Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার দিকে ঝুঁকেছে বিশ্ববাসী। চীন, ভারত, শ্রীলংকা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ২০৩০ সাল থেকে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ও ২০৪০ সাল থেকে তেল দিয়ে যানবাহন চালানো বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে বিশটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি প্রদেশ। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে পুনরায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে। অপরদিকে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিড়িক পড়েছে বিশ্বময়। নিত্য নতুন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্র আবিষ্কার করে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে গত ৭ সেপ্টেম্বর বিবিসিতে প্রকাশ, ‘বিপুল-সংখ্যক সৌর প্যানেল ও বায়ু টারবাইন স্থাপনের মাধ্যমে সাহারা মরুভূমির সবুজায়ন করা সম্ভব বলে এক গবেষণায় জানানো হয়েছে। এটা হলে ঐ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও গাছপালার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে, যা স¤প্রতি ‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সাহারাকে সবুজায়ন করতে বিজ্ঞানীরা একটি মডেল তৈরি করেছেন। এর আওতায় সাহারার ৯০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা পড়েছে। তাতে বিপুল সৌর প্যানেল ও বায়ু টারবাইন স্থাপনের ফলে সারা বিশ্বে বর্তমান উৎপাদিত বিদ্যুতের চার গুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।’ গত ১৩ মার্চ দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সৌরশক্তি জোটের শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে বিনিয়োগসহ অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই জোট গড়ে তুলে আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন অ্যামেরিকা ও ইউরোপের ২৩টি দেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে ভারত। সন্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের ২৩টি দেশের প্রধান অংশগ্রহণ করেন। সন্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌর-বিদ্যুৎ ব্যবহার যত বাড়বে, ততই কমে যাবে বিশ্বের উষ্ণায়ন। এই গ্রহকে বাঁচাতে সূর্যই শেষ ভরসা। তাই ২০২২ সালের মধ্যে ভারত ১৭৫ গিগা-ওয়াট সৌর-বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো ঘোষণা করেন, আইএসএ’র সদস্য দেশগুলোতে সস্তায় সৌর-বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন, যার মধ্যে ভারত ১৪০ কোটি ডলার ও ফ্রান্স ১৩০ কোটি ডলার দেবে। অনেকেই মনে করছেন, এই লক্ষ্য-পূরণ সহজ নয়। কারণ, ভারতে সৌর-বিদ্যুতের খরচ পড়বে প্রতি ইউনিট ২.৪০ টাকা, যা লাভজনক নয়। সৌউদি আরবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করবে সফটব্যাংক। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০০ গিগা-ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। বিশ্বে বর্তমানে মোট সৌর-বিদ্যুতের মজুদ রয়েছে ৪০০ গিগা-ওয়াট ও ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট পারমাণবিক শক্তি ছিল ৩৯০ গিগাওয়াট। টোকিওর কাছে জাপানের বৃহৎ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। কেন্দ্রটির বার্ষিক উৎপাদন হবে ১.৬০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টার বেশি। নরওয়ে পুরো পরিবহন ব্যবস্থাকে ‘ব্যাটারি প্রকল্পে’ নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটিতে ব্যাটারি চালিত গাড়ি ছাড়া অন্য সব গাড়ি নিষিদ্ধ আর ২০৪০ সাল নাগাদ সব সড়ক, নৌ ও আকাশযানকে ব্যাটারি চালিত করা হবে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক গ্রেগ রাউ বলেছেন, সমুদ্রের পানি থেকেই তৈরি হবে বিকল্প জ্বালানি। সমুদ্রের পানির অণুগুলো ভেঙে তৈরি করতে হবে হাইড্রোজেন গ্যাস। এর জন্য ব্যবহার করতে হবে ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতি। পানির তড়িতায়ন হয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এ জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব।হাইড্রোঅক্সাইড আয়ন ও হাইড্রোজেন আয়নগুলোকে আলাদা করা যাবে ইলেকট্রোলাইসিসের মধ্যে দিয়ে। এই হাইড্রোঅক্সাইড বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করবে। তৈরি করবে বায়ো কার্বোনেট। তার পর সেখান থেকেই তৈরি হবে বিশেষ জ্বালানি, যা সমুদ্রের ইকো সিস্টেমকে দূষিত করবে না। এ জ্বালানিকে বলা হচ্ছে হাইড্রোজেন ফুয়েল। এর খরচও অনেক কম। এর আগে আয়ারল্যান্ডে একটি ইউরোপীয় গবেষণা প্রকল্পে সাগরের পানির নিচে সি-উইড থেকে জ্বালানি উৎপাদনের নমুনা দেয়া হয়। গবেষকেরা ওই সামুদ্রিক শ্যাওলা থেকে যে তেল বের করেছেন, তা বায়োফুয়েল তৈরিতে কাজে লাগানো যায়। সি-উইডের চাষ করতে কোনও সার ও চাষের জমি লাগে না। বায়ো ফুয়েলে উড়বে বিমান। ভারত প্রথমবার ওড়াতে চলেছে জৈব জ্বালানি চালিত এয়ারক্রাফট। এখন পর্যন্ত কোনও উন্নয়নশীল দেশ পরীক্ষা করেনি জৈব জ্বালানিচালিত বিমান। যদিও বেশ কিছু উন্নত দেশ এরই মধ্যে এনেছে সমগোত্রীয় জ্বালানিচালিত বিমান। যেমন: অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে জৈব জ্বালানিকে ব্যবহার করে বিমান উড়ানোর চেষ্টা করেছিল আলাস্কা এয়ারলাইন্স ও কেএলএম। অনেক দেশই বিষয়টিকে নিয়ে চালাচ্ছে পরীক্ষা। তাই ভবিষ্যতে জৈব জ্বালানি হতে পারে একটি বিকল্প। অস্ট্রেলিয়া তার দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করার লক্ষ্যে ‘লিথিয়াম ব্যাটারি’ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে গতবছর, যার ক্যাপাসিটি ১০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই ব্যাটারিটি একটি উইন্ডফার্মের সাথে সংযুক্ত। সেটি দিয়েই এটা চলছে। একই এলাকায় ১৫০ মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির আর একটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। চীনের নিংজিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৌর প্যানেলের সারি গড়ে উঠছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে বিশ লক্ষ পরিবারকে সবুজ জ্বালানি দেয়া সম্ভব হবে। এটি চীনের এরকম বেশ কয়েকটি প্রকল্পের একটি। চীনের আর একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে সোলার রোড নির্মাণ। এতে পেট্রল বা ডিজেলের প্রয়োজন নেই! রাস্তায় চলতে চলতেই গাড়িতে চার্জ হবে। এমনকি ড্রোনের সেন্সরও চার্জ দেয়া যাবে। এর আগে ২০১৬ সালে শানদং এলাকায় এমন সৌর রাস্তা নির্মাণ করেছে চীন। অপরদিকে, সম্পূর্ণ কঠিন পদার্থে তৈরি ব্যাটারি ২০২০ সালের প্রথমার্ধে ব্যবহারের জন্য টয়োটা প্যানাসনিকের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। হোন্ডাও এই ধরনের ব্যাটারির উন্নয়নে কাজ করছে। এই ব্যাটারি বৈদ্যুতিক মটরগাড়ি প্রচলিত ব্যাটারির চেয়ে অধিক দূরত্ব অতিক্রম করবে। ছোট্ট জৈব অণু- গ্লাইসিন থেকে কম খরচে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন একদল বিজ্ঞানী। গ্লাইসিন হলো সবচেয়ে সরল অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা মানবদেহের সংযোজক কোষগুচ্ছে ও স্নায়ুকোষে এবং মাছ-মাংস, দুধ ও শাকসবজিতে থাকে। এমনকি সৌরজগতের বাইরেও। গবেষকরা বলেন, ১০০ গ্রাম সয়াবিন থেকে চর্বিটুকু আলাদা করলে দুই গ্রাম গ্লাইসিন পাওয়া যায়, যা থেকে অনেক পিজো বিদ্যুৎ মেলে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেকের বিজ্ঞানীরা শস্যের পরিত্যক্ত অংশ থেকে হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদন করেছেন। তাদের দাবি- হাইড্রোজেনই হবে ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ জৈব জ্বালানি। হিমালয়ের গ্রামগুলোতেও সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

কয়েক মাস আগে এক নিবন্ধে অধ্যাপক আসাদুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন, ‘সারাবিশ্বে বায়ু-বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে বাতাস হতে ১৭ হাজার মেগাওয়াট থেকে ৪.৩০ লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া, ২০১৫ সাল থেকে চীন এ পর্যন্ত ১.২০ লাখ মেগাওয়াটের ওপরে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। ভারতও এ পর্যন্ত ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। এই ধারা অব্যাহহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ হবে বায়ু বিদ্যুৎ। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৫ সালের মধ্যে অন্তত ৫ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি পাওয়া যাবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ৪০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ১২০০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। যাতে বায়ুর গতিবেগ স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। কাজেই উপকূলীয় এলাকায় বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা আছে।’ অপর এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৫০ লাখ সোলার প্যানেল ব্যবহার করে তা থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩৯০ মেগাওয়াট। তাই ভারত থেকে সৌর বিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ, সেখানে এর মূল্য অনেক কম। অর্থাৎ বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পরিমাণ খুব কম। এর কারণ,সোলারের মূল্য অত্যধিক ও এফিসিয়েন্সি খুব কম। তাই মূল্য অধিক। এছাড়া, জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্যও অত্যধিক। কারণ, মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক বেসরকারি খাতের। যার অধিকাংশই রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের। যার মূল্য ইউনিট প্রতি ১৯-২০ টাকা। এই মূল্যে কিনে সরকার কম মূল্যে বিক্রি করছে। ফলে কয়েক বছরে ৮-১০ বার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেও গত ১২ বছরে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুতের ভর্তুকি তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন সম্প্রতি। কিন্তু এটা হলে যারা এখন বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, তাদের অর্ধেক মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ, মূল্য দ্বিগুণ হবে। পণ্যমূল্যও অনেক বাড়বে। এমনকি ব্যবসায়ীরাও নিবে কি-না সন্দেহ আছে। যার প্রমাণ, গত বছর আলাদা লাইনের মাধ্যমে ১৪ টাকা ইউনিট প্রতি দরে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। কারণ, ঐ দরের চেয়ে জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন করলে তার ব্যয় কম হয়। এ ব্যাপারে কিছুদিন আগে ডয়চে ভেলের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র ১০৯টি। তন্মধ্যে ৩টি দীর্ঘমেয়াদী মেরামতের জন্য বন্ধ আছে। উৎপাদনে আছে ১০৬টি। তন্মধ্যে গ্যাস-ভিত্তিক ৫৭টি, তেল ভিত্তিক ৪৬টি, কয়লা ভিত্তিক দু’টি এবং একটি পানি বিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক ব্যয়বহুল। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ৫.৫৯ টাকা আর বিক্রি করা হয় ৪.৮৭ টাকায়। এইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১৫,৩৭৯ মেগাওয়াট। তন্মধ্যে ২২০০ মেগাওয়াট কেপটিভ বিদ্যুৎ রয়েছে। সক্ষমতার সমান বিদ্যুৎ কখনোই উৎপাদিত হয়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নানা সমস্যার কারণে যেমন সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, তেমনি সঞ্চালন লাইনের ত্রুটির কারণে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে যায় না। বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৩.১% ‘সিস্টেম লস’ হয়। তাই গড়ে যদি ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তাহলে প্রকৃত উৎপাদন হবে ৭ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। উল্লেখ্য যে, এর বাইরে কিছু বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। তথাপিও চাহিদা বেশি থাকায় ঘাটতি প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। ফলে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ তেমন থাকে না। দ্বিতীয়ত সঞ্চালন লাইন সেকেলে। তাই সরবরাহ বিঘ্নিত হয় সর্বত্রই। স্মরণীয় যে, সরকার সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, যার বেশিরভাগই জ্বালানি ভিত্তিক এবং তা আমদানিকৃত। তাই ভবিষ্যতে বিদ্যুতের মূল্য আরও বাড়বে। দেশীয় গ্যাস প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ফলে আমদানিকৃত এলপিজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে,যার মূল্য অনেক। অপরদিকে, কয়লার উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য কম। কিন্তু এ খাতের অগ্রগতি তেমন নেই বলে স¤প্রতি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম। দেশীয় কয়লা উত্তোলনেরও কোন লক্ষণ নেই! দেশে বিদ্যুতের মূল্য অধিক হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক। এ ব্যাপারে এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত সব খরচই মূলধনি ব্যয়। ভূমি অধিগ্রহণ, অনুমোদন, আইনি বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যন্ত্রপাতি ক্রয়, নির্মাণকাজ ও কমিশনিং। বাংলাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় কেমন, তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক। তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তারা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াট-প্রতি মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। যেমন: কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সবচেয়ে কম মূলধনি ব্যয় চীনে- কিলোওয়াট-প্রতি ৫৬৮ ডলার, আর বৈশ্বিক গড় ব্যয় ৯৭৪ ডলার। আর বাংলাদেশে গড়ে ১১৬৪ ডলার। এমনকি সর্বোচ্চ ৩০০৫ ডলার পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে।গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় কিলোওয়াট-প্রতি গড়ে ৫৫১ ডলার। আর বাংলাদেশে গড়ে ১১৭৭ ডলার।এছাড়া আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াট-প্রতি বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় গড়ে ১৬০০ ডলার। আর বাংলাদেশে গড়ে ৩৩৪৩ ডলার। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াট-প্রতি বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় গড়ে ৪৪৭৪ ডলার। আর বাংলাদেশে ৫৬২৫ ডলার। তবে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াট-প্রতি বৈশ্বিক ব্যয় গড়ে ৪০৫৪ ডলার। আর বাংলাদেশে ৩৬৪৯ ডলার। এছাড়া পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশে মূলধনি ব্যয় কিলোওয়াট-প্রতি গড়ে ২৬৭৬ ডলার; বৈশ্বিক গড় ব্যয় ২৮৬৬ ডলার। গবেষণার এ ফলাফল গত মার্চে ফ্রন্টিয়ার্স ইন এনার্জি রিসার্চে প্রকাশিত হয়েছে। স্মরণীয় যে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ দেওয়া হয়েছে বিনা টেন্ডারে। উপরন্তু এ ব্যাপারে কোন মামলা করা যাবে না বলে আইন করা হয়েছে। সে কারণে এবং রেট খুব বেশি হওয়ায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞগণ এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তবুও সরকার বারবার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। যা’হোক, দেশে বিদ্যুতের মূল্য কমানো প্রয়োজন। সিস্টেম লস হ্রাস, দুর্নীতি বন্ধ, বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপকরণ সাশ্রয়ী, কেন্দ্র নির্মাণের ব্যয় বিশ্বের সমান ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করা হলেই মূল্য হ্রাস পাবে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল তৈরি এবং সঞ্চালন লাইন আধুনিক করা দরকার। সর্বোপরি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ জানুয়ারি, ২০২৩
১৭ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন