Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পারবেন ফিরিয়ে দিতে নিহতদের প্রাণ?

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সহপাঠি, বন্ধু, পরিবার কিংবা সাধারন মানুষ সবারই এক প্রশ্ন, পারবেন কি ফিরিয়ে দিতে নিহতদের প্রান। মালিক ও পরিবহন নেতাদের সেল্টারে থেকে রাজিব, পায়েল, মীম ও আব্দুর রহিমসহ প্রতিদিন কত প্রান নিচ্ছে বেপরোয়া বাস চালকরা? কতজন পঙ্গু হয়ে জীবন যাবপন করছেন এর সঠিক হিসাব কোথাও আছে কি? গতকাল বিমানবন্দর সড়কে বিক্ষোভের সময় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এসব প্রশ্ন করেন কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাদের।
বিমানবন্দর সড়কে বিক্ষোভের সময় শরিফসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর থেতলে যাচ্ছে মুখ। হাত-পা ভেঙে খন্ড খন্ড। কংক্রিটের কালছে বর্ণের রাস্তা লাল রক্তে ভাসছে। এ হলো রাজধানীসহ সারাদেশের চিত্র। কি প্রতিকার করছেন আপনারা। কান্নারত তরুণ-তরুণীদের কয়েকজন ‘ওকে ধর, ওকে ধর’ বলে ফুটপাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। আর অন্য কয়েকজন ক্ষুব্ধ তরুণ উত্তেজিত হয়ে বাস ভাঙচুর করতে ইট ও লাঠি হাতে ছুটে গেল রাস্তায়। ওদের থামাতে পুলিশ পথ আটকালো। এ সময় উত্তেজিত তরুণরা কান্নায় ভেঙে পড়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই বেপরোয়া বাসই আমাদের তরতাজা বন্ধুদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমরা ভাঙচুর করবো না। পারবেন ফিরিয়ে দিতে আমাদের নিষ্পাপ বন্ধু দুটির প্রাণ। আপনার সন্তানকে এভাবে হত্যা করলে আপনি কী করতেন? ওদের প্রশ্ন শুনে পুলিশ কর্মকর্তাও হতবিহ্বল। কর্তব্যের খাতিরে ওদের ভাঙচুর থেকে বিরত থাকতে প্রচেষ্টা করেন তারা। তবে ওই কর্মকর্তাদের মুখে এসময় কষ্টের রেখা ফুটে উঠে।
প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী বলেন, এক বাস দ্রুতগতিতে আরেক বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে সহপাঠীদের চাপা দেয়। নিয়মিত এ পথে যাতায়াত করেন এমন অনেকেই বলেছেন, ওভারব্রিজ থেকে নামার সময় বাসগুলো কে কার আগে যাত্রী তুলবে সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই রাজধানীসহ সারাদেশের রাজপথগুলোতে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ঘট্নায় অভিযুক্ত চালক বা হেল্পারের নিয়োগপত্র কিংবা চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নন জাবালে নূর পরিবহনের চেয়ারম্যান জাকির হোসনে। তবে তিনি পুলিশকে জানান, লাইসেন্স অবশ্যই থাকার কথা। কারণ, লাইসেন্স ছাড়া কোনও চালককে তারা গাড়ি দেন না। জাকির হোসেন বলেন, চালক অপরাধ করেছে। সে জন্যই আমরা তাকে র‌্যাবের হাতে তুলে দিয়েছি। দোষ করে থাকলে তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। আমরা কখনও বেপরোয়া গাড়ি চালানোকে সমর্থন দিই না।
চালক বা হেল্পারকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আসলে তারা তো আমাদের পারমানেন্ট (স্থায়ী) কোনও কর্মচারী না। তারা এই আছে, এই নেই। এই আসে, এই যায়। এজন্য তাদের বিস্তারিত কোনোকিছু রাখা হয় না। তবে চাকরি দেয়ার আগে তাদের একটা সিভি (বায়োডাটা) রাখা হয়। রেজিস্টার খাতায় নাম উল্লেখ রাখা হয়। বিআরটিএ’র তথ্যমতে, জাবালে নূর পরিবহনের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। তিনি সরাসরি কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও নৌমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। পরিবহনটি বছর পঞ্চাশের মো. নান্নু মিয়ার প্রভাবেই সড়কজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে পরিবহন জগতে প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবেও নান্নু মিয়ার পরিচিতি আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবহনের মালিক ও শ্রমিক জানান, আগারগাও, মিরপুর ১০, কালশী, বিশ্বরোড, এয়ারপোর্ট, উত্তরা ও আব্দুল্লাহপুর রুটে জাবালে নূর পরিবহন এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে। বর্তমানে এই রুটে কোম্পানিটির ৫০টির মতো বাস চলছে। বাস মালিক সমিতির বিভিন্ন বৈঠকে এই পরিবহনের চালকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠলেও নৌপরিবহনমন্ত্রীর শ্যালক নান্নু মিয়ার কারণে কেউ উচ্চবাচ্য করেন না।
মহাখালী দক্ষিণ পাড়া এলাকায় বাসচাপায় নিহত হওয়া শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানমের ওরফে মীম বাড়ি।
মীমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম গতকাল বলেন, মেয়ে আমার কলেজে গেলে ওর মায়ের কাছে খবর নেই, সে পৌঁছাইছে কি না। এবার বাড়ি আইলে জিগাই আসছে কি না। ওটা প্রতিদিনের রুটিন আমার। আমি ঢাকা-রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ রুটে একতা পরিবহনের বাস চালাই আজ ২৭ বছর ধইরা। কাইলকে দুইটার সময় আমি বাস নিয়া যাব চাপাই। যাওয়ার আগে ওর মারে কইলাম মেয়ে আইলে আমারে জানাইও। এই কথা কইয়া আমি বাইর হইছি কেবল। হঠাৎ এক ফোন আইল একটার দিকে। একজন কইল আপনার মেয়ে নাই জলদি আসেন। আমি কেমনে যাব কিসে যাব ভাবতে পারতাছিলাম না। পরে বাসে, রিকশায় বনানী পর্যন্ত গেছি। এক মোটরসাইকেল ওয়ালাকে কইলাম ভাই আমার মেয়ে অ্যাকসিডেন্ট করছে আমারে লইয়া যান। এরপর যা দেখলাম তা আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারমু না। গিয়া দেখি আমার মেয়ে আর নাই। জাহাঙ্গীরের চোখে আবার পানি জমে উঠেছে। টিস্যু দিয়ে সেই চোখ মোছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, মা আমার ভালো ছাত্রী ছিল। এসএসসিতে ভালো করছে। এ প্লাস পাইছে টিঅ্যান্ডটি মহিলা ডিগ্রি কলেজ থাইকা। পরে ওই কলেজে ওর ভর্তি হওয়ার খুব ইচ্ছা। এদিকে ভালো কলেজ নাই। অনেক দূর হয় তাও শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি কইরা দিলাম। মেয়েটা খুব খুশি আছিলো। প্রতিদিন কলেজে যায় আসে। আমি খবর নেই ও ঠিকমতো আইছে কি না। একবার গাড়ি নিয়ে আসা যাওয়া করলে ১ হাজার ২৫০ টাকা পাই। অনেক কষ্টের জীবন আমার। ভাড়া দেই. খাবার কিনি। মেয়েকে বুঝতে দেইনাই কষ্টে আছি। শুধু চাইছি মেয়েটা বড় হউক। ওরে নিয়ে কত স্বপ্ন আমার....। এত দিন বাস চালাই কই ফেডারেশনের কেউতো আইল না। মেয়ে মরা বাপ আমি কি কষ্টে আছি কেউ তো খবর নিল না। আমাগো অভিভাবক মন্ত্রী শাহজাহান খান তিনি নাকি আমার মেয়েসহ দুজন মরার কথা বলতে বলতে হাসতে ছিলেন। এই কথা শুইনা আমার দুঃখে বুক ভাইঙ্গা আসছে...। আমি আর বাস চালামু না। যেই বাস আমার মেয়েরে নিয়া গেল। সেই বাস আর ধরুম না আমি। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই। এটাতো দুর্ঘটনা না। পুলিশ আমাকে বলছে মামলা করতে। আমি তো মেয়েরে নিয়া ব্যস্ত। মেয়েরে পোস্টমর্টেম করি নাই। অমনি মাটি দিছি। কি মামলা হইছে জানি না। এখন শুনি দুর্ঘটনা। এটা কেমন দুর্ঘটনা। এটা তো হত্যা, নাকি? আমি কেন সবাই বলব এটা হত্যা।
সেই বাসের চালকসহ ৫ জন গ্রেফতার
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের র‌্যাডিসন হোটেলের বিপরীতে দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেয়া জাবালে নূর পরিবহনের বাসটির চালক মাসুম বিল্লাহকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গতকাল সোমবার তাকে বরগুনা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গতকাল দুপুরে জাবালে নূর পরিবহনের দু’টি বাসের দুই চালক সোহাগ (৩৫) ও জুবায়ের (৩৬) এবং তাদের দুই সহযোগী এনায়েত (৩৮) ও রিপন (৩২)কে গ্রেফতার করা হয়।
র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সরোয়ার বিন কাশেম বলেন, গত শনিবার রাত থেকে একাধিক অভিযানে প্রথমে সোহাগ ও জুবায়েরসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের দেয়া তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বরগুনা থেকে মাসুমকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে বরগুনা থেকে ঢাকায় আনা হচ্ছে। র‌্যাব ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে তিনটি বাস প্রতিযোগিতা করে আগে যাত্রী তোলার চেষ্টা করে। তিনটি বাসই ছিল জাবালে নূর পরিবহনের। ঢাকা মেট্রো ব ১১-৯২৯৭ নম্বরের বাসটি শিক্ষার্থীদের চাপা দিয়েছিল। দুর্ঘটনার সময় ওই বাসটির চালকের আসনে ছিলো মাসুম বিল্লাহ। দুর্ঘটনার পরপরই সে বাস থেকে নেমে পালিয়ে যায়। দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা শুরু হলে রাতেই বরগুনায় চলে যায়। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় র‌্যাব-১-এর একটি দল তার অবস্থান শনাক্তের পর বরগুনা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। গত ২৯ জুলাই রোববার রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে (র‌্যাডিসন হোটেলের উল্টো দিকে) বাসচাপায় রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ সময় আহগত হন ১৪জন শিক্ষার্থী। দুপুর সাড়ে ১২টায় বিমানবন্দর সড়কের বাঁ-পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা জাবালে নূর পরিবহনের ওই বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় ও শতাধিক বাস ভাঙচুর করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।



 

Show all comments
  • Sohel Khan ৩১ জুলাই, ২০১৮, ৩:১২ এএম says : 0
    ঢাকার শহরের স্কুল,কলেজ, ভার্সিটির ছাত্র ছাত্রী সবাই এক হয়ে নামা উচিত, তাহলে কতজন পুলিশ পাঠাতো দেখা যেত
    Total Reply(0) Reply
  • Sarkar Naz ৩১ জুলাই, ২০১৮, ৩:১৫ এএম says : 0
    তোমরা থেমে থেকোনা প্রিয় শিক্ষার্থীরা... আন্দোলন চালিয়ে যাও... প্রয়োজনে তোমাদের ডাকে আমরা'ও রাজপথে অবস্থান করবো... তবু এমন হত্যাকান্ডের সুষ্ঠ বিচার চাই...
    Total Reply(0) Reply
  • Alauddin Babu ৩১ জুলাই, ২০১৮, ৩:১৭ এএম says : 0
    আমি কোন দেশে বাস বুঝতেছি না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিহত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ