Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দাওয়াত মানব সংশোধনের সর্বোত্তম উপায়

প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহবুবুর রহমান নোমানি

দাওয়াত অর্থ ডাকা, আহ্বান করা। দাওয়াত বলতে বুঝায়, মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা। মানব সংশোধনের সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম পন্থা আল্লাহর পথের দাওয়াত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষকে আল্লাহর পথে ডাক হেকমত ও উত্তমারূপে বুঝিয়ে-শুনিয়ে।’ (সূরা নাহল : ১২৫) মানুষের হেদায়েত ও কল্যাণের বার্তা দিয়ে যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা নবীÑরাসূল প্রেরণ করেছেন। লক্ষাধিক পয়গম্বরের মধ্যে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তিঁনি প্রেরিত হয়েছেন কিয়ামত অবধি জিন ও মানবের নবী হয়ে। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া। দাওয়াতের কাজ নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন মানুষের ঘরে-ঘরে, দোয়ারে-দোয়ারে, বাজারে-দোকানে, মজমা-সমাবেশে। মানুষের নাজাতের চিন্তা তাঁকে অস্থির করে তুলতো। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘জনৈক ব্যক্তি আগুন প্রজ্বলিত করেছে, আর তাতে পতঙ্গরা ঝাঁপ দিচ্ছে। সে ব্যক্তি ওদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নবীজি (সা.) বলেন, তোমাদের সঙ্গে আমার দৃষ্টান্ত হলো অনুরূপ। আমি তোমাদের কোমর ধরে ধরে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমরা আমাকে পরাস্ত করে সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছো। (মুসলিম : ৩০৯৭)
দাওয়াতের বদৌলতে এই উম্মত শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেনÑ ‘তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের কল্যাণের জন্যই তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। (আলে ইমরান : ১১০) দীনের কথা মানুষকে বুঝিয়ে সত্য ও মুক্তির পথে নিয়ে আসা মানবতার পক্ষে সবচেয়ে বড় কল্যাণের কাজ। মানুষকে বিভিন্নভাবে উপকার ও কল্যাণ পৌঁছানো যায়। কিন্তু দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের সব চেয়ে বড় কল্যাণ ও উপকার করা হয়। আরেকজনের ঈমান-আমল ঠিক করে দেয়া, আখেরাতে তার নাজাতের ব্যবস্থা করে দেয়ার চাইতে বড় কল্যণ আর কী হতে পারে? রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কেউ হেদায়েতের পথে দাওয়াত দিলে তার দাওয়াতের যত মানুষের হেদায়েত হবে, ওই সব মানুষের আমলের সোয়াব তারও হবে। কিন্তু এতে অন্যদের আমলের সোয়াব কমবে না। (ইবনে মাজাহ) অধিকন্তু দাওয়াতের দ্বারা নিজের ঈমান-আমল মজবুত হয়। বাস্তবাতায় দেখা যায়, দীন-ঈমান সম্পর্কে অজ্ঞ, বে-আমল লোকেরা তাবলিগ জামাতে বের হয়ে নিজের ঈমান-আমল সংশোধন করে নিচ্ছেন। সুতরাং দাওয়াতের কাজ প্রত্যেকের করা উচিত। আল্লাহ বলেন,‘ওই ব্যক্তির কথার চেয়ে উত্তম কথা কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে আর বলে আমি একজন মুসলমান।’ [হা-মীম সেজদা : ৩৩]
একজন মুসলমানের প্রাথমিক ও বুনিয়াদি কাজ হচ্ছে দাওয়াত। প্রত্যেক সাহাবি দাওয়াতের কাজ করেছেন। নবী করিম (সা.) ইসলামের শুরু থেকেই সাহাবাগণকে দাওয়াতের জিম্মাদারি বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাই সাহাবিদের মাঝে ছিল দাওয়াতি মেজাজ ছিল। ইসলামের প্রথম মুসলামান আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার হবার পর জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন আমার কাজ কী? নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমার যেই কাজ তোমারও সেই কাজ।’ নিজের ঈমান-আমলের পাশাপাশি অন্যের ঈমান-আমলের ফিকির করা আখেরাতের মুক্তির জন্য জরুরি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবারের লোকদেরকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা তাহরিম : ৬) আজকাল নিজের ছেলে- মেয়েকে চোখের সামনে পাপাচারে লিপ্ত হতে দেখি, বন্ধু-বান্ধবদের মন্দকাজ করতে দেখি অথচ তাদেরকে সতর্ক করার কোনো চিন্তা আমাদের অন্তরে জাগে না। আবার অনেকে সকাল-সন্ধ্যা অন্যকে দাওয়াত দেন কিন্তু নিজ পরিবার ও অধিনস্তদের প্রতি খেয়াল রাখেন না। এই শীথিলতা ইসলাম সমর্থন করে না। মনে রাখতে হবে, প্রথমে নিজেকে দাওয়াত দেয়া আবশ্যক। তারপর নিজের পরিবার ও অধীনস্তদেরকে। অত:পর অন্যান্য ব্যক্তিকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে। সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে বাঁধা প্রদান করবে। তারাই হলো সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)
দাওয়াতের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এক. ইনফিরাদি বা একাকভাবে দাওয়াত দেয়া। দুই. ইজতেমায়ি বা সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াত প্রদান করা। ওয়াজ, মাহফিল, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে ইজতেমায়ি দাওয়াত হচ্ছে। বর্তমানে প্রচলিত তাবলিগ জামাতও ইজতেমায়ি দাওয়াতের কাজ করে যাচ্ছেন। ইজতেমায়ি তাবলিগ ফরজে কিফায়া কিন্তু ইনফিরাদি তাবলিগ ফরজে আইন। নিজের চোখে সামনে কাউকে অন্যায়কাজে লিপ্ত দেখলে তাকে বাঁধা দেয়া, দীনের কথা বুঝিয়ে তাকে বিরত রাখা প্রত্যেকের উপর ফরজ। মনে করা উচিৎ নয় যে, এটা মৌলভীদের কাজ বা তাবলিগ জামাতের দায়িত্ব। বরং প্রিয় নবীর ভাষ্য মতে এ কাজের দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর অবশ্য পালনীয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) বর্তমানে ইনফেরাদি দাওয়াতের কাজে বড় অবহেলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলা যেতে পারে, একটা স্বতন্ত্র ফরজ আদায়ের ব্যাপারে বড্ড অবহেলা করা হচ্ছে। শরিয়তের বিধি-বিধান দুই ধরনের। করণীয় ও বর্জনীয়। তেমনি দাওয়াতের বিষয়ও দুটি। তথা ‘আমর বিল মারুফ’ ও ‘নাহি আনিল মুনকার’। আখেরাতের মুক্তির জন্য শুধু করণীয় কাজ আদায় যথেষ্ট নয়। বর্জনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। তাই শুধু ‘আমর বিল মারুফ’ তথা সৎকাজের আদেশ যথেষ্ট নয়। মানুষকে অন্যায় ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা অতি জরুরি। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেহ অন্যায় কাজ হতে দেখলে শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করবে। তা না পারলে কথার মাধ্যমে বন্ধ করবে। তাও সম্ভব না হলে অন্তরে ঘৃণা করবে। এটা ঈমানের সর্বনি¤œ স্তর। (মুসলিম শরিফ) অবশ্য অন্যায় কাজে বাঁধা দেয়ার ক্ষেত্রে কতিপয় নিয়ম জেনে দরকার। যেমনÑ এক. মন্দকর্মে লিপ্ত ব্যক্তির ব্যাপারে যদি এই ধারণা প্রবল হয় যে, এ মুহূর্তে তাকে বাধা দিলে সে মন্দকর্ম থেকে বিরত হবে না, উল্টো শরিয়তকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। তখন ‘নাহি আনিল মুনকার’ এর ফরজিয়্যাত রহিত হয়ে যায়। কেননা শরিয়তের বিধান তুচ্ছাকারী ব্যক্তি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে এভাবে দুআ করা উচিত, হে দয়াময় আল্লাহ! আপনার এ বান্দা কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। আপনার দয়া ও অনুগ্রহে তাকে এ ব্যাধি থেকে আরোগ্য দান করুন। দুই. দাওয়াত শুনে অন্যায় থেকে বিরত হওয়া বা না হওয়া উভয়টির সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে হক কথা বলে দেয়া উত্তম। কেননা হতে পারে দাওয়াতের বরকতে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরে পরিবর্তন এনে দেবেন এবং সে সংশোধিত হয়ে যাবে। তিন. যদি এরকম ধারণা হয় যে, গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে দাওয়াত দিলে সে শরিয়তের বিধান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করলেও দায়িকে কষ্ট দেবে। তখন তাকে বাঁধা প্রদান না করার অনুমতি রয়েছে। অবশ্য ভয়Ñভীতি উপেক্ষা করে তাকে দীনের কথা বলে দেওয়া এবং এ কারণে প্রদত্ত কষ্টকে মাথা পেতে নেয়া প্রশংসনীয়। দাওয়াতের বেলায় এ বিষয়গুলো স্মরণ রাখা উচিৎ।
লেখক. মুহাদ্দিস,জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দাওয়াত মানব সংশোধনের সর্বোত্তম উপায়
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ