Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যাংক লুটের এক কারিগর

সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন আলম। জালিয়াতির মাধ্যমে চট্রগ্রামের এই ব্যবসায়ী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আর ব্যাংকগুলোও বাছবিচার ছাড়াই প্রায় জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছে এ ব্যবসায়ীকে। সু-কৌশলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকও বনে গেছেন। বিপুল পরিমান অর্থ কৌশলে ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনের নামে হস্তান্তর করেছেন। এছাড়া ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে জমি ক্রয় করেছেন। পাশাপাশি জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আত্মসাৎকৃত এই অর্থের বড় অংশই বিদেশে পাচার করেছেন শাহাবুদ্দিন আলম। পাচার করা এসব অর্থ দিয়ে তিনি বিদেশে অবৈধ সম্পদও গড়েছেন। আর এসব করেই ক্ষ্যন্ত হননি শাহাবুদ্দিন আলম। সবশেষ বিদেশে পালানোর চেষ্টায় আবেদন করেছেন কোম্পানি বিলুপ্তির। তবে এ প্রচেষ্টায় সফল হননি চট্টগ্রামের এ ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী। গত বুধবার রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
সূত্র মতে, শাহাবুদ্দিন আলমের এসএ গ্রুপের অধীন অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ‘সামান্নাজ ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড’। ঋণের দায়ে নিমজ্জিত হয়ে কোম্পানিটি অবসায়ন বা বিলুপ্তির জন্য আদালতে আবেদন করেছেন তিনি। কোম্পানিটির যে পরিমাণ ঋণ আছে, সে অনুপাতে সম্পদ নেই বললেই চলে। অবসায়ন হলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে। তবে এর বিরুদ্ধে আপিল করেছে ঋণদাতা অধিকাংশ ব্যাংক। আপিলের রায়ও ব্যাংকগুলোর পক্ষে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শাহাবুদ্দিন আলম ভাগ্যগুণে দেশের দুই ডজনের বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছেন। ব্যাংকগুলোও বাছবিচার ছাড়াই প্রায় জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছে এ ব্যবসায়ীকে। ঋণের অর্থে তিনি গড়ে তুলেছেন ১৮টি কোম্পানি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের ভারে নিমজ্জিত এসএ গ্রুপের এ কর্ণধার এখন চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডোবানোর। যদিও তিনি নিজেই একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক।
ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই শাহাবুদ্দিনকে ঋণ দিলেও এমনও অনেক গ্রাহক আছেন যারা ৩০ কোটি টাকার সম্পত্তির মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ পাচ্ছেন না। ঋণের আশায় বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরলেও মিলছে না ঋণ।
এসএ গ্রুপের কর্ণধার শাহাবুদ্দিন আলমকে শৈশব থেকেই চেনেন এমন একজন ব্যাংকার বলেন, ব্যবসায়িক শৃঙ্খলার অভাবে শাহাবুদ্দিন আলম সব শেষ করে দিয়েছেন। ব্যাংকের টাকা সঠিক খাতে ব্যয় না করে জমি কেনা, বাড়ি তৈরি ও ভোগ-বিলাসে উড়িয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তার বিপুল পরিমাণ জমি, বহুতল ভবন, বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। এ সম্পদের বড় অংশই ব্যাংকের জামানতের বাইরে। শাহাবুদ্দিন আলম নিজে ডুবেছেন, ব্যাংকারদেরও ডুবিয়েছেন। সূত্র মতে, চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকার খুলশীতে চার একর জমিতে শাহাবুদ্দিনের বর্তমান বাড়ি। তার আত্মীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, খুলশীতে চার একর জমিতে অবস্থিত এ প্রাসাদ কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি। ইপিজেড এলাকায় রয়েছে তাদের পুরনো বাড়ি।
এসএ গ্রæপের ঋণদাতা অধিকাংশ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাই বলেছেন, গ্রুপটিকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। নামমাত্র জামানত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামানত ছাড়াই শাহাবুদ্দিন আলম ঋণ পেয়েছেন। অনেক ব্যাংকের কাছে ঋণের বিপরীতে কোনো বন্ধকি সম্পত্তিও নেই। ঋণের এ অর্থ আদায়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যাংকের নির্বাহীরা। যদিও এসএ গ্রুপের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে কয়েক বছর ধরেই আইনি প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ঋণদাতা অধিকাংশ ব্যাংক। একাধিক ব্যাংকের এমডি বলেন, শাহাবুদ্দিন আলম দেশের ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের একজন। তার গ্রেফতার অন্যদের জন্য যেন নিদর্শন হয়। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ তৎপরতা যেন থেমে না যায়। ইচ্ছাকৃত অন্য খেলাপিদেরও আইনের আওতায় আনা হলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।
পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া গ্রæপটিকে কেন ঋণ দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, আপনি ব্যাংকার না হয়েও আমাকে এ প্রশ্ন করছেন। অথচ ব্যাংকার হয়েও আমরা নিজেকে প্রশ্নটি করতে পারিনি। এসএ গ্রæপকে ঋণ দেয়া প্রতিটি ব্যাংকই বিপদে আছে।
এসএ গ্রুপকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা ছিল বলে জানান ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এটা দুর্ভাগ্য যে, ব্যাংকিং খাতেরই একজন উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে কোম্পানি অবসায়নের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন।
২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পাওয়া ১১ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসএ গ্রæপও রয়েছে। ওই সময় এসএ গ্রæপের এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজের পক্ষে ৯২৮ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে ছয়টি ব্যাংক।
সুত্র মতে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ইপিজেড থানায় ব্যাংক এশিয়ার দায়ের করা অর্থ কেলেঙ্কারির মামলায় শাহাবুদ্দিন আলমকে গ্রেফতার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। তারা বলছে, আলোচিত এ ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় ভুয়া কাগজ সৃষ্টি করে বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি খুলেছেন। কিন্তু এলসির বিপরীতে যেসব কাঁচামাল আমদানির কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসেনি। যেসব এলসির বিপরীতে বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করেছেন, সেগুলোও নিয়ম ভেঙে খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন। কিন্তু এলসির বিপরীতে নেয়া ঋণ আর ব্যাংককে পরিশোধ করেননি।
ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে এর আগেও শাহাবুদ্দিন আলম ৭০৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা একই কায়দায় এলসি খুলে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণের নামে ৯৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা থেকেও ঋণের নামে ৭০১ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা থেকে ঋণের নামে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, একই প্রক্রিয়ায় শাহাবুদ্দিন আলম প্রায় ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন কৃষি ব্যাংকের ষোলশহর শাখা থেকে।
এর বাইরেও শাহাবুদ্দিন আলম অগ্রণী ব্যাংকের চট্টগ্রাম করপোরেট শাখা থেকে ঋণের নামে আত্মসাৎ করেছেন ৫৪৮ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম শেখ মুজিব রোডের করপোরেট শাখা থেকে ১১৮ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৫৫ কোটি ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৩৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
অর্থ আত্মসাতের এসব ঘটনায় শাহাবুদ্দিন আলমের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি ব্যাংক ১১১টি মামলা করেছে। এসব মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থাতেই তিনি কোম্পানি বিলুপ্তির আবেদন করেন। পাশাপাশি ঋণের নামে আত্মসাৎ করা অর্থ ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনের নামে হস্তান্তর করে নিজের বাড়ি ও গাড়ি বিক্রি করে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন বলে তথ্য রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।
সিআইডির সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ঋণের নামে আত্মসাৎ করা অর্থের বড় অংশই বিদেশে পাচার করেছেন শাহাবুদ্দিন আলম। পাচার করা এসব অর্থ দিয়ে তিনি বিদেশে অবৈধ সম্পদও গড়েছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচার আইনে মামলা করা হবে। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংকের মামলাগুলো এলে সেগুলোতেও তাকে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে।



 

Show all comments
  • Zahidul Islam ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ৪:৩৭ পিএম says : 0
    এর পেছনে আরো কারিগর আছে । একে রিমান্ডে নিলে তাদেরও নাম বের হবে এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Jusna ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ৪:৩৭ পিএম says : 0
    উনার একার পক্ষে এসব সম্ভব না
    Total Reply(0) Reply
  • Kamrul Hasan ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ৪:৩৭ পিএম says : 0
    কিছুই হবে না,,,,১০০% শিওর থাকতে পারেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Omar Faruk ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ৪:৩৮ পিএম says : 0
    ভাগ ঠিক মত হয়েছে তো কোন সমস্যা নাই । আপনি নিচিন্তে ঘুমান।
    Total Reply(0) Reply
  • Anwer Dewan ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ৪:৩৮ পিএম says : 0
    লুটপাট যুগ চলছে
    Total Reply(0) Reply
  • Adv Kalam Khan ১৯ অক্টোবর, ২০১৮, ৪:৩৮ পিএম says : 0
    ব্যাংকের কর্তা ব্যাক্তিরা জড়িত।মোটা অংকের কমিশন খেয়ে ঋন দিয়েছে। আর অযোগ্যতা তো আছেই।ওদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ