Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আগের নৌকা যেদিকে যায় ...

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে : আগের নৌকা যেদিকে যায়, পিছের নৌকাও সেদিকে যায়। ব্যাঞ্জণা অর্থ বাদ দিলে প্রবাদের অর্থ দাড়ায় : প্রথম নৌকা যে পথে যায়, পরবর্তী নৌকা বা নৌকাগুলোও সেপথই অনুসরণ করে। পিঁপড়াদের একটি স্বভাব প্রত্যক্ষ করেছি। অনেকেই হয়তো সেটা লক্ষ্য করে থাকবেন। পিঁপড়ারা যখন সারিবদ্ধভাবে চলে তখন সারির প্রথমে থাকা পিঁপড়াটি যেভাবে যেপথ দিয়ে চলে, পেছনে থাকা সকল পিঁপড়াই হুবহু সেভাবে সেপথ দিয়েই চলে। এতটুকু ব্যতিক্রম করেনা। প্রথম পিঁপড়া বাঁকা পথে চললে অন্যান্য পিঁপড়াও সেই বাঁকা পথই অনুসরণ করে। কোনো পিঁপড়াই সারি থেকে বেরিয়ে এসে সোজা পথে চলে না।
ভূমিকা হিসাবে এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের স্বভাব প্রত্যক্ষ করে। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা দেখেছেন, কিভাবে ওই নির্বাচন হয়েছে এবং সেখানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কি ছিল। অনুরূপভাবে যারা গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন তারাও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অবলোকন করেছেন। এই দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন সর্ব প্রচেষ্টায় সরকারের ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা করেছে এবং সে চেষ্টায় সফল হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভাষায়, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ‘চমৎকার’ নির্বাচনের উদাহরণ হলেও মানুষ দেখেছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোও দেখেছে, এমন কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও জোর-জবরদস্তি নেই যা সে নির্বাচনে না হয়েছে। কিছু কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়া, আগেই ছাপমারা ব্যালট পাওয়া, ব্যালট বইয়ের মুড়িতে সই বা আঙ্গুলের ছাপ না থাকা, সরকারী দলের সংঘবদ্ধ দুরাচার, অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট না থাকা কিংবা তাদের উপস্থিত হতে না দেয়া, ভোটের আগে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ যায়নি।
সঙ্গতকারণেই এ নির্বাচনে নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা হয়। এসব প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনায় প্রশাসন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা হয়, তেমনি নির্বাচন কমিশনের একপেশে আচরণ ও শোচনীয় ব্যর্থতার কথাও তাতে উঠে আসে। এই প্রেক্ষাপটেই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মেয়রপ্রার্থী, নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করেন যে, গাজীপুরের নির্বাচন খুলনার মতো হবে না। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেন, খুলনার নির্বাচন যথাযথভাবে হয়নি। এতে অনেকেই আশ্বস্থ হয়েছিলেন এই ভেবে যে, গাজীপুরে নির্বাচন ঠিকঠাক মতো হবে, কোনো প্রশ্ন থাকবে না, নির্বাচন কমিশন একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবে। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওই আশ্বাস যে কেবলমাত্র কথা কথা ছিল, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের সকলেই একমত, খুলনায় অনিয়ম, দুর্নীতি, দুষ্কৃতি যা হয়েছে, গাজীপুরে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী এবং আগের চেয়ে অনেক নিখুঁতভাবে হয়েছে। খুলনার নির্বাচনকে অনেকে ‘খুলনা মার্কা’ নির্বাচন বলে অভিহিত করলেও তাকে ছাড়িয়ে গেছে গাজীপুরেরর নির্বাচন। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘গাজীপুর মার্কা’ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেউ বলেছেন, নিবিড় প্রশাসনিক ‘ম্যাকানিজমে’র নির্বাচন, কেউ বলেছেন ‘প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন, যেখানে নির্বাচন কমিশন ছিল ‘ক্রীড়নক’মাত্র।
সামনে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কেমন হবে এই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সকলের মনে এখন এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভালো কিছু হবে না। আগের নৌকা যে পথে গেছে, পরের নৌকাগুলোও সেপথেই যাবে। পিঁপড়ার স্বভাবের ব্যতিক্রম হবে না। আসন্ন তিন সিটি কপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষ করে গত বৃহস্পতিবার আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে নির্বাচন কমিশন। যে কোনো নির্বাচনের আগে এ ধরনের বৈঠক বা সভার বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও এখন আর একে কেউ আমলে নেয় না। না নেয়ার কারণ, যা বলা হয়, যে প্রতিশ্রæতি বা আশ্বাস দেয়া হয় তা প্রতিপালন করা হয় না। যথারীতি মতবিনিময় সভা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের কথা শুনেছি। কীভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা যায় তার পরামর্শ দিয়েছি। আমরা আশা করি, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করণীয় তা করা হবে বলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার প্রতিশ্রæতি পাওয়া গেছে। বলা বাহুল্য, মুখের কথা ও প্রতিশ্রæতি পাওয়াই যথেষ্ট নয়, তা বাস্তবায়ন করাটাই আসল কথা। সেটা নির্বাচন কমিশন কতটা করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। এরকম আশাবাদ খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও ব্যক্ত করা হয়েছিল, যার প্রমাণ ও প্রতিফলন কোনোটাই পাওয়া যায়নি।
খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ ও ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার না করার কথা জানিয়েছিল। যদিও সবাই জানে, ওয়ারেন্ট ইস্যু করা কিংবা কাউকে মামলায় আসামী করা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘বায়ে হাত কা খেল’। তারপরও এই অবস্থানে অটল থাকা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবারের বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এরপর নির্বাচন প্রভাবমুক্ত হবে, না প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হবে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে, তার দিকনির্দেশনা অনুসারে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইচ্ছার কাছে নির্বাচন কমিশন নতিস্বীকার করছে। সরকার, সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে চাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন সেভাবেই নির্বাচন করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি সঠিক আছে। তার এ দাবিতে যে প্রকৃত সত্যের প্রতিফলন নেই তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি ঠিকই থাকবে তবে তিন সিটি করপোরেশনে এত অভিযোগ ও বিতÐা কেন? কেন নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শংকা বাড়ছে? তিন সিটি এলাকাতেই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই সক্রিয় ও তৎপর। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিচ্ছে, তল্লাসী চালাচ্ছে এবং গ্রেফতার করছে ঢালাওভাবে। সিলেটে গ্রেফতারকৃত দলীয় নেতাকর্মীদের ছাড়াতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী থানার সামনে অনশন পর্যন্ত করেছেন। রাজশাহীতে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, বাড়ি-বাড়ি অভিযান এবং নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগ ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির তরফে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নতুন তিনটি মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামী ১৭৮ জন। এ পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ২৯ জনকে। বরিশালে নাকি বিএনপির নেতাকর্মীদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ঠিক এভাবেই বাড়ি-বাড়ি তল্লাসী ও গ্রেফতার অভিযানের মাধ্যমে ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ফল কি হয়েছিল, কারো অজানা নেই। দেখা যাচ্ছে, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটে একই ধারা-প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে এবং ভোটের দিন বিএনপির নেতাকর্মীদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ফাঁকা মাঠে একতরফা গোল হয়ে যাবে।
বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঠছাড়া করার জন্য আগের মামলা মোকদ্দমাই যথেষ্ট, তারপরও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য নতুন নতুন মামলা দায়ের করছে। কদিন আগে বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা করা হয়েছে। আসামীর সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। এ থেকে বুঝা যায়। বিএনপির নেতাকর্মীরা কতটা নাজুক অবস্থায় আছে, কতটা ভীতি-আতংকের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বিএনপির অভিযোগই শুধু নয়, পর্যবেক্ষকদেরও ধারণা, এসব মামলার অধিকাংশই হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
যে কোনো নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা, তৎপরতা ও ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোটারদের মধ্যে প্রচার-প্রচরণা চালানোর কাজটি মূলত তারাই করে। বিএনপির নেতাকর্মীদের অবস্থা হয়েছে এমন যে, তারা প্রচার-প্রচারনায় অংশ নিতে পারছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ভয়ে যেমন তারা ভীত-সস্ত্রস্ত, তেমনি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতার আতংকে দিশাহারা। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচন আশা করা যায় না।
অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সংবিধান প্রদত্ত এ দায়িত্ব পালনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে অক্ষম, সেটা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবাহী। পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকদের অনেকে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্নও উঠেছে, যে নির্বাচন কমিশন সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মর্জিমাফিক নির্বাচন করে সেই নির্বাচন কমিশনের দরকার কি? লাগাতার অভিযোগ, সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখে সম্প্রতি অন্যতম নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম দুটি ‘ঐতিহাসিক’ মন্তব্য করেছেন। তার প্রথম মন্তব্যটি হলো : সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সংজ্ঞা নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের যদি কোনো সংজ্ঞাই না থাকে তবে দেশে দেশে নির্বাচন হচ্ছে কোন ভিত্তিতে? যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে জনগণের মতামতভিত্তিক শাসন পরিচালিত হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে। ওই সব দেশেও নির্বাচন কমিশন আছে, যারা নির্বাচন আয়োজন ও অনুষ্ঠানের কাজটি করে থাকে। তাদের নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনা। অর্থাৎ প্রশ্নাতীত নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত। সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সংজ্ঞা নেই, একথা বলে নিজেদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা ঢাকা দেয়া যাবে না। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞা যিনি জানেন না, তার কি নির্বাচন কমিশনার হওয়ার কোনো অধিকার থাকে? তার দ্বিতীয় মন্তব্যটি হলো : কমিশন দেখে নির্বাচন আইনানুগ হয়েছে কিনা। ইসি আইনের মধ্যে থাকতে চায়। আইনানুগ নির্বাচন হলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়। তাকেই প্রশ্ন করতে হয়, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন কি তার অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন শতভাগ আইনানুগ হয়েছে বলে দাবি করতে পারে? সব নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কি আইনের মধ্যে থাকতে পেরেছে? নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র শর্ত কি আইনানুগতা? তার এটাও জানা থাকার কথা, আমাদের দেশে এ যাবৎ কোনো নির্বাচনই বেআইনী ঘোষিত হয়নি। তাই বলে কি সব নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হয়েছে? নজির হিসাবে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যায়। সেই নির্বাচনকে কি তিনি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলবেন? আসলে নির্বাচন কমিশনের ওপরে কর্তৃত্বশীল কোনো সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যদি থাকতো তবে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন অবশ্যই বেআইনী বা বাতিল ঘোষিত হতো। ভাগ্য ভালো যে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দেশে নেই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে ওই রকম প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। কারণ, সেসব দেশে নির্বাচন কমিশনই নির্বাচনের ব্যাপারে সর্বোসর্বা এবং প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিরপেক্ষ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে অতীতের নির্বাচন কমিশনগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে সবই ছিল ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক মনোনিত এবং বাস্তবে ‘দলবাজ’ এবং ‘অনিরপেক্ষ’। ফলে তাদের আয়োজনে ও পরিচালনায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হয়নি। একারণে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা জোরে সোরে উচ্চারিত হয়। এবারও হয়েছিল এবং কিভাবে ও প্রক্রিয়ায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তা কারো অজানা নেই।
দু:খের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে-পরে অনেক অভিযোগ উঠেছে আইন অমান্যের, নির্বাচনী বিধি লংঘনের এবং ভোটে অনিয়ম-কারচুপির। কোনো ব্যাপারেই নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সবক্ষেত্রে ‘বকো আর ঝকো, কানে তুলো’, নীতি অনুসরণ করেছে। দেশেই শুধু নয় আন্তর্জাতিক মহল থেকেও এ ব্যাপারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাকিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট খোলাখুলিভাবেই তার মতামত প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে গালমন্দ করেছে। নির্বাচন কমিশনের তরফেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলতে হয়েছে, তিনি যা বলেছেন তা তার কথা নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরই অভিমত। গত শনিবার বার্নিকাট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনরায় তুলে ধরেছেন। বলেছেন, আগামীতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তিনি খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনিয়মমুক্ত করার আহŸান জানিয়েছেন। সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আলোচনায় বলা হয়েছে, তারা অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়।
প্রশ্ন হলো, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কি দেশ-বিদেশের প্রত্যাশানুগ অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে? বাস্তবতা তা প্রতীয়মান হয় না। অনেকের মতে, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের জন্য শেষ সুযোগ। এই তিনটি নির্বাচন যদি অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত হয়, দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায় তবে নির্বাচন কমিশনের এতদিনের দুর্নাম কিছুটা হলেও হ্রাস পেতে পারে। সর্বমহলে আস্থার একটা ভাব তৈরি হতে পারে। ব্যতিক্রম হলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আর কোনো আস্থা কারো থাকবে না। তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অনেক কিছু করতে হবে। তার অবস্থানকে দ্ব্যর্থহীন ও স্বচ্ছ করতে হবে, দায়িত্ব পালনে দৃঢ়তা ও সাহস দেখাতে হবে। আলামত যা, তাতে এ আশা এখন পর্যন্ত দুরাশাই মনে হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ