Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সামাজিক অবক্ষয়, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের প্রত্যাশিত মানদন্ড

প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী

সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়নের কথা প্রচার করা হচ্ছে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী গণতন্ত্রের চেয়ে তথাকথিত উন্নয়নকেই প্রাধান্য দিতে আগ্রহী। কিছু দিন পর পর জাতির সামনে নতুন পরিসংখ্যান ও জরিপ রিপোর্ট হাজির করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর এসব রিপোর্টের ভ্রান্তি ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা অথবা বিশ্লেষকরা সরকারি অবস্থানের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেই সবাইকে পাল্টা আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। জিপিডি প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ অতিক্রম করবে বলে সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দ্বিমত করা হলে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীকেও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা গেছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানগত হিসাব-নিকাশ নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সাথে বাগযুদ্ধে লিপ্ত হতেই পারেন। তবে জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটি কিন্তু ভিন্নতর। যে কোনো সভ্য দেশের নাগরিক তার সামাজিক-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে অক্ষুণœ রেখে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। মানুষের রাষ্ট্র গঠনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে এসব বিষয়ের কালেক্টিভ প্রটেকশন নিশ্চিত করা। এসবই হচ্ছে রাষ্ট্রের কাছে জনগণের মৌলিক প্রত্যাশা। পাকিস্তান আমলে তথাকথিত ‘বাইশ পরিবারে’ সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠা, পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সত্ত্বেও আমরা কিন্তু একটি মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক ছিলাম। সামগ্রিক অর্থে সেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের তকমা এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ সেই অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে অতি দরিদ্র দেশের কাতারে শামিল হলেও অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার সোপানে চালিত করতে বেশি দিন সময় লাগেনি। এ দেশের কৃষকরা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা কষ্টার্জিত রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন এবং শিল্প-বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান নিশ্চিত করতে সক্ষম হলেও আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা এসব সম্পদ এবং তার উৎসমুখগুলো রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। গত এক দশকে দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে তার সিকিভাগও বাস্তবায়িত হলে দেশে আরো অন্তত দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হতো এবং এই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে অনেক আগেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারতাম।
স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসে আমরা যখন দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার রাজনৈতিক গালগল্প শুনছি তখন এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, সব ধরনের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং সামগ্রিক অস্থিতিশীলতা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র এখন একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়েছে। মানবাধিকার, নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত-প্রকাশিত হচ্ছে। এদেশের কর্মহীন যুবসমাজের এক বিশাল অংশ চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশে পা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাক থেকে বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা যখন সমুদ্র ও স্থলপথে গণহারে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে, যা ইতিমধ্যে ইউরোপীয় রিফিউজি ক্রাইসিসর জন্ম দিয়েছে, তখন ইউরোপের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় এবং সমুদ্রে ভাসমান রিফিউজিদের তালিকায় বাংলাদেশি নাগরিকদের নামও প্রায়শ উঠে আসছে। সেখানে বাংলাদেশি যুবকরা ইউরোপীয় পুলিশদের সামনে প্লাকার্ড ধরে জানাচ্ছি, ‘শুট আস, উই নেভার গো ব্যাক বাংলাদেশ’Ñ আমাদের গুলি কর, আমরা কখনো বাংলাদেশে ফেরত যাব না। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের নির্যাতিত ও প্রাণভয়ে পলায়নপর নাগরিকদের সাথে বাংলাদেশিরাও মুখ ও ঠোঁট সেলাই করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অভিনব প্রতিবাদের শিরোনাম হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে এই দৃশ্য দেখা গেছে। যেখানে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও আফগান নাগরিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশি নাগরিকরাও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। এমনকি সমুদ্রে ভাসমান হাজার হাজার শরণার্থীর তালিকায়ও বার বার উঠে এসেছে বাংলাদেশিদের নাম। শুধুমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে আসা রিফিউজিদের জন্য ইউরোপের গ্রিস, মেসিডোনিয়া, তুরস্ক, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ তাদের সীমান্ত খুলে দেয়ার ঘোষণা দিলেও বাংলাদেশি নাগরিকদের তারা অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে সেখানে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এভাবেই অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অভিবাসন প্রত্যাশী নাগরিকরা বিশ্বসম্প্রদায়ের গলগ্রহ হয়ে উঠছে। অথচ সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এসব নাগরিককে স্বদেশেই উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা অসম্ভব নয়। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে সেখানে অবস্থানরত অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত আনার ব্যাপারে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ সরকার এসব নাগরিককে দেশে ফেরত আনতে সম্মত হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান লাভ এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সীমান্তরক্ষীদের হাতে আটক হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসীর তালিকায়ও বাংলাদেশি যুবক, নারী ও শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর যখন বলা হচ্ছে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, ডিজিটাল রূপকল্প ঘিরে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পা রাখতে যাচ্ছে, তখন এসব ভিন্ন বাস্তবতা বড় ধরনের বিস্ময় ও প্রশ্ন উদ্রেগ না করে পারেনা।
ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য কমিয়ে আনাই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। তবে বাংলাদেশে এর উল্টোটাই ঘটছে। পরিসংখ্যানের হিসাবে জিডিপি বাড়ছে, মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতি দরিদ্র মানুষের হারও বাড়ছে। গত বছর একটি অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়েছিল, এখনো দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ নি¤œ আয়ের স্তরে আটকে আছে, পরিসংখ্যানের হিসাবে যার মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৭৫ লাখ। আন্তর্জাতিক মানদ-ে যাদের আয় দৈনিক ১.২৫ ডলার বা তার কম তাদেরকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। আর উন্নত বিশ্বে দৈনিক মাথাপিছু আড়াই ডলার বা তার কম আয় হয় এমন লোকদের দরিদ্র হিসেবে ধরা হলেও বাংলাদেশ সরকারের মানদ- দৈনিক এক ডলার হারে হিসাব করে দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। উন্নত-অনুন্নত সব দেশেই উন্নয়নের সুবিধাভোগী হচ্ছে কিছুসংখ্যক সৌভাগ্যবান ধনী মানুষ। বাংলাদেশে এ অবস্থা আরো প্রকট। দেশের মোট সম্পদের বেশির ভাগের মালিকানা নাকি দেশের এক শতাংশেরও অনেক কমসংখ্যক নাগরিকের হাতে। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, তাদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার দশমিক শূন্য তিন শতাংশ । অর্থাৎ দেশের প্রায় ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে ৫ লাখেরও কম সংখ্যক মানুষ বেশির ভাগ সম্পদের মালিক? এনবিআরের আয়কর বিবরণী জমা দেয়ার হিসাব থেকে গত বছর এই পরিসংখ্যান গ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দেশের বেশির ভাগ সম্পদশালী মানুষই কর ফাঁকির সাথে যুক্ত থাকায় শুরুতেই এই হিসাবের সঠিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। তবে ধনীর আরো ধনী হওয়া এবং দরিদ্রের আরো দরিদ্র হওয়ার চলমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের বৈষম্য ক্রমেই ভয়াবহ আকারে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। এতদিন মোটা দাগে বিশ্বের মোট সম্পদের অর্ধেকের বেশি সম্পদ মাত্র একভাগ মানুষের হাতে বলে একটা ধারণা পাওয়া যেত। এখন বলা হচ্ছে, বিশ্বের মোট সম্পদের অর্ধেকের মালিক বিশ্বের ১০০ জনের কম অতি ধনাঢ্য মানুষ। গত বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত চ্যারিট সংস্থা অক্সফামের রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের অর্ধেক বা ৩৬০ কোটি মানুষের সমান সম্পদের মালিক মাত্র ৬২ জন ব্যক্তি। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ২০১০ সালে এ সম্পদের মালিকানা ছিল বিশ্বের ধনাঢ্য ৩৮৮ জনের হাতে। ২০১২ সালে সে সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৭৭ জনে, ২০১৪ সালে ৮০ জন এবং ২০১৫ সালে ৬২ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। একই পদ্ধতির পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে থাকায় বাংলাদেশেও সম্পদের এই বৈষম্য ক্রমে তীব্র আকার ধারণ করছে। এমন বৈষম্যমূলক অর্থব্যবস্থায় তথাকথিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির ফানুস সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনো কাজে আসছে না।
অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানগত হিসাবের সাথে বাস্তবের অনেক গরমিল থাকতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের দাবিকে মেনে নিলেও সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের সাম্প্রতিক চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কথিত সাফল্য মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো কাজে আসছে না। উপরন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের ধস অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, টার্গেটেড কিলিং, শিশু ও নারী হত্যা, পারিবারিক নৃশংসতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চরমভাবে গ্রাস করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক কারণে গুম, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের অপরাধ প্রবণতা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একটি অরক্ষিত মাৎস্যন্যায়ের জনপদে পরিণত করছে। দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমান্নয়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং রাজনৈতিক কারণে প্রকারান্তরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালনের কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনৈতিক প্রবণতা ও বেপরোয়া মনোবৃত্তি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষানীতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রচার ব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন সমাজকে কলুষিত বিবেক বর্জিত বর্বর জনপদে পরিণত করছে। শাসক শ্রেণীর হীন স্বার্থপরতার, সুশাসনের অভাব ও ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিতে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পথ ধরে সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন সর্বগ্রাসী আকার পরিগ্রহ করেছে। প্রায় প্রতিদিনই অবিশ্বাস্য নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার খবর শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষের চেতনা অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রতিদিনই ১০-২০টি নৃশংস হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। শিশুহত্যা, বর্বর পন্থায় খুন, পারিবারিক বিরোধ, নিষ্ঠুরতা, নারী ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা এখন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার ফল হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় পুরো সমাজকে একটি বিকৃত ও মানসিকতা বৈকল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটি শিশুর যখন জন্মদাত্রী মায়ের কাছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পাওয়ার কথা মায়েরাই নির্মমভাবে নিজ সন্তানের হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা সত্যিই কঠিন।
সাম্প্রতিক কয়েক মাসে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই একাধিক নিষ্পাপ শিশু মায়ের হাতে খুন হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই সমাজে অপরাধ, হত্যাকা- ছিল, আছে এবং সভ্যতার শেষ পর্যন্তও থাকবেই। তবে মায়ের হাতে শিশু নিহত হওয়ার মতো ঘটনা কখনো কখনো বিরল, বিচ্ছিন্ন ও ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও এখন আর তা যেন বিরল ব্যতিক্রম হয়ে থাকছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত একশ্রেণীর লম্পট শিক্ষকের লালসার শিকারে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে সমাজকে উচ্চশিক্ষা ও উদ্ভাবনী প্রতিভা বিকাশের আলোয় আলোকিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গড়ে ওঠা একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন একেকটি ক্রাইমজোনে পরিণত হয়েছে। এ সপ্তাহে মতিহার ক্যাম্পাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিমের নৃশংস হত্যাকা- তার সর্বশেষ বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মার্চের প্রথম সপ্তায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বছরের প্রথম দুই মাসে ৫৭৮টি হত্যাকা-ের খবর পাওয়া যায়। গত দুই মাসে এ সংখ্যা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। হবিগঞ্জে একসাথে ৫ শিশুর হত্যাকা-, রাজধানীর বনশ্রীতে দুই ভাইবোন মায়ের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাসহ অবিশ্বাস্য সব হত্যাকা- যেন আমাদের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-, কূটনৈতিক জোনে বিদেশি নাগরিক হত্যা থেকে শুরু করে সেনানিবাস এলাকায় নিহত সোহাগি জাহান তনু হত্যাকা- পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর কোনো হত্যাকা-েরই রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারায় হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচারও ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার এজাহারভুক্ত আসামিরা ‘প্রিমা-ফেসি’ দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও পুলিশ কাস্টডিতে তাদের জামাই আদরে রাখার খবরে দেশের মানুষ আতঙ্কিত ও বিচলিত না হয়ে পারে না। এ কারণেই একদিকে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা প্রতিপক্ষের প্রতি আরো নির্মম ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অন্যদিকে সাধারণ মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়ে নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার কারণেও কখনো কখনো বিচারবহির্ভূত নির্মম হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। নানাভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের ধারাবাহিক ঘটনাবলী, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচনী পরিবেশ ও সহিংসতার ঘটনাবলির পুনরুল্লেখ এখানে বাহুল্য হতে পারে। সার্বিক বাস্তবতায় সংক্ষেপে এটুকু বলা যেতে পারে, শুধুমাত্র মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানগত হিসাব এবং কিছু মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন দিয়ে দেশ ও সমাজের উন্নয়নের মানদ- নিরূপণ করা বড় ধরনের ভুল। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নয়ন, সামাজিক মূল্যবোধের সুরক্ষা, সুশাসন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে উন্নয়নের রাজনৈতিক স্লোগান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। আমরা ঢাকা শহরে ফ্লাইওভার বা দক্ষিণের মানুষ পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দ্রুততর সময়ে নির্বিঘেœ চলাচলের স্বপ্ন দেখি, তবে যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সমাজে শান্তি, সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা নিয়ে বসবাসের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা পরিসংখ্যান ব্যুরো নয়, দেশের সাধারণ মানুষই উন্নয়নের প্রধান সাক্ষী ও নিরূপক। গণতন্ত্র, সুশাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনই হচ্ছে দেশের মানুষের কাছে অগ্রাধিকার। এসব বিষয় অগ্রাহ্য করলে উন্নয়নের আর কোনো মানদ-ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
[email protected]

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ