পশ্চিম তীরে সহিংসতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের
ইনকিলাব ডেস্ক : ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ১৯৬৫ সালের গণহত্যা। এই গণহত্যা চালিয়েছিল দেশটির সামরিক বাহিনী। কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আছে এমন ধারণা থেকে সামরিক বাহিনী ওই সময় কমপক্ষে ৫ লাখ লোককে হত্যা করে। পশ্চিমের প্রচার যাই থাকুক না কেন, এই হত্যাকা-ের বেদনাময় স্মৃতি আজো বয়ে বেড়ায় ইন্দোনেশিয় জনগণ। তাই, আজ ৫১ বছর পর দেশটিতে বিষয়টি আবার আলোচনায় এসছে। ওখানকার সমাজকর্মীরা মনে করছেন হত্যাকা-ের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে হত্যাকারী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্মিলন প্রয়োজন। পশ্চিমা গণমাধ্যম, ইন্দোনেশিয় প্রশাসন এবং রাজনীতিকরা যাই বলুকনা কেন এই গণহত্যার পেছনে ছিল তখনকার আন্তর্জাতিক রাজনীতি, দেশিয় রাজনৈতিক ধারায় কট্টর ডানপন্থার উত্থান এবং মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের মধ্যে বিরাজিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ওটা ছিল ওই সময়ের দ্বি-মেরুর বিশ্বের এক সারণ প্রবণতা।
ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যাকে বুঝতে হলে অনুধাবন করতে হবে দ্বি-মেরু বিশ্বের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি। ১৯৬৫ সাল; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়েছে দুদশক আগে। বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল হলো সম্প্রসারণবাদী শক্তি হিসেবে জাপানের ক্ষমতা হ্রাস, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কলেবর সঙ্কোচন, জার্মানির বিভাজন, ভারতের স্বাধীনতা লাভ পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সম্প্রসারণ এবং সারা দুনিয়াতে স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি এবং চার্চিলের ঘোষণা অনুযায়ী ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে লৌহ-যবনিকার উদ্ভব।
এরপর দ্বি-মেরুর পৃথিবীতে, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রাম সেখানে সংগ্রামীদের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে গণমানুষের মুক্তির সংগ্রাম সেখানে সংগ্রামের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র। এই সংগ্রাম-সংঘাতের হাত আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকায় রক্তপাত হয়েছে, নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, উত্থান হয়েছে স্বৈরশাকদের। দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, সুদান, উগান্ডা, চিলি এবং ইন্দোনেশিয়া বহু ঘটনার কয়েকটি উদাহারণ মাত্র। আর ওই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে জ্বলজ্বলে উদাহরণ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ। ষাটের দশকে ইন্দোনেশিয়ায় দুটো শক্তি এক যোগে বিকাশ লাভ করতে থাকে একটি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার, অন্যটি উগ্র ডানপন্থি। প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। সমাজতন্ত্রী না হলেও বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের জাতীয়তাবাদী নেতা। ইন্দোনেশীয় ডানপন্থিদের কোন রাজনৈতিক প্লাটফরম ছিল না। তাদের কৌশল ছিল সকল ডানপন্থি দল ও প্রশাসনে তাদের সদস্য সৃষ্টি করা। যাতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, যে ব্যক্তিই প্রশাসনের শীর্ষ পদে আসুক, প্রকৃত ক্ষমতা থাকবে পেছনের সংগঠনের হাতে। আর সমাজতন্ত্রীরা বেড়ে উঠছিল মানুষের মধ্যে। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মধ্যেও।
কথিত আছে, ১৯৬৫ সালে সমাজতন্ত্রী সৈন্যরা ৬ জন জেনারেলকে হত্যা করলে ডানপিন্থ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের সংঘাত প্রকট হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট সুকর্ণর গার্ড রেজিমেন্টের একজন কর্নেলের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান চেষ্টা হচ্ছে এই অজুহাত জেনারেল সুহার্তো সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। এ সময় হত্যা করা হয় হাজার হাজার বামপন্থিকে। বন্দি করা হয় অগুনতি মানুষকে। ১৯৬৬ সালে সুকর্ণকে বাধ্য করা হয় সুহার্তোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে। ইন্দোনেমিয়ায় নেমে আসে স্বৈরশাসন। সুহার্তোর একনায়কত্বে দেশটি পরিচালিত হয় ৩২ বছর। এই ৩২ বছর ধরেই চলে বামপন্থিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন। এমনকি সমাজের মনোভাবও বদলে দেয়া হয়। এই বদলের হাত ধরে বদলে যায় রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক চরিত্র, যা আজও বহমান। উদাহারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ইন্দোনেশিয়ার নারীদের পুলিশে ভর্তি হতে হলে কুমারীত্ব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়; বামপন্থিরা বা তাদের উত্তরসূরিরা আজো কোন সরকারি পদ পায় না।
সাম্প্রতিক পুনর্মিলনীর আয়োজকরা বলছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে বিভাজনের সংস্কৃতি বিরাজমান তার অবসান জরুরি। এ বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনের মনোভাব হলো পুরাতন এই ইস্যুটি আর জীবন্ত থাকা উচিৎ নয়। তবে ওই ঘটনার জন্য আনুমানিক ক্ষমা প্রার্থনারও দরকার নেই। এই সন্মিলনীর আয়োজকদের একজনের বাবা ছিলেন ১৯৫৬৫ সালের ৬ জেনারেলের একজন। যাদের সমাজতন্ত্রীরা খুন করেছিল বলে গুজব রটেছিল; যে গুজবের পর শুরু হয় গণহত্যা। সন্মিলনীর আয়োজকরা আরো বলেন, ওই বেদনাদায়ক ইতিহাসকে সম্মিলিতভাবে উন্মোচিত করতে হবে। বের করতে হবে সমাজের কোথায় ভুলের বীজ লুকিয়ে আছে। কেন এই রাষ্ট্র গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। তারা একটি ট্রুথ কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করেছে। ১৯৬৫ সালের গণহত্যার ধরনের দিকে তাকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার ধরনের মিল দেখা যাবে। একদিকে সামরিক বাহিনী ও কট্টর ডানপন্থি ধর্মীয় লেবাসের সংগঠন। অন্যদিকে মুক্তিকামী মানুষ। ইন্দোনেশিয়ায় এখনো ডানপন্থিরা অনেক শক্তিশালী। সরকারের সমর্থনে আয়োজিত এই সন্মিলনী আয়োজনের বিপক্ষে বিক্ষোভ করেছে কয়েকটি সংগঠন ও গোষ্ঠী। আয়োজকদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, তারা ইন্দোনেশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আয়োজন মানবাধিকার গ্রুপগুলো ওই গণহত্যার গোপন দলিল প্রকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ওই সময় ইন্দোনেশিয়া ছিলো সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অনতম বড় মিত্র। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভে রক্ষিত দলিলাদিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জাকার্ত দূতাবাস গণহত্যা সম্পর্কে জানতো। তারা ইন্দোনেশীয় সমাজতন্ত্রীদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। বছরব্যাপী গণহত্যার সময় ওই তালিকা মার্কিনীরা ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করেছিল। এমনকি গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত একটি অংশকে সরঞ্জাম এ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিলো। ইন্দোনেশীয় সমাজ ও রাষ্ট্র যতই কট্টর মনোভাবাপন্ন হোক না কেন। শেষ বিচারে সেখানেও বিচারবোধ সম্পন্ন মানুষের বসবাস আছে। যার উদাহরণ সুহার্তোর পতন এবং শেষ পর্যন্ত ৫১ বছর আগের হৃদয়বিদারক ঘটনার প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানের প্রয়াস। জ্ঞান, সত্য ও সহমর্মীতা হোক ইন্দোনেশীয়দের, চূড়ান্ত অর্থে মানুষের অবলম্বন। তবেই হয়তো ঘৃণার অবসান হবে মানুষের সমাজ থেকে। ওয়েবসাইট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।