্তত দখল হয়ে যাওয়া একটি খাল উদ্ধার ও বিদ্যমান খালগুলোর যথাযথ সংস্কারের উদ্যোগ নিলে পানিবদ্ধতা অনেকটাই কমে যেত। এ কাজটি কেন তারা করছে না? শুধু খালই নয়, রাজধানীতে এক সময় অনেক পুকুর ছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে পুকুরের সংখ্যা ১৯৮৫ সালে ছিল ২ হাজার। এখন সরকারি হিসেবে আছে মাত্র ২০০। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা একশ’র বেশি হবে না। এসব পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার অভাবে নগরীর পুকুর ও জলাশয় হারিয়ে গেছে। নগর উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা এবং সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতার কারণে দখল বন্ধ করা যাচ্ছে না। নগর পরিকল্পনা করলেও পুকুর জলাশয় রক্ষায় কোনো পরিকল্পনা নেই। এ ধরনের পরিকল্পনা না থাকায়, কোথাও আগুন লাগলে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। গত ৭ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০ মিটারের বেশি নেমে গেছে। প্রতিবছর এ স্তর ২.৮১ মিটার করে কমছে। এর ফলে মাটির স্তর দেবে যাচ্ছে এবং ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের কোনো পদক্ষেপের কথা নতুন পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে না।
চার.
ঢাকার সমস্যা এবং একে বাসযোগ্য করে তুলতে বহু পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। বাস্তবে তার কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায় না। যে সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান সম্ভব, সেগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যার আধিক্য। বিশ্বব্যাংকের এক হিসেবে ঢাকার পশ্চিমাংশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪১ হাজার মানুষ। নিউইয়র্কে প্রতি একরে যেখানে ২৫ থেকে ২৬ জন লোক বসাবাস করে, সেখানে ঢাকায় বসবাস করছে ৫০০ থেকে ৬০০। নগরবিদরা মনে করছেন, ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক। এতে জেলা-উপজেলার মানুষ যদি তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সেখানে পান, তবে তাদের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। ঢাকার ভেতরে শিল্পকারখানা স্থাপনে নিরুৎসাহী করতে হবে। রাজধানীর বাইরে আলাদা শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার উন্নয়ন বা উন্নয়ন পরিকল্পনা যেভাবে করা হচ্ছে, জেলা শহরগুলোকেও একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী। ঢাকার সাথে জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে মানুষ ঢাকা এসে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দিনে দিনে নিজ অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-আদালতের সুবিধা, জেলা-উপজেলায় এমনভাবে পৌঁছে দেয়া দরকার যাতে সেখানের মানুষকে ঢাকামুখী হতে না হয়। যদি এমন হয়, একজন রোগীকে উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষার্থীকে উন্নত শিক্ষা, বেকারকে চাকরি, দিনমজুরকে কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় ছুটে আসতে হয়, তবে ঢাকাকে কোনোভাবেই নির্ভার ও সুষমভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নিউইয়র্ক শহর থেকে মানুষ ২০০ কিলোমিটার দূরে বসবাস করেও প্রতিদিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরে যেতে পারছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মরতরা কলকাতায় অফিস-আদালত ও নিত্যদিনের কাজ করে ফিরে যেতে পারছে। ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও এমন করতে হবে যাতে, দূর দূরান্তের মানুষ ঢাকায় অফিস করে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে স্ট্যান্ডার্ড বা বাসযোগ্য নগরীর যে মানদন্ড তুলে ধরা হয়, ঢাকা তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। স্থিতিশিলতা, স্বাস্থ্যসেবার মান, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো-এই পাঁচটি বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ঢাকার স্কোর গড়ে ৪০-এর নিচে। উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী হিসেবে এই স্কোর কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। এই স্কোরকে ধাপে ধাপে উন্নীত করতে না পারলে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা যাবে না। নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিভাগ, সর্বোপরি সরকারকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নয়ন

২৮ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন