হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
এক অন্তহীন সমস্যার নগরী ঢাকা। এই যে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে, বৃষ্টিপাতে ঢাকার অবস্থা কী তা সকলেই দেখছেন। নগরবাসীর এই দুর্ভোগ যেন চিরকালের নিয়তি। এখন তো বড় বড় রাস্তা কেটে প্রায় খাল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যেগুলোর কাজ শেষ হয়েছে, সেগুলোকে কোনো রকমে মাটিচাপা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হলে দেখা যাবে মাটি দেবে একেকটি মৃত্যুকূপে পরিণত হবে। এই যে এতো এতো সংস্কার কাজ দেখানো হচ্ছে, তাতে কি নগরবাসী কোনো সুফল পাচ্ছে? পানিবদ্ধতা থেকে তাদের মুক্তি মিলছে? রাস্তা কেটে যখন বড় বড় বিশাল পাইপ বাসানোর কাজ দেখে তখন তারা মনে মনে খুশি হয় এখন চলতে একটু অসুবিধা হলেও বর্ষায় পানিবদ্ধতা তো কমবে। তাদের এ আশা পূরণ হয় না। যেখানে যেখানে বড় বড় স্যুয়ারেজ পাইপ বসানো হয়, সেখানেই পানিবদ্ধতা দেখা যায়। এ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। তাহলে এত আয়োজন করে মানুষকে ভুগিয়ে বড় বড় পাইপ বসিয়ে কী লাভ হলো? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। এমন অনাচার পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা জানা নেই। ফলে এটি অনেক আগেই বিশ্বের সবচেয়ে অবাসযোগ্য ও অসভ্য নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অথচ এই ঢাকাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশ চলছে। মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা, উন্নয়নের মাপকাঠি এবং যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাÐ একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘টুওয়ার্ড গ্রেট ঢাকা: আ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বৃহত্তর ঢাকা ভৌগোলিকভাবে দেশের ১ শতাংশ জুড়ে আছে। জনসংখ্যার ১০ শতাংশ এবং শহুরে মানুষের ৩৬ শতাংশ এইটুকু জায়গার মধ্যে অবস্থান। রাজধানীর পশ্চিমাংশে এক বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪১ হাজার মানুষ। শহরে গাড়ির গতিবেগ ঘন্টায় ৭ কিলোমিটার। যানজটের কারণে দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ৪৪ শতাংশ এখানে। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের ৮০ শতাংশ কারখানা গড়ে উঠেছে এখানেই। এসব কারণে গাদাগাদি-গিঞ্জি পরিবেশ ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার অগ্রগতি ব্যাহত করছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জিডিপিতে ঢাকার অবদান ২০ শতাংশ। যে ঢাকা এতসব সমস্যা নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এতটা সহায়তা করছে, সে যদি মোটামুটি সচল বা সহনীয় মাত্রায় থাকত, তাহলে অর্থনীতির ভিতটা কত শক্তিশালী হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। অথচ ঢাকাকে সুন্দর করার জন্য যুগ যুগ ধরে কত পরিকল্পনাই না করা হয়েছে। সেসব পরিকল্পনার কথা শুনলে যে চিত্র মানসপটে ভেসে উঠে, তাতে মন ভালো হয়ে যায়। আবার সেসব পরিকল্পনার যখন কিয়দংশও বাস্তবায়ন হতে দেখা না যায়, তখন পুনরায় হতাশা মন গ্রাস করে। ঢাকার উন্নয়ন নিয়ে নগরবাসী অনেক বড় বড় পরিকল্পনার কথা শুনেছে। এসব ঘোষণা যে পরিকল্পনার মধ্যেই থেকে গেছে, তা ঢাকা নগরীর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ঢাকার এই শোচনীয় অবস্থার মধ্যেই নতুন কাঠামো পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট মেয়াদন্তে রুটিন মাফিক একটা নতুন পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে হয়। বছর কয়েক আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় রাজউক ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি ‘নগর উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় একটি খসড়া পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল দেড় কোটি, ২০৩৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৬০ লাখ। এই জনসংখ্যা বিবেচনা করেই সেবা সংস্থাগুলোর প্রসার ও বিন্যাসের কথা চিন্তা করা হয়েছে। পরিকল্পনায় পুরো ঢাকা মহানগরকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরকে কেন্দ্র করে প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন স্তরের নগর কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এর মধ্যে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে উঠবে আরও পাঁচটি অঞ্চল। এগুলো হলো গাজীপুর সদর উপজেলা নিয়ে উত্তরাঞ্চল, রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ নিয়ে পূর্বাঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর ও সোনারগাঁ নিয়ে দক্ষিণাঞ্চল, কেরাণীগঞ্জ নিয়ে হবে দক্ষিণ-পশ্চিমা এবং সাভার এলাকা নিয়ে হবে পশ্চিমাঞ্চল। পরিকল্পনায় চারটি সিটি করপোরেশন যেমন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরস্থ পাঁচটি পৌরসভা এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার ৭০টি ইউনিয়ন পরিষদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ঢাকা নগরীর আয়তন কত হবে তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ‘সিটি করপোরেশনের এলাকা আছে, আছে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন প্রকল্পের এলাকা, অবার রাজউকের নির্ধারিত এলাকাও আছে, তাহলে কোনটাকে ঢাকা বলব? আমরা জানি, ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। সংবিধানেও আছে ঢাকা রাজধানী। তাহলে সেই রাজধানী কোনটা। সেটা কত বড়, কত লোক সেখানে থাকে। আগে ধরা হতো রাজউকের এলাকাটাই ঢাকা। এখন রাজউকের মানচিত্রে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরও ঢুকে পড়েছে। তাহলে কি নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরও ঢাকা? যৌক্তিকভাবেই এসব প্রশ্ন এসে যায়। কারণ রাজধানীর সীমানাই যদি জানা না থাকে, তাহলে কোনটিকে রাজধানী বলা হবে। ঢাকার সাথে আশপাশের আরও জেলা যদি একের পর এক যুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে তো গোটা দেশই একটা সময় রাজধানীর আওতাভুক্ত হয়ে পড়বে। রাজউকের খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর আয়তন হবে ১৬২৪ বর্গকিলোমিটার। ভবিষ্যতে যে এর আয়তন বাড়বে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে?
দুই.
কল্পণাপ্রবণ হয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে পরিকল্পনা করা সহজ। তবে এর বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন ও জটিল। ঢাকাকে নিয়ে এ পর্যন্ত যত উন্নয়নমূলক একাধিক পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনায় অনেক সুন্দর সুন্দর প্রস্তাবনা ছিল। সেসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাস্তবে খুব কমই দেখা গেছে। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হতো, তবে ঢাকার বর্তমান এই দুরবস্থা কিছুটা হলেও লাঘব হতো। দুঃখের বিষয়, বর্তমান অবস্থা দেখে যে কারো সন্দেহ জাগতে পারে, ঢাকা নিয়ে কখনো পরিকল্পনা করা হয়েছে কিনা। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকার উন্নয়নে প্রথম মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ১৯৬০ সালে। সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে ২০ বছর মেয়াদের পরিকল্পনা নেয়া হয়। আগামী বছর এই মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার কী উন্নয়ন হয়েছে, তা বোধকরি নগরবাসী জানেন। আবারও ২০ বছর সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বরাবরের মতো এ পরিকল্পনাতেও আকর্ষণীয় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নগর এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ঐসব অঞ্চলে নাগরিক ও কর্মসংস্থানের সুবিধা বিবেন্দ্রীকরণ করা হবে। ঢাকা শহরে দ্রæতগামী পরিবহণসুবিধা থাকবে। চারদিকে থাকবে বৃত্তাকার সড়ক। মূল শহরের সঙ্গে অঞ্চলগুলোর সংযোগও থাকবে। ভূমি স্বল্পতাকে বিবেচনায় নিয়ে এসব পরিকল্পনা করা হবে। শহরের চারপাশে থাকবে বিশেষায়িত জোন। ট্রানজিট স্টেশনকে কেন্দ্র করে কর্মক্ষেত্রের চারপাশে মানুষের বসতির সুযোগ থাকবে। প্লটের পরিবর্তে বøক হাউজিং গুরুত্ব দেয়া হবে। নদী, খাল, জলাশয়, সংরক্ষণা ও পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখা হবে। এসব পরিকল্পনার কথা শুনলে যে কারও মনে কোনো বেসরকারী আবাসন কোম্পানির আকর্ষণীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপনচিত্র ভেসে উঠতে পারে। খসড়া পরিকল্পনায় কেবল রাজধানীকে প্রসারের ওপর গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজধানীর বিদ্যমান মহাসমস্যাগুলোর ওপর তেমন কোনো আলোকপাত করা হয়নি। এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হবে, তার কোনো দিক নির্দেশনা নেই। রাজধানী যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে রয়েছে, তার কিভাবে সমাধান হবে, তারও কোনো পরিকল্পনা নেই। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য বন্যা হলে ঢাকার ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যাবে। বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ঢাকার ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭৮ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্প হলে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তারা বলছেন, প্রতিদিনই ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। আগামী কয়েক দশকে এই চাপ আরও বাড়বে। অপরিকল্পিত ভবন, অবকাঠামো নির্মাণ, জনসংখ্যার আধিক্য বিশ্বের অন্য বড় শহরের তুলনায় ঢাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট তৈরি এসব ঝুঁকির কারণে বিপুল প্রাণহানি ঘটতে পারে। নতুন পরিকল্পনায় এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ঢাকার নতুন কাঠামো পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মেয়র ও বিশেষজ্ঞরা এ পরিকল্পনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, এ পরিকল্পনা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে এ পরিকল্পনা বাস্তবমুখী নয়। ঢাকার সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে রাজউকের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের যে সমন্বয় প্রয়োজন, তার প্রতিফলন এখানে নেই। গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আগে যারা ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন, তারা আসলে জায়গাটিই দেখেননি। এভাবে ঘরে বসে লাইন টেনে পরিকল্পনা করলে হবে না। সবার মতামতের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে বাস্তবসম্মত পরিকল্পন তৈরি করতে হবে। তার এ বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, নতুন পরিকল্পনার বিষয়টি যে যথাযথ হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিন.
ঢাকার সীমাহীন সমস্যা নিয়ে বহু লেখালেখি ও বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। তবে এসব মতামত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুব একটা আমলে নেয় না। তারা তাদের মতো করেই কাজ করে যাচ্ছেÑহোক সেটা পরিকল্পিত কিংবা অপরিকল্পিত। তাদের কর্মকাÐ নগরবাসীর উপকারের পরিবর্তে বছরের পর বছর ভোগান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। যে যানজটে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, তার সাথে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীন ও অসময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি যুক্ত হয়ে এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে। এমনিতেই রাজধানীর ৮০ শতাংশ সড়ক সরু ও অপরিকল্পিত। তার উপর যদি বছরের পর বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলে, তবে নগরবাসীর যন্ত্রণা কমার কোন কারণ থাকতে পারে না। যানজটের প্রধান কারণ সম্পর্কে নগরবিদরা বলছেন, পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়কের সংযোগ না থাকা, রিং রোডের অনুপস্থিতি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ প্রযুক্তির অভাব, পার্কিংয়ে কোনো শৃঙ্খলা না থাকা। এর পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে অসঙ্গতি যুক্ত হচ্ছে। যানজট সমস্যার সাথে বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিয়ে বহু ধরনের কথা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাজধানীতে ৬০ শতাংশ এলাকায় ওয়াসার কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। কোনো দেশের মেগাসিটিতে ড্রেনেজ সিস্টেম এমন হতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। ৪২-৪৩ বছর ধরে কাজ করা ওয়াসা কী করল, তাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করতে না পারুক, রাজধানীতে প্রাকৃতিক যেসব খাল, পুকুর ছিল নিদেনপক্ষে সেগুলো তো সংরক্ষণ ও সংস্কার করতে পারত। এ কাজটি করতে পারলে রাজধানীতে পানিবদ্ধতা বলে কিছু থাকত না। ওয়াসার হিসাব মতেই রাজধানীতে ৪৩টি খাল ছিল। এর মধ্যে ১৭টির কোনো খোঁজ নেই। বাকি ২৬টি খালের ৫টি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে নিয়েছে অসাধু চক্র। কী তাজ্জব কথা! ওয়াসার সম্পদ দখল-বেদখল হয়ে যাচ্ছে, আর তারা তা রক্ষা করতে পারছে না। দখল হয়ে যাওয়া খালও উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাহলে এমন সংস্থা আছে কি জন্য? অন্তত দখল হয়ে যাওয়া একটি খাল উদ্ধার ও বিদ্যমান খালগুলোর যথাযথ সংস্কারের উদ্যোগ নিলে পানিবদ্ধতা অনেকটাই কমে যেত। এ কাজটি কেন তারা করছে না? শুধু খালই নয়, রাজধানীতে এক সময় অনেক পুকুর ছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে পুকুরের সংখ্যা ১৯৮৫ সালে ছিল ২ হাজার। এখন সরকারি হিসেবে আছে মাত্র ২০০। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা একশ’র বেশি হবে না। এসব পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার অভাবে নগরীর পুকুর ও জলাশয় হারিয়ে গেছে। নগর উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা এবং সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতার কারণে দখল বন্ধ করা যাচ্ছে না। নগর পরিকল্পনা করলেও পুকুর জলাশয় রক্ষায় কোনো পরিকল্পনা নেই। এ ধরনের পরিকল্পনা না থাকায়, কোথাও আগুন লাগলে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। গত ৭ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০ মিটারের বেশি নেমে গেছে। প্রতিবছর এ স্তর ২.৮১ মিটার করে কমছে। এর ফলে মাটির স্তর দেবে যাচ্ছে এবং ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের কোনো পদক্ষেপের কথা নতুন পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে না।
চার.
নগর উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় যে পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, নাকি কেবল পরিকল্পনার মধ্যে সমীমাবদ্ধ থাকছে, তা নিয়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। কারণ আগে বিভিন্ন মেয়াদী যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেগুলো কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, এ ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, রাজধানীবাসীর দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগ নিয়ে কোনো সংস্থাকেই দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায় না। নতুন পরিকল্পনা পেশ করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তা জনগণকে জানায় না। ফলে ক্ষুদ্ধ হয়ে এক সময় ঢাকা উত্তরের মেয়র মরহুম আনিসুল হক রাজউকের উদ্দেশে বলেছিলেন, নতুন যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটি কবে বাস্তবায়ন হবে, তা আগে ঠিক করেন। নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রশ্ন তুলেছিলেন, আমরা কি শুধু পরিকল্পনা করব, নাকি পরিকল্পনার দ্রæত বাস্তবায়ন করব? কোনটা আগে? বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব মন্তব্য ও প্রশ্ন উঠত না, যদি পরিকল্পনাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হতো। দিন দিন রাজধানী যে বসবাসের অযোগ্য ও অচলাবস্থার দিকে যাচ্ছে, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কেবল পরিকল্পনা করে বসে থাকলে হবে না, এর দ্রæত বাস্তবায়ন করা যে অপরিহার্য, এ বোধটুকু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে জাগে না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ৫৫টি প্রতিষ্ঠান দুর্বল, তাদের কাজের সমন্বয়ের কৌশলও অকার্যকর। ঢাকার উন্নয়নের জন্য যেসব পরিকল্পনা অতীতে হয়েছে, সেগুলো আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। ভাবা যায়, এতগুলো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থাকা সত্তে¡ও রাজধানীর উন্নয়ন বলতে কিছু হচ্ছে না? তাহলে তো এসব প্রতিষ্ঠান থাকা না থাকা সমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন ঘটালে এই শহর বসবাসের উপযুক্ত হবে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে তিনটি কাজ করতে হবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথমত, বন্যা সমস্যা মোকাবিলার জন্য বালূ নদের পূর্ব পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঘিঞ্জি পরিবেশ এড়াতে সড়ক ও পরিবহনব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আকর্ষণ করার জন্য শক্ত নীতি-পরিকল্পনার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ৫০ লাখ মানুষ শহরে সুস্থভাবে বসবাস করতে পারবে এবং ১৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নগরবিদসহ বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে অনেক কার্যকর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছেন। তবে তাদের এসব পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আমলে নেয় বলে মনে হয় না। আমলে নিলে ঢাকার অনেক সমস্যারই সমাধান হতো এবং কিছুটা হলেও বাসযোগ্য হয়ে উঠত।
darpan.journalist@gmail,com
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।