Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিস্টেম লস হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর সংশ্লিষ্ট মহল

মাহফুজুল হক আনার/এম এ জলিল সরকার দিনাজপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

কে হতে চায় কোটিপতি বাংলাদেশে প্রচারিত টিভি সিরিয়ালের মতই বড় পুকুরিয়া কয়লা খনিতে সিরিয়াল রচনা করেছিল খনির কর্মকর্তারা। তাদের সহযোগিতা করেছিল পেট্রোবাংলা’র উচ্চ পদস্থ কিছু কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতারা। আখের গুছিয়েছেন খনির সাবেক এমডি আমিনুজ্জামান, কোম্পানী সচিব আবুল কাশেম প্রধানিয়াসহ আরো অনেকেই।
অথচ পেট্রোবাংলার অধিনস্থ এই কোল মাইনিং কোম্পানী’র পরিচালনার জন্য একটি পর্ষদ রয়েছে। পর্ষদের বোর্ড মিটিংয়ে কয়লা উৎপাদন থেকে আয় ব্যায় ও বিক্রয় নীতি মালা সবকিছুই পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় এই পর্ষদে। এত সবের পরও খনির কয়লা ইয়ার্ড শুন্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আশ্চর্যজনক ছাড়া আর কি হতে পারে ? পর্ষদের নাকের ডগায় কয়লা’র অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের এক মাত্র তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।
নির্বাচনী বছরে এ ধরনের কেলেঙ্কারীতে বিব্রত আওয়ামী সরকার নড়ে চড়ে উঠলেও কাজের কাজ কতটুকু হচেছ এবং হবে তা নিয়ে গুঞ্জন চলছে সর্বত্র। যদিও তদন্ত কমিটি গঠন, ১৯ জনের বিরুদ্ধে খনি কর্তৃপক্ষের মামলা, দুদকের তদন্ত এতসবের পরেও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না সাধারন মানুষ। কেননা খনিতে তদন্ত কমিটি গঠনের পর থেকেই লুটপাটের সাথে জড়িত মহলটি লুটপাট নয় হয়েছে সিষ্টেম লস প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২০০৫ সাল থেকে দেশের একমাত্র খনিজ সম্পদের খনিটি আলোর মুখ দেখার পর থেকেই এর কার্যক্রম চলছে পেট্রোবাংলার খেয়াল খুশিমত।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলার হলেও কোম্পানী হিসাবে স্বীকৃত খনিটি পরিচালনা’র জন্য সাত সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। এই পর্ষদের সভাপতি হচ্ছে পদাধিকার বলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। অর্থাৎ বাৎসরিক, ত্রৈ-মাসিক যাই হোক না কেন পর্ষদের সভায় কয়লা খনির উৎপাদন, আয়, ব্যায়ের হিসাবসহ কয়লা বিক্রি কর্মকর্তাদের ঝুকি বোনাস, বেতন ভাতা সবকিছুই আলোচনায় আসে। তাহলে নিয়মতান্ত্রিক হলে সিষ্টেম লসের বিষয়টি নিয়ে পর্ষদ বা পেট্রোবাংলা কেন কোন প্রশ্ন তুলেননি। এখানেই শেষ নয় এর আগে দুই কোটি ৯ লক্ষ টাকার তামার তার চুরি হলে এক শ্রমিককে আসামী করে মামলা করা হয়। ঐ সময় খনির কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান হাওলাদারকে দায়ী করা হয়েছিল। এবার লক্ষ টন কয়লা লুটপাটের দায়ে তাকেও আসামী করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন এসে যায় তামার তার উদ্ধার বা ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়ার পরও বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদ কিভাবে হজম করলো?
গত ২০১৬ সালে ব্যাংকের ভুয়া চালান দিয়ে ৩’শ টন কয়লা আরাফাত নামের এক ব্যবসায়ী কয়লা সরবরাহ নিয়ে নেয়। স্থানীয় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা বিষয়টি ধরে ফেললে একদিনের মধ্যেই স্থানীয় জনতা ব্যাংকে ৩’শ টন কয়লা’র সমূদয় টাকা জমা দেয়া হয়। কিন্তু এ নিয়ে কোন মামলা হয়নি?
বিশ্বস্থ একটি সুত্র মতে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির দুর্নীতি পরায়ন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কর্মকর্তারা সরকারের উচ্চ মহলের কাছে যে গল্প রচনা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তা হলো ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের ২৭ জুন পর্যন্ত কয়লা উৎপাদন করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ পদ্ধতিগত লোকসান। যার পরিমান উধাও হয়ে যাওয়া কয়লার সমপরিমান অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন। বলা হচ্ছে ১৩ বছরের এ ঘাটতি। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সময়ের বাৎসরিক রিপোর্ট বলছে অন্য কথা। খনি কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সালের জুন (২০১৪-২০১৫ অর্থবছর) পর্যন্ত মোট কয়লা উৎপাদন হয়েছে ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩৬.৪ মেট্রিক টন। এরমধ্যে পিডিবি’র নিকট ৪৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪.৭৭৩ মেট্রিক টন ও খোলা বাজারে ২১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৬৫.৩০২ মেট্রিক টন কয়লা বিক্রি করা হয় এবং খনির নিজস্ব ব্যবহার হয়েছে ৯ হাজার ৫৮৬.৩২৫ মেট্রিক টন কয়লা। অবশিষ্ট ৩৬ হাজার ২৮৬ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ ছিল যা খনির বাৎসরিক রিপোর্ট দেখানো হয়েছে। যদি ধরে নেওয়া হয় এই ৩৬ হাজার টন কয়লার হিসাব কাগজে কলমে ছিল বাস্তবে ছিল না। তাহলে ৭০ লাখ ৫৮ হাজার টন কয়লায় সিস্টেম লস ৩৬ হাজার টন। এদিকে, ২০১৫-২০১৬, ২০১৬-২০১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ এই তিন অর্থ বছরে উৎপাদন হয়েছে ৩০ লাখ ৪১ হাজার টন কয়লা। এরমধ্যে পিডিবি, খোলা বাজারে বিক্রি ও খনির নিজস্ব ব্যবহার হয়েছে প্রায় ২৯ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। মজুদ থাকার কথা ১ লাখ ০৮ হাজার টন কয়লা। কিন্তু রয়েছে মাত্র ২ হাজার টন। খনির কর্মকর্তারা বলছেন অবশিষ্ট কয়লা পদ্ধতিগত লোকসান। এখানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, খনি কর্তৃপক্ষের হিসেবেই যদি সাড়ে ৭০ লাখ টনে সিস্টেম লস ৩৬ হাজার হয়, তাহলে ৩০ লাখ ৪১ হাজার টনে সিস্টেম লস ১ লাখ ৮ হাজার টন হয় কীভাবে। সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত বিগত তিন বছরে কয়লা উৎপাদন নিয়ে কিছু একটা থাকতে পারে।
তথ্য অনুসন্ধানে যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মজুদ রেখে বিক্রয়যোগ্য কয়লা না থাকার কারনে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে মওসুমের শুরুতে ইট ভাটা মালিকদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। এসময় অজ্ঞাত কারনে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানীতেও ব্যবসায়ীদের অনুৎসাহিত করা হয়। ফলে বাজারে কয়লা সংকট তীব্র আকার ধারন করে। হঠাৎ করেই এসময় মাত্র ৮ হাজার টাকা মেট্রিক টন হিসাবে কেবলমাত্র ট্রেড লাইসেন্সধারীদের ১’শ টন কয়লা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয় পেট্রোবাংলার অনুমতি সাপেক্ষে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি পরিচালনা পর্ষদ। মূলত এই ঘোষনার মাধ্যমে কে হতে চায় কোটিপতির পর্ব। বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি যে ইউনিয়নে অবস্থিত সেই ইউনিয়ন পরিষদে একদিনে ১২’শ ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। ট্রেড লাইসেন্স হাতে নিয়ে একেকজন অর্šÍভুক্ত হওয়ার আবেদন করে। রাজনৈতিক সুপারিশ, মন্ত্রীর ডিও আর খনি’র এমডি’র আশির্বাদ পাওয়া পান ও মুদি দোকানদাররাও এই পর্বের সদস্য হয়ে যায়। ৮ হাজার টাকা মেট্রিক টনের চালান জমা দিয়েই ভাটা মালিক স্থানীয় কয়লা ব্যবসায়ীদের কাছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা মেট্রিক টন হিসাবে কয়লা’র চালান বিক্রি করে দেয়। এই পর্বে স্বামী, স্ত্রী, কন্যা, কন্যা জামাই, ছেলে এমনকি বাসার কাজের মানুষের নামেও ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে কয়লা পাওয়ার কথা সকলের মুখে মুখে আলোচিত হয়েছে। ২০১৩ সালের মে মাসে এমডি হিসাবে আমিনুজ্জামান যোগদান করে ২০১৬ সালে বদলি হয়ে চলে যান। তার সময়ে ঘটেছিল ৩’শ কয়লা ভুয়া চালানে সরবরাহের ঘটনা বলে সংশ্লিষ্ট একটি দাবী করেছেন। আরো লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে লক্ষ টনের বেশী কয়লা লুটপাটের তথ্য প্রকাশ হওয়ার সময় এমডি’র দায়িত্বে থাকা হাবিব উদ্দিন কয়লা খনির শুরু থেকেই চাকুরীরত আছেন। একইভাবে কোম্পানী সচিব আবুল কাশেম প্রধানিয়াও কর্মরত ছিলেন। অসমর্থিত একটি সূত্র মতে সরকারের খুব ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত আবুল কাশেম প্রধানিয়াই ছিল খনি নীতি নির্ধারনের মুখ্য।
অতীতের এসব ঘটনার প্রশ্নের উত্তর পাওয়া লক্ষ টন কয়লা লুটপাটের কিনারা পাওয়া যেতে পারে বলে কয়লা খনির সাথে যুক্ত অনেকেই মত প্রকাশ করেছে। এছাড়া খনিতে কয়লা পাচার বা উধাও হলে কর্মকর্তা কর্মচারী থেকে শুরু করে সকল মিলে ঘটনার সাথে জড়িত হতে হবে। তা হলে কী ম্যানেজমেন্ট, প্রোডাকশন, মেইনটেন্যান্স এন্ড প্রভিসনিং সার্ভিসেস (এমপিএমএন্ডপি) চীনা ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের সাথে খনি কর্তৃপক্ষের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আঁতাতের মাধ্যমে এই বিপুল পরিমান কয়লার টাকা আত্মসাত করা হয়েছে ? এদের বিষয়গুলো ভাবিয়ে দেখা জরুরী হয়ে পড়েছে।
তদন্তে এসেছে উচ্চ পদস্থ একটি দল
দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কয়লা কেলেঙ্কারী তদন্তে এসেছেন চার সদস্যের একটি উচ্চ পদস্থ প্রতিনিধি দল। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে তদন্তে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরর মহাপরিচালক খলিলুর রহমান, পেট্রোবাংলার ডিরেক্টর অপারেশন ও তদন্ত কমিটির প্রধান কমরুজ্জামানসহ ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা খনির অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল।
অপরদিকে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিককেরা কয়লা লুটপাটের প্রতিবাদের কয়লা খনির বাজারের মূল রাস্তায় বেলা ১২টায় একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এছাড়াও তারা চাকুরি স্থায়ীকরনের দাবিও উপস্থাপন করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রতিষ্ঠা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ