Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রক্তাক্ত খাগড়াছড়ি

বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৮, ১:০১ এএম

পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সংঘাতে ফের রক্তাক্ত হয়েছে পার্বত্য জনপদ। গতকাল শনিবার সকালে খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় সশস্ত্র দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে ৬ জন নিহত এবং ৩ জন আহত হয়। এ ঘটনাকে ঘিরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে শহরসহ খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে। আবারো যেকোনো সময় সংঘাতের আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী। স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি লোকজনের জোরালো আশঙ্কা প্রতিপক্ষ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ এই হত্যার প্রতিশোধে মরিয়া হলে ঘটতে পারে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলায় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেছে। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গামাটি জেলার জনসাধারণের মাঝেও এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। সর্বত্র পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্কাবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য জনপদে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সংঘাতের কারণে গত সাড়ে ৭ মাসে অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র পাহাড়িদের গুলিতে খুনাখুনির ঘটনা ইতিপূর্বেও ঘটে। তবে খাগড়াছড়ি শহরের মধ্যেই তাও প্রকাশ্য দিবালোকে গোলাগুলিতে এক সঙ্গে এতজন মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
প্রশাসন ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর একটি গ্রুপ খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় হত্যা, গুম, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আগেই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারা সেখানে জড়ো হলে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সশস্ত্র কর্মীরা এসে হামলা চালায়। তখন বিবদমান দু’টি পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। বৃষ্টির মতো অবিরাম গোলাগুলি চলে আধাঘণ্টারও বেশী সময়। সকাল ৯টার পরও গুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থলের কাছে পুলিশ বক্সেও গুলি করেছে বলে প্রশাসন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। এরপরই এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
‘ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপ’ বনাম ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপ’ এই দু’টি বিবদমান পক্ষ গোলাগুলিতে লিপ্ত হয় বলে প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়। সেই সাথে জনসংহতি সমিতির একাংশকেও দায়ী করা হচ্ছে। নিহত ৬ জনের মধ্যে ৩ জনকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছে ইউপিডিএফ। তারা এর পেছনে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) এবং স্থানীয় একটি মুখোশ বাহিনীকে দায়ী করেছে। তবে জনসংহতি সমিতি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেছেন ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা। খাগড়াছড়ি জেলায় পার্বত্য শান্তি চুক্তিবিরোধী প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের প্রভাব বেশি। গতকালের গোলাগুলিতে নিহতরা হচ্ছে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা, জিতায়ন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের জেলা সভাপতি পলাশ চাকমা, বিধান চাকমা ও অনুপম চাকমা। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহতরা হচ্ছে, ইউপিডিএফ কর্মী সমর বিকাশ চাকমা, সুকিরন চাকমা ও সোহেল চাকমা। আহত ৩ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গতকাল খাগড়াছড়ি শহরের উক্ত এলাকায় ইউপিডিএফ-এর বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচিতে সকাল ৭টা থেকে ওই সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা জড়ো হচ্ছিল। কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই প্রতিপক্ষের কর্মীরা চড়াও হলে দুই পক্ষে সশস্ত্র সংঘর্ষ বাধে।
এদিকে গোলাগুলির সময় আতঙ্কগ্রস্ত সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করে বাড়িঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় দোকান-পাট এবং যানবাহন চলাচল। চারিদিকে জনমনে বিরাজ করছে ভীতি আর শঙ্কা। গতকাল সন্ধ্যার আগেই খাগড়াছড়ি পরিণত হয় ভুতুরে শহরে।
গোলাগুলির খবর পেয়ে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বেলা ১১টা নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাৎ হোসেন জানান, অতর্কিতভাবেই এই হামলা ও গোলাগুলির ঘটনাটি ঘটে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং পুলিশের টহলও চলছে।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের চিকিৎসকগণ জানান, ঘটনাস্থল থেকে প্রথমে ৫ জনকে নিহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। পুলিশের সহায়তায় আহত অবস্থায় আনা হয় ৪ জনকে। এদের মধ্যে একজন হাসপাতালে মারা যান। অপর ৩ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। গতকাল বিকেলে চমেক হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গুরুতর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত পাহাড়ি ৩ জন যুবকের চিকিৎসা চলছিল।
এদিকে সশস্ত্র কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফের মধ্যে ভাঙনের পর পাহাড়ে দু’টি গ্রুপের মধ্যকার সংঘাত-সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। এ বছরের ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের অন্যতম শীর্ষ নেতা মিঠুন চাকমাকে। এরজন্য ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’কে দায়ী করে অপর ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপ। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ কর্মী দীলিপ চাকমাকে ব্রাশফায়ারে খুন করা হয়। এর চার দিন পর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের অপর এক ইউপিডিএফকর্মী নিহত হয়। গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়ায় সশস্ত্র হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নিহত হয়। গত ৪ মে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে খুন হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের অন্যতম শীর্ষনেতা তপন জ্যোতি চাকমাসহ ৫ জন। গত ৩ মে রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করে সশস্ত্র পাহাড়িরা। তিনি জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির পদে ছিলেন। আবার পরদিন তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হামলায় ৫ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে তপন জ্যোতি চাকমা ছিলেন ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক গ্রুপের শীর্ষনেতা। এভাবেই পার্বত্য জনপদে সশস্ত্র পাহাড়িদের সংঘাতে ঘটছে একের পর এক হতাহতের ঘটনা।
সন্ত্রাসী হামলায় আরেকজন নিহত
গতকাল খাগড়াছড়ির পেরাছড়া এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলে কথিত সন্ত্রাসী হামলায় শন কুমার চাকমা (৫৫) নামে অপর এক ব্যক্তি নিহত হয়। জানা গেছে, ইউপিডিএফ’র একটি গ্রুপ বিক্ষোভ মিছিলকালে খাগড়াছড়ি শহরের দিকে আসার পথে পেরাছড়া ব্রিজ এলাকায় হামলা হয়। এ সময় পালাতে গিয়ে ৪ জন আহত হয়। এদের মধ্যে শন চাকমাকে হাসপাতালে মারা যায়। ইউপিডিএফ এ ঘটনায় ‘জনসংহতি সমিতি সংস্কার’ গ্রুপকে দায়ী করে।
আগামীকাল সড়ক অবরোধের ডাক
খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় গোলাগুলিতে ৬ জন এবং পেরাছড়ায় হামলায় একজন ইউপিডিএফের (একাংশ) সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকাল সোমবার খাগড়াছড়িতে আধাবেলা সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছে তিনটি পাহাড়ি সংগঠন। এগুলো হচ্ছে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিহত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ