Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ঋণ পুনঃতফসিলের হিড়িক

নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

ঋণ খেলাপি থাকলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে আগ্রহী প্রার্থীরা ঋণ পুনঃতফসিলে ঝুঁকছেন। ঋণ খেলাপি প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ী আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইবেন বলে জানা গেছে। আর তাই ঋণ খেলাপি নন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সনদের জন্য ঋণ খেলাপিরা এখন ব্যাংকমুখী। যদিও আশঙ্কা করা হচ্ছে নির্বাচনের পরেই আবার ঋণ পুনঃতফসিলের এ অর্থ উঠিয়ে নিবেন এসব ঋণ খেলাপিরা। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক খাত সংশ্লিস্টরা।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিবিআই) উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বাসনায় অনেকে ঋণ নবায়ন করছেন। অনেকে নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ওই কর্মকর্তা জানান, তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। মনোয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন থেকে ঋণ খেলাপি আছেন এমন প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণখেলাপি নন বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সনদ মিললে হতে পারবেন প্রার্থী। যারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি তারা প্রার্থী হতে পারবেন না। প্রার্থী হতে ব্যাংকের দায় ঋণ পরিশোধ কিংবা পুনঃতফসিল করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এ নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। সে মোতাবেক কোনো ব্যক্তির যদি এক টাকাও ঋণ থাকে তার রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। ফলে ছোট-বড় আকারের যে ঋণই থাকুক না কেন তা নিয়মিতকরণ করতে হবে। এবারই প্রথম নিয়ম করা হয়েছে ব্যাংকে যে কোনো পরিমাণের দায়ে আটকে যেতে পারে প্রার্থীতা। আগে নির্ধারিত শাখা অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ম্যানেজ করে ছাড়পত্র নিলেই প্রার্থী হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এবার প্রার্থী হতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক বিবেচনায় এবং ব্যাংকারদের যোগসাজশে যেসব ঋণ দেয়া হয়, সেগুলোর অধিকাংশই খেলাপি হয়ে যায়। ঠিক একই কৌশলে গ্রাহকরা তা আবার পুনঃতফসিল করে নেয়। সাধারণত দুটো কারণে ঋণ পুনঃতফসিল করে গ্রাহকরা। যেমন- ঋণ খেলাপি থাকলে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না। এছাড়া পুনরায় ঋণ নেয়ার জন্য আগের নেয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে বলে মনে করেন সাবেক এই গর্ভনর। তিনি বলেন, এভাবে ঋণ পুনঃতফসিল করা ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ লক্ষণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেন, ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছে গ্রাহকেরা। তাই সুবিধামত খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছে। তবে এটা দুঃখজনক, ছোট গ্রাহকদের ঋণ আদায় হচ্ছে। কিন্ত বড় গ্রাহকেরা একই ঋণকে ১০/১২ বারও পুনঃতফসিল করেছে। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই অনেকেই প্রার্থী হওয়ার জন্য ঋণের সামান্য অংশ পরিশোধ করে তা পুনঃতফসিল করছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এটা আরো বাড়বে। এটা ব্যাংকিং খাতে বাজে চর্চা। এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে সাধারণত পুনঃতফসিল বেশি হয়। কিন্ত সরকার যদি ঋণ খেলাপিদের পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকে না। তাই সরকারকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিচার না হওয়া, সীমাহীন দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কারণে প্রতি বছর বাড়ছে ঋণখেলাপির সংখ্যা ও পরিমাণ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। আর ১৯৯৭ সালে দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল মোট দুই হাজার ১১৭ জন। অর্থাৎ ২০ বছরের ব্যবধানে দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ১০৯ গুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাংকগুলোর পুরনো ঋণের অর্থ আদায় বাড়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এক্ষেত্রে পুরো ঋণ পরিশোধ করেন না প্রার্থীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যাংকগুলো থেকে ঋণখেলাপিদের তালিকা নিয়ে সিআইবি হালনাগাদ করতে শুরু করেছে। তথ্য চাওয়া হয়েছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরির আওতায় থাকা ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি গ্রাহকেরও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজিএমইএ’র বর্তমান সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি নির্বাচন করতে চান ঢাকা-১৬ আসন থেকে। তার খেলাপি ঋণ ১০৯ কোটি টাকা। তিনি এরই মধ্যে ব্যাংকে যোগাযোগ করেছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য আসলামুল হক ঋণ খেলাপি হয়েছেন। তার নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটির কাছে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকেরই পাওনা এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যার বড় অংশই খেলাপি হয়ে গেছে। একই ভাবে রাজশাহীর সংসদ সদস্য এনামুল হকের নর্দান পাওয়ার সল্যুশন শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায়। প্রার্থী হতে হলে তাকে ঋণ পরিশোধ করে নিতে হবে সিআইবি সনদ। এই দুই প্রার্থীই ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ব্যাংকে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে।
বিকল্প ধারার মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন। নির্বাচনে প্রার্থী হতে তাকেও সিআইবির মুখোমুখি হতে হবে।
আকিজ গ্রুপের কর্ণধার ও যশোর-১ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন এবারও ওই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারেন। তাদের গ্রুপের একটি কোম্পানির নামে খেলাপি ঋণ ছিল। সেটি ইতিমধ্যেই নবায়ন করে নেয়া হয়েছে।
বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও মুন্নু গ্রুপের কর্ণধার মরহুম হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে আফরোজা খানম রিতা বিএনপির পক্ষে মানিকগঞ্জ থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তাদের প্রতিষ্ঠান মুন্নু ফেব্রিক্স সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩০ কোটি টাকা। গ্রুপের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে এই ঋণ নবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঋণ নবায়নের জন্য এককালীন ডাউন পেমেন্ট বাবদ ১১ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে।
বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী মোর্শেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকমের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গ্রুপের পক্ষ থেকে ঋণ নবায়নের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। তারা বিদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে ঋণ শোধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
নীলফামারী-৪ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান যমুনা এগ্রো লিমিটেড বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের বংশাল শাখায় একটি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান। তিনি খেলাপি ঋণ নবায়নের জন্য ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুনে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার ৪৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৮শ’ ৭৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সেই হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় চার হাজার ৪২০ কোটি টাকা বা ৩০৩ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময় সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মোট ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, আমরা প্রতি মাসেই সিআইবি হালনাগাদ করছি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে কারা প্রার্থী হতে পারেন এসব বিষয়ে আমরা কিছু ধারণা রাখছি। ফলে তাদের ঋণের অবস্থা সম্পর্কে আগে থেকেই খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন এলে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। এ সময়ে ব্যাংকগুলো বড় বড় গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গে হালনাগাদ করে রাখে। এখন সিআইবির কার্যক্রম অনলাইন হয়ে যাওয়ায় প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) মহাব্যবস্থাপক মনছুরা খাতুন বলেন, আগামী নির্বাচনে কোনো ঋণখেলাপিই যাতে প্রার্থী হতে না পারেন, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে কে প্রার্থী হতে পারবেন বা পারবেন না সেটি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। আমরা কমিশন থেকে যে তালিকা পাব সেটি যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঋণখেলাপি কি না সেই রিপোর্ট দেব।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ