Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাণিজ্য ও ঋণের মাধ্যমে বিশ্বে একুশ শতকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে চীন

টাইমস অব ইন্ডিয়া : | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

চীন একুশ শতকের এক বিশেষ সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে। নৌশক্তি বা পদাতিক সেনা নয়, বাণিজ্য ও ঋণ এ সাম্রাজ্য গড়ে দেবে। যদি প্রেসিডেন্ট শি’ জিনপিং-এর উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তব রূপ করতে হয় তাহলে বেইজিং বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জায়গা জুড়ে এক নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে তার অবস্থান শক্তিশালী করবে। ইতিমধ্যেই চীন এক হাজার বছর আগের তাং রাজবংশের সোনালি সময়কে পেরিয়ে এসে আরো বহদূরে তার প্রভাব বিস্তার করেছে।
শি’র পরিকল্পনার সবচেয়ে বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে ২০১৩ সালে তার প্রথম প্রস্তাবিত নয়া সিল্ক রোড। এটিই পরে বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে রূপ নেয়। এটা হচেছ তার পররাষ্ট্র নীতি, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও একটি সুচারু পদ্ধতির মিশেল যার পিছনে রয়েছে চীনের অর্থপ্রবাহ, লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
শি এ মহা উদ্যোগকে ‘শান্তির পথ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যান্য বিশ্বশক্তি সমূহ যেমন জাপান বা যুক্তরাষ্ট্র চীনের ঘোষিত লক্ষ্যের ব্যাপারে সন্দিহান এবং যা বলা হচ্ছে না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে যেগুলোতে সামরিক সম্প্রসারণের ইঙ্গিত মিলছে। বেল্ট অ্যান্ড রোডের বাস্তবতা মূল্যায়নে ব্লমবার্গ বাজার চীনের মহাপরিকল্পনার সম্মুখভাগে থাকা তিনটি মহাদেশের ৫টি নগরে সাংবাদিকদের একটি দল মোতায়েন করেছে।
এতে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা অধিকাংশই দরিদ্র দেশের যারা গত অর্ধ শতকে বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে ছিল পিছিয়ে পড়া। তারা চীনা-অর্থায়িত প্রকল্পগুলোতে ঝঁপিয়ে পড়েছে। তাদের আশা যে তারা এগুলোর মাধ্যমে এগোতে পারবে। কিন্তু চীনা উচ্চমাত্রার প্রকল্প ও তাতে অর্থায়নের ব্যয়ের প্রেক্ষিতে শ্রীলংকার হাম্বানটোটা থেকে গ্রীসের পাইরাউস পর্যন্ত সম্ভাব্য সুবিধা ভোগীরা এর দীর্ঘমেয়াদি মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনা বিনিয়োগের অন্যতম বৃহৎ গ্রহীতা মালয়েশিয়ায় দেশটির নয়া প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ পিছাতে শুরু করেছেন। চীনের ঋণ শর্ত ও স্থানীয় অর্থনীতির লাভ সীমিত করা চীনা শ্রমিকের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি চীনের শত শত কোটি ডলার অর্থায়নে রেল ও পাইপ লাইপ লাইনে থাকা অন্যান্য প্রকল্প আটকে দিয়েছেন।
শি শতাব্দী-দীর্ঘ বাণিজ্যে আগ্রহী। চীন ইতিমধ্যেই আজকের ডলারের পরিমাপের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন মার্শাল প্ল্যানকে ছাড়িয়ে গেছে। মর্গান স্ট্যানলি এস্টিমেট অনুযায়ী চীন ও তার স্থানীয় অংশীদাররা রেলওয়ে, সড়ক, বন্দর ও পাওয়ার গ্রিডে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণ ব্যয় করবে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক ন্যাশনাল ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্চ-এর রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক সিনিয়র ফেলো ন্যাডেজ রোল্যান্ড বলেন, অন্য অর্থে অর্থনৈতিক ধাক্কাই হল কূটনীতি। এটা আজকের জন্য নয়, এটা মধ্য একুশ শতকের চীনের জন্য।
বেল্ট অ্যান্ড রোড চীনের দেশীয় রাজনীতির জন্যও অনেক কিছু। সরকারী ও রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যখন চীনের বাইরে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে তখন শি চীনা কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যয় দেশীয় প্রকল্পগুলোতে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করছেন যা সরাসরি অর্থনীতিকে লাভবান ও তার সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করবে।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো শিকে আসলে উপেক্ষা করছে না, তবে তারা তার সাথে তাদের পরিকল্পনার সামঞ্জস্য বিধান করছে। গত বছর চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সংবিধানে গৃহীত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের প্রেক্ষিতে চীনা কোম্পানিগুলো এটাকে বিদেশী বিনিয়োগ ও পুঁজি পাচার বিষয়ে শি’র বিধিনিষেধ নিরূপণের সাহায্যে ব্যবহার করছে। অনেকেই রাষ্ট্রীয় আনুক‚ল্য পেতে তাদের বিদেশী প্রকল্পগুলোক শি’র পোষা প্রকল্পগুলোর ছাতার নিচে আশ্রয় নিচ্ছেন। হংকঙের র‌্যাবোব্যাংক গ্রুপের আর্থিক বাজার গবেষণার প্রধান মাইকেল এভারি বলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড হচ্ছে এক রাজনৈতিক বিশেষ সস। আপনি যদি এটা কোনো কিছুর উপর ছড়িয়ে দেন তখন তার স্বাদ ভালো হবে।
প্রথমে এ সস এশিয়া ও আফ্রিকার বহু উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুধা মেটাবে। আধুনিক সিল্ক রোডের ধারণা গতি পেলে বেল্ট অ্যান্ড রোড সে সব জায়গা স্পর্শ করবে যেগেিলার কখনোই প্রাচীন কাফেলার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ বছরই তা দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল, এমনকি মেরু অঞ্চলে পৌঁছেছে। জুনে তা মহাকাশেও উৎক্ষিপ্ত হয়েছে। বেইজিং ঘোষণা করেছে যে বেল্ট অ্যান্ড রোড-এ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো চীনের নয়া স্যাটেলাইট -নেভিগেশন সার্ভিসে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে থাকবে।
অধিকাংশ প্রস্তাবিত প্রকল্পই অবকাঠামো ভিত্তিক, যেমন মিয়ানমারে একটি নতুন গভীর সমুদ্র বন্দর ও মালদ্বীপে বিদ্যুত লাইন। কিন্তু প্রায় সব বিদেশী বিনিয়োগই এ উদ্যোগের অংশ হিসেবেই সংযুক্ত হয়ঃ তেহরান অভিমুখী চীনের সূর্যমুখী বীজ বহনকারী মালবাহী ট্রেন, ফিলিপাইনের একটি কৃষিসেচ ব্যবস্থা।
সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্ট ও সমুদ্র পথে সিল্ক রোড উদ্যোগসহ বাণিজ্য পথের ক্রমবর্ধমান জাল এখন ৭৬টি দেশে সম্প্রসারিত। এর অধিকাংশই হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ, সে সাথে ইউরোপের পূর্বপ্রান্তের মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশও আছে। যেহেতু বিশে^র বাণিজ্য চলাচলের অধিকাংশই হয় সমুদ্র পথে তাই আশ্চর্য নয় যে চীনা বিনিয়োগ লাভকারী প্রথম স্থানগুলোর অনেকগুলোই হচ্ছে পাইপলাইন ও অন্যান্য পরিবহন সুবিধা সম্বলিত বন্দর যেগুলো জাহাজ চলাচলকে বাজারের সাথে যুক্তকারী।
বিশেষ করে ভারত মহাসাগরের চারপাশসহ কয়েক ডজন সমুদ্র বন্দর নির্মাণ বা পুননির্মাণ ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লীতে সতর্ক ঘন্টা বাজিয়েছে। এগুলোর কতগুলো ডক চীনা যুদ্ধজাহাজকে স্বাগত জানােবে? ১৯ শতকে ব্রিটেন ও বিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী নৌবাহিনী ও বিশ্বব্যাপী ছড়ানো সামরিক ঘাঁটিগুলো তাদের বাণিজ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই চীনও সাবমেরিন, বিমানবাহী জাহাজ ও যুদ্ধ জাহাজের সমন্বয়ে নৌবহর গড়ে তুলছে যা হবে মার্কিন ক্ষমতার প্রতিদ্ব›দ্বী।
চীন বলেছে যে অন্যায্য রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোডকে ব্যবহারের কোনো উদ্দেশ্য তার নেই। বিভিন্ন দেশের মধ্যে অথনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যেই তার এ উদ্যোগ। ২০১৫ সালে শি জিনপিং বলেছিলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্য হচ্ছে আমরা উন্নয়নের মৌলিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করব, বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা প্রকাশ এবং অর্থনৈতিক একীকরণ অর্জন করব।
এটাই যদি হয় তা হলে শি’র প্রয়োজন হবে পরবর্তী দিনের সিল্ক রোডের ধারে কাছে বসবাসকারী মানুষদের ধারণার পরিবর্তন করা। আর তা হতে পারে শুধু চীনের অর্থ সাম্রাজ্যে রূপন্তর ঘটা নগর ও শহরগুলোতেই।
ইয়ু
ঝেজিয়াং প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় ইয়ু হচ্ছে ‘মেড ইন চায়না’র প্রতিরূপ। এখানকার বাজার অন্য কোনো স্থানের মত নয়। ৫ তলা ভবনের ৬৫০টি ফুটবল মাঠের আয়তনের এক বিশাল কমপ্লেক্সে ৭৫ হাজার বুথ ১৮ লাখ ধরনের পণ্য বিক্রয় করছে। আপনি যদি ডিস্ট্রিক্ট -১ থেকে সস্তা জুয়েলারি ও খেলনা কেনেন তাহলে আপনাকে ডিস্টিক্ট-৫ এ অটো পার্টসের অংশে পৌঁছতে মোটরসাইকেল ট্যাক্সি লাগতে পারে। এবর হাজার হাজার স্টলে অধিকাংশই কোনো বিশেষ একটি দ্রব্যসামগ্রী নির্ভর। যেমন কাঁচি (সিজর্স)।
সাংহাই-এর দক্ষিণপশ্চিমে এক প্রাচীন বাজার শহর ইয়ু এখন ১২ লাখ মানুষের নগরী। বেল্ট অ্যান্ড রোড থেকে ইয়ু বিপুল প্রণোদনা পেয়েছে। বৈরুত থেকে সিউল এবং তার বাইরে থেকেও মানুষ আসে ব্যবসা শুরুর জন্য। এখানে বর্তমানে বিশে^র প্রায় ১৩ হাজার ব্যবসায়ী বাস করছেন। নগরীর কেন্দ্রস্থলে বেটি টার্কিশ রেস্টুরেন্ট ও মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য রফতানিকারী একটি কোম্পানির মালিক জর্দানি ব্যবসায়ী মোহানাদ আলি মোহাম্মদ শালাবি বলেন, প্রতিদিন আরো ব্যবসায়ী আসছেন। তিনি বলেন, আমার রেস্টুরেন্টে এমন সব দেশের মানুষ আসেন যেসব দেশ আমি চিনিও না।
তবে সব সময়ই এ রকম হয় তা নয়। ব্লমবার্গ সাংবাদিক ২০১৪ সালের প্রথমদিকে যখন এ শহরে আসেন সে সময়ের কথা বলেন। তখন ব্যবসার অবস্থা এমন ধীরগতি ছিল যে দোকানিরা অলস সময় কাটাতে কম্পিউটার গেমস খেলত, নয় সংবাদপত্র পড়ত নয়ত চেয়ারে শুয়ে ঘুমাত। ঝেজিয়াং জিংবাও ছাতা কোম্পানির মালিক জেনি ঝাং-এর ২শ’ জন শ্রমিক রয়েছে। তিনি সেই পুরনো খারাপ দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। ২০১৩ সালে ইয়ু প্রায় বিরান ছিল। চীন ১৯৭৮ মালে প্রথম এখানে মার্কেট স্থাপন করে। পাইকারি বিক্রেতা ও উৎপাদকরা উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও আলিবাবার মত অনলাইন মার্কেটপ্লেসের উত্থান নিয়ে চিন্তিত ছিল।
তারপর দেখা দিল আশার আলো। সামাজিক মাধ্যম ও টেলিভিশনে ঝাং একটি মালবাহীী ট্রেন চালুর খবর দেখতে শুরু করলেন যেটি চীন থেকে মধ্য এশিয়ার হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে পশ্চিমে যাবে ও ইউরোপ পৌঁছবে। এটি হচ্ছে শি সরকারের ‘নয়া ইউরেশীয় স্থল সেতু’র অংশ। এ ট্রেনের মালবাহী ওয়াগনগুলো মূলত প্রাচীন যুগের উটের কাফেলার আধুনিক রূপ। ঝাং বলেন, এ রেলপথের প্রভাব ছিল বিশাল। এ রেল সার্ভিস চালু হওয়ার পর আমাদের বিক্রি ও ক্রেতার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ