Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দৈনন্দিন জীবনে ইখলাছের প্রয়োজনীয়তা

প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফিরোজ আহমাদ

নিয়তের বিশুদ্ধতাই হলো ইখলাছ। যে কোন সৎকর্ম আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে করতে হবে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-খয়রাত, সদকাসহ সকল প্রকার ইবাদত কিংবা ভালো কাজ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্যে আদায় করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে ভাল ফলাফল লাভের জন্যে আল্লাহর উপর তায়াক্কুল করতে হবে। এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যে আসার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। মানুষ কি বলবে, লোকে কি বলবে ও সমাজ কি বলবে এসব বিবেচনায় নিয়ে কোনো সৎ কর্ম আদায় করলে ইবাদত খালেছ তথা বিশুদ্ধ হয় না। লোক দেখানো ইবাদতের নাম হলো রিয়া। আল্লাহ রিয়াকারীকে অপছন্দ করেন। রিয়া প্রদর্শন শয়তানের স্বভাব। কুরআন ও হাদিসে রিয়া অহংকার থেকে দূরে থেকে বিশুদ্ধ তথা খালেছ নিয়তে ইবাদত করা জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, আমিই আপনার কাছে এই কিতাব সত্যসহ নাজিল করেছি; সুতরাং আপনি আল্লাহর ইবাদত করুন তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে। (সুরা যুমার, আয়াত-২)।
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের শুধু এরূপ আদেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে সালাত কায়েম করবে ও জাকাত আদায় করবে। ইহাই সঠিক দিন। (সূরা বায়্যিনাহ, আয়াত-৫)। যে কোন কাজ করতে হলে নিয়তের প্রয়োজন হয়। নিয়তের আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা। ইন্না আমালু বিন নিয়্যাত। নিয়তের উপর ফলাফল নির্ভর করে। তাই ইবাদতের শুরুতে নিয়ত খালেছ হওয়া চাই।
আমল দুই ধরনের। এক. জাহেরী আমল, দুই. বাতেনী আমল। জাহেরী আমল যেমন রোজা, নামাজ, হজ, জাকাত, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি। ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে আমল চার ধরনের। যথা- ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল। ফরয আদায় করা একটি বাধ্যতামূলক আমল। যা সবাইকে সমভাবে পালন করতে হয়। ফরযের পরের স্থানই হলো ওয়াজিব। যা আদায় না করলে গুনাহ হয়। ওয়াজিবের পরের স্থান হলো সুন্নত। কিছু সুন্নত আদায় বাধ্যতামূলক। আর কিছু সুন্নত আদায় করা বাধ্যতামূলক নয়। যেমন ফযরের দুই রাকায়াত সুন্নত নামাজ আদায় করা বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে অযুর পূর্বে মেসওয়াক করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে অযু করার পূর্বে মেসওয়াক করা উত্তম। যে সকল সুন্নত আদায় করা বাধ্যতামূলক নয় ইহা হযরত রাসূল (সঃ) অনেক সময় আদায় করেছেন। তাই আমরা আদায় করি। সুন্নতের পরের স্থান হলো নফল। নফল আদায় করলে সওয়াব পাওয়া যায়। নফল আদায় না করলে গুনাহ হয় না। যেমন- গরিব-দুস্থ ছাত্রকে বই কিনে দেয়া। আর প্রকাশ্যে কিংবা মনে মনে সংকল্প করার সময় দুনিয়াবি কোনো উদ্দেশ্যে থাকতে পারবে না। লোক দেখানো কোনো ভাব থাকতে পারবে না।
কেউ একটি মাহফিলের আয়োজন করল তাই আমাকেও মসজিদের সামনে পাল্টা মাহফিল আয়োজন করতে হবে। এমনটা করলে মাহফিলের আয়োজন স্বার্থক হয় না। আজকাল দেখাদেখি প্রচুর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হয়। অঢেল সম্পদ আছে তাই ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করলাম। মানুষ হাজী সাহেব বলবেন তাই হজ করলাম। নামাজ না পড়লে মানুষ কি বলবে। মা-বাবাকে টাকা-পয়সা না দিলে মানুষ মন্দ বলবে। এসব কাজই হলো ইখলাছের পরিপন্থী।
নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে ইবাদত কবুল হয় না। কোন ব্যক্তি কত রাকায়াত নফল আদায় করেছেন, কতটি নফল রোজা রেখেছেন অথবা কত টাকা দান-সদকা করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা এসব দেখেন না। আল্লাহ দেখেন বান্দার অন্তর। আল্লাহ দেখবেন কি উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করা হয়েছে। কি জন্য দান সদকা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে ইখলাছের গুরুত্ব অনেক। এজন্য বলা হয়েছে সৎ কাজের নিয়ত করাও একটি ইবাদত। ভালো-মন্দ দুটি কাজের জন্য আল্লাহর নিকট দুই ধরনের পুরস্কার রয়েছে। কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি এক অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে (কেয়ামতের দিন) তাও সে দেখতে পাবে আর (ঠিক তেমনি) কোনো মানুষ যদি অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করে তাও সে দেখতে পাবে। (সূরা আল যিলযাল, আয়াত ৭-৮)।
মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে, হযরত রাসূল (সঃ) এরশাদ করেন, যে আল্লাহ পাক তোমাদের কারো চেহারা বা ধনদৌলতের দিকে তাকান না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের হৃদয় ও আমলকে। সূরা আনআমের ১৬০নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, কেউ কোন সৎ কাজ করলে সে তার দশগুণ পাবে আর কেউ যদি অসৎ কাজ করে তবে তাকে তারই প্রতিফল দেয়া হবে আর তাদের প্রতি কোন জুলুম করা হবে না। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত রাসূল (সঃ) এরশাদ করেন, কোন ব্যক্তি যদি কোন ভাল কাজ করার নিয়ত করে কিন্তু ঐ ব্যক্তি যদি কোন সমস্যার কারণে উক্ত কাজ সম্পন্ন করতে পারে নাই তবুও শুধু খালেছ নিয়ত করার ফলে পরিপূর্ণ সওয়াব পেয়ে যাবে। পাক কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন, আল্লাহর কাছে পৌঁছে না ও গুলির গোশত এবং রক্ত (কোরবানির গোশত) বরং তাঁর কাছে পৌঁছে বান্দার (অন্তরের) তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর ভয়। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৭)।
একজন ব্যক্তির মসজিদ কিংবা মাদরাসা নির্মাণ করার মতো অর্থ সম্পদ সামর্থ্য কোনটিই নেই। সামর্থ্য না থাকার পরও শুধু খালেছ নিয়ত করার জন্য আল্লাহ মসজিদ মাদরাসা নির্মাণের সওয়াব বান্দার আমলনামায় দিয়ে থাকেন। নিয়ত খালেছ না হলে আমলের ফজিলত পাওয়া যায় না। দান করলে দান গ্রহীতা খুশি হন। বখশিশ দিলে বখশিশ গ্রহীতা খুশি হন। দাতাকে খেয়াল রাখতে হবে দান গ্রহীতার খুশি হওয়া নয় আল্লাহর খুশি হওয়া বা না হওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে দান করতে হবে। গ্রামের লোক আমাকে দানবীর বলবে। অমুক সাহেব বলে ডাকবেন। এই বিবেচনা নিয়ে দৈনন্দিন জীবনে সৎকর্ম করলে কোনো ফজিলত হবে না।
বরং গুনাহ হবে। দান করার পরও গুনাহগার বলে হাশরের মাঠে দানকারী ব্যক্তি চিহ্নিত হবেন। আমাদের কেউ কেউ পেনশনের টাকায় হজে যাওয়ার সংকল্প করেন। কেউ পেশন পরবর্তী বাপ-দাদার জমিন বিক্রি করে হজে গমণ করেন। কারণ আমাদের দেশে পেনশন কিংবা জমি বিক্রির টাকা বৈধ বলে মনে করা হয়। অথচ অবৈধভাবে উপার্জিত টাকায় বাড়ি গাড়ি ভোগ করছেন। অবৈধভাবে উপার্জিত বাসস্থানে থেকে হজের জন্যে বৈধ টাকা সন্ধান করছেন। এ ধরনের লোক দেখানো ইবাদতের এখন ছড়াছড়ি। হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে লোক দেখানো ইবাদত করা থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ধর্ম ও সুফিবাদ গবেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দৈনন্দিন জীবনে ইখলাছের প্রয়োজনীয়তা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ