Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অস্তিত্বসঙ্কটে মাথাভাঙ্গা

দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে নূরুল আলম বাকু ঃ | প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

প্রতিকুল পরিবেশ, নানা অনিয়ম ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় অস্তিতসংকটে চুয়াডাঙ্গা জেলার একমাত্র স্রোতস্বীনি নদী মাথাভাঙ্গা। এ জেলার নদীর গতি যেমন বিচিত্র তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে এ নদীর নাম হয়েছে চুর্ণী। এ ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল নদী ভৈরব-কপোতাক্ষের প্রাণ হলো এই মাথাভাঙ্গা। মাথাভাঙ্গা নাব্যতা হারানোর সাথে সাথে ভৈরব-কপোতাক্ষের মৃত্যুও ত্বরান্বিত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চল ক্রমান্বয়ে পরিনত হচ্ছে মরুভূমিতে। মাথাভাঙ্গা নদী ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে ভৈরবের উৎসমুখ খুলে দিলেই শাখা কপোতাক্ষসহ এ অঞ্চলের সব নদী হারানো গতি ফিরে পাবে। এ অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিনত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে মৃতপ্রায় এ নদীটি পূণঃখনন এখন সময়ের দাবী ।
জানা গেছে, মাথাভাঙ্গা পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার প্রধান তিন নদীর মধ্যে মাথাভাঙ্গা ছিল মুখ্য। মাথাভাঙ্গা নদীয়ার নদী হিসেবেই পরিচিত। এ নদী একসময় স্রোতস্বিনী ছিল। জনশ্রæতি আছে, বহু আগে উৎসমুখে মুল নদী পদ্মার সাথে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাথা বা মুখ ভেঙ্গে যাওয়ায় নদীর এরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে কোন এক সময় নদীটি হাওলিয়া বা হাওলী নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬২ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলার সাথে কলকাতার রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কলকাতার সাথে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। বড় বড় নৌকায় করে নানরকম পণ্য আনা-নেয়া করা হতো। পদ্মা নদী থেকে জলঙ্গী নদীর উৎপত্তি স্থানের প্রায় ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া ও হাটুভাঙ্গা গ্রামের মাঝ দিয়ে মাথাভাঙ্গা নদী এ জেলায় প্রবেশ করেছে। প্রবেশ করে কিছুদুর আসার পর এ নদীর একটি শাখা বের হয়ে কুমার নদী নামে পুর্বদিকে বয়ে গেছে। মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ২৬টি এবং দামুড়হুদা উপজেলার ১৫টি গ্রাম পেরিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতের নদীয়া জেলায় চুর্ণী নদী নামে প্রবেশ করেছে। এরপর এ জেলার ১০ গ্রাম পেরিয়ে ভাগিরথীর সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মুলতঃ গঙ্গা ও পদ্মা প্রবাহের ওপর এতদাঞ্চলের নদীর নাব্যতা নির্ভরশীল।
১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ভারত গঙ্গার ওপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে এবং ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত ফারাক্কা চালু করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহারের ফলে অব্যাহতভাবে পদ্মার পানি প্রবাহ কমতে থাকে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে মাথাভাঙ্গার ওপরও। সেই থেকে মাথাভাঙ্গায় ক্রমান্বয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে নদীর তলদেশ। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার কারনে মাথাভাঙ্গা এখন মৃতপ্রায় হয়ে খালের আকার ধারন করেছে। ফাল্গুন চৈত্র মাসে নদীর পানি এত কমে যায় যে, কোনো কোনো জায়গায় পানি প্রবাহের উচ্চতা থাকে মাত্র হাঁটু সমান। তারপরও এক শ্রেনির বিবেকহীন মানুষ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে, কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকার করে থাকে। তাতে নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে অকাল মৃত্যু।
নদীতে কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকারের ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, মাছের প্রজনন ঋতু চলছে। বর্তমানে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে কোমর ঘেরার ফলে মাছের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। মাছের বংশ বৃদ্ধিতে এ পদ্ধতি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সরেজমিনে নদীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মাছ শিকারীরা ঘুণি জাল দিয়ে কোমর ঘিরে এমনভাবে মাছ শিকার করছে তাতে মাছের ছোটছোট পোনা থেকে ডিম পর্যন্ত উঠে আসছে। তাতে মাছের মাছের বংশবৃদ্ধিতো দুরের কথা প্রকৃতপক্ষে মাছের বংশ ধ্বংশ হচ্ছে। এ ছাড়াও নদীর দু’ধারে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় তার সাথে অনেক জায়গায় এক শ্রেনির মানুষ দুই পাড়ের মাটি কেটে সমান করে সেখানে নানারকম ফসলের আবাদ করছে। ফলে কিছু মানুষ উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠি। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলতে থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। বিগত কয়েক মেয়াদের সরকারের আমলে বেশ কয়েকবার এ নদী পূনঃখননের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত তার কোন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সুত্রে জানা গেছে, বহু বছর আগে এ নদীতীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি বিশাল জনপদ। এ নদী ঘিরেই এক সময় এ বিশাল জনপদের একটি উল্লে­খযোগ্য অংশ নির্বাহ করতো তাদের জীবন-জীবিকা। এ নদীতে মাছ শিকার করে দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নিজেদের মাছের চাহিদা মেটাতো। অপর দিকে জেলে সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ এ নদীতে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে নদীতে পানি না থাকায় মাছ ধরতে না পেরে অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার অনেকে কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এক সময় এ নদীর পানিই ছিল এ অঞ্চলের নদীতীরের কৃষকদের সেচের একমাত্র অবলম্বন। এ নদীর পানি ব্যাবহার করে কৃষক শুস্ক মৌসুমে নদীর দুই পাড়ের শত শত বিঘা জমিতে নানারকম ফসল ফলাতো। পানি প্রবাহের অভাবে বছরের পর বছর পলি পড়ে বর্তমানে নদী ঐতিহ্য হারিয়ে পরিনত হয়েছে মরা খালে। ফসলের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য শত শত গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও সেসাথে ফসলে সেচ দেয়ার জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে অনবরত পানি তোলার ফলে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। ফলে এলাকা ক্রমান্বয়ে পরিনত হচ্ছে মরুভূমিতে। যার কারনে চুয়াডাঙ্গা জেলায় বেশিরভাগ সময় শীতকালে সর্বনি¤œ ও গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে।
শুষ্ক মৌসুমে যন্ত্রচালিত সেচযন্ত্রেও পানি ঠিকমতো ওঠে না। ফলে ফসল উৎপাদনে সেচের জন্য তুলনামুলকভাবে বেশি খরচ গুনতে হয়। ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুস্ক মৌসুমের আগেই বিল-বাওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা শুকিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে ধ্বংস হচ্ছে এলাকার জীববৈচিত্র। টিউবয়েলে পানি উঠছে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানি স্তর যে হারে নিচে নামছে তাতে হয়তো সেদিন আর বেশি দুরে নয় যেদিন ফসলে সেচের পানির জন্য কৃষককে চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ