Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গ্রাহক ঠকানোর ফন্দি

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

আমানত ও ঋণের সুদহার কমাতে বিএবি’র চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিপাকে ব্যাংক ও গ্রাহকরা। ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা এখনই সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। আর তাই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অপরদিকে ঋণের সুদহার কমানোর অযুহাতে আমানতের সুদহার অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে আনায় গ্রাহকরা বিপাকে পড়েছেন। যদিও চলতি মাসের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া নতুন সুদহার বাস্তবায়ন করা অধিকাংশ ব্যাংকের জন্য কষ্টসাধ্য বলে জানা গেছে। কারণ অনেক ব্যাংকে এখনও তারল্য সঙ্কট বিদ্যমান। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বেসরকারি ব্যাংকে টাকা রাখছে না। ব্যাংকগুলো এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে গ্রাহক আমানত তুলে নেবে। এতে নতুন করে তারল্য সঙ্কট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
সুত্র মতে, বিএবি’র আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশের সিদ্ধান্তের সময়ও তারল্য সঙ্কটে থাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলো এতোদিন গ্রাহকের কাছ থেকে উচ্চ সুদে আমানত গ্রহণের প্রতিযোগিতা করে। উচ্চ সুদের প্রলোভনে আমানত সংগ্রহ করে এখন তা হঠাৎ করে অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে এনেছে। অনেকেই বিষয়টিকে আমানতকারীকে ঠকানোর একটি ফন্দি হিসেবে দেখছেন। আবার কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রেখে বাস্তবে ভিন্ন রেখে ফাঁকিবাজির আশ্রয় বলছেন।
সূত্র মতে, নির্বাচনের বছরে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অতপর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সুদের হার কমানোর ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নেতারা। ব্যাংক মালিকদের এমন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক শীর্ষ ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এটা ব্যাংক মালিকদের কাজ নয়। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বিশ্বের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করে দিতে পারে না। বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা বাজার অর্থনীতির উল্টো পথে চলা। একই সঙ্গে এটা এক ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মতো হয়ে গেল বলেও উল্লেখ করেছেন তারা। এভাবে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে অনেক ব্যাংক, বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো আর্থিক ক্ষতিতে পড়তে পারে।
একাধিক শীর্ষ ব্যাংকারদের মতে, এখন সুদহার কমানোর ঘোষণা এসেছে পরবর্তীতে হয়তো সুদহার বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়ে বসতে পারেন মালিকরা। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আইনে থাকুক আর না থাকুক, অর্থনীতির জন্য তা ইতিবাচক নয়। অথচ কিছুদিন আগেও তারল্য সংকটের কারণে উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহের কথা বলে ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। কয়েকদিন আগেও গ্রাহক ভাগানো নিয়ে এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের বিবাদেরও ঘটনা আছে। এর আগেও সুদ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিলেও তা মানা হয়নি। তাই শঙ্কা থেকে যায়, মালিকরা যখন প্রয়োজন মনে করবেন, তখন হয়তো সুদহার বাড়িয়ে দেবেন। তারাই যদি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজন কী? অনেকেরই আশঙ্কা বিএবি’র এ সিদ্ধান্ত শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবন্ধ থাকবে, বাস্তবে সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এই পরিবর্তনটা হয়তো খুবই সাময়িক। কয়েকদিন পর আবার অন্য চিত্রও দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদহার দুই শতাংশেরও নিচে নামিয়ে এনেছিল। এ পরিস্থিতিতে গত ফেব্রুয়ারি থেকে আমানতের সুদহার বাড়ায় আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হন। আর বহুদিন পর ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে মূল্যায়ন পেয়ে ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহিত হচ্ছিল তারা। আমানতের সুদহার বাড়ায় খুশি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকও। শুধু গ্রাহক নয়, বরং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমানতের এ সংকটকে কাজে লাগিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও। কয়েকদিন আগেও মেয়াদি আমানতের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ১০ শতাংশের বেশি সুদ চেয়েছে এ ব্যাংকগুলো। কিন্ত হঠাৎ করে বিএবি’র ঘোষণা সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে।
তারল্য সংকট পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল কথা হয় একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে। প্রত্যেকেই বলছেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট এখনও বিদ্যমান। দুই অংকের সুদহার প্রস্তাব করেও গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই আমানতের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত এক ধরনের আত্মঘাতি। ব্যাংকের গ্রাহক আকৃষ্ট করার মতো কিছুই থাকলো না। এ অবস্থায় গ্রাহকরা আমানত তুলে নিলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের উদ্বৃত্ত টাকা অন্য ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা রাখে। এর বিপরীতে ৫-৭ শতাংশ সুদ পেয়ে আসছিল জমা রাখা ব্যাংকগুলো। কিন্ত কয়েক মাস থেকে আমানতের তীব্র সংকট তৈরি হওয়ায় এখন ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংককে ধার দেয়া আমানত তুলে নেয়। ফলে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত কম পাওয়া ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
প্রাইভেট ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৬ শতাংশ সুদে আমানতকারীরা বেসরকারি ব্যাংকে সঞ্চয় রাখতে ইচ্ছুক নন। এই নির্দেশনা মানা হলে কয়েকমাস থেকে বেসরকারি ব্যাংকের চলমান তারল্য সংকট আরো ঘনীভূত হবে। তিনি বলেন, বাড়তি সুদের অফার দিয়েও যেখানে কয়েকদিন আগে আমানত পাওয়া কষ্টসাধ্য ছিলো। সেখানে এক লাফে অর্ধেকেরও কম রেটেতো সম্ভবই নয়। কারণ হঠাৎ করে এ ধরণের সিদ্ধান্তে গ্রাহকদের মাথায় হাত। এমনিতেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে গ্রাহকরা আস্থা সঙ্কটে ব্যাংকবিমূখ। এছাড়া নেই গ্রাহক আকর্ষণের মতো কোন কার্যক্রম। তাই আবারও ব্যাংকে তারল্য সঙ্কটের আশঙ্কা করেন এই কর্মকর্তা।
আমানতরে সুদহার কমায় অনেক গ্রাহকই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কিভাবে পরিবার চালাবেন। কারণ মাস শেষে অনেকেই আমানতের সুদ দিয়ে পরিবার নির্বাহ করতেন। সাঈদ হোসেন এবং নেসার উদ্দিন নামে দুই আমানতকারী জানান, আমানতের সুদহার কমায় এখন সঞ্চয়পত্রে নাকি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের রাজধানীর একটি শাখা ব্যবস্থাপক জানান, আমানতের সুদের হার কমানোর ঘোষণা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ গ্রাহকদের ১৩/১৪ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা বলে আমরা আমানত নিচ্ছিলাম। তাই বিএবি’র আমানতের সুদহার ছয় শতাংশের ঘোষণা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
যদিও পূবালী ব্যাংকের এমডি আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, গ্রাহকের কাছ থেকে আগের নেয়া আমানতে সুদহারের কোনও পরিবর্তন হবে না। ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে হলে আগের চুক্তি অনুযায়ী আমানতের সুদ দিতে হবে। এদিকে এখন থেকে ছয় শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করবে বেসরকারী ব্যাংকগুলো। এর বাইরে ছয় শতাংশ সুদে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পড়ে থাকা অলস টাকা (বিভিন্ন বন্ডে রাখা স্বল্প সুদের বিনিয়োগ) এবং বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আমানতও পাবে। এসব আমানত দিয়ে যে তহবিল গঠন হবে, সেখান থেকে নতুন গ্রাহকদের নয় শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, সুদহার কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলো নিজেরাই নেবে। সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার কমিয়ে আনতে গিয়ে যদি কোনও ব্যাংক সমস্যায় পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের যতটুকু সম্ভব সহায়তা করবে।
জানা গেছে, এখনই সব ঋণে সুদহার নয় শতাংশে নামবে না। প্রথম পর্যায়ে সব ব্যাংক শিল্প ঋণে নয় শতাংশ সুদ কার্যকর করবে। পর্যায়ক্রমে ভোক্তা ঋণ, এসএমই, ক্রেডিট কার্ডসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সুদহার নামিয়ে আনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমানতের সুদহার কমায় গ্রাহকরা বিপাকে পড়বে। কারণ আমাদের বন্ড ব্যবস্থা ভালো না যে গ্রাহক সেখানে বিনিয়োগ করবে। অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। আমাদের শেয়ারবাজারের অস্থিরতা তাই গ্রাহকদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগেরও সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সুদহার কমানো হয়েছে বলেছে বিএবি। এ প্রসঙ্গে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা ঠিক বলেনি। প্রধানমন্ত্রী হয়তো সুদের হার কমানোর অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে বিএবি একটি সংগঠন। তারা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রকও নয়; সুদহার তারা কোনভাবেই ঘোষণা করতে পারে না। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ সঙ্কেত।
সার্বিক বিষয়ে বিএবি’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারের সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে কল ও এসএমএস দিলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।



 

Show all comments
  • পাবেল ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৫৫ এএম says : 0
    এ সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • নাবিলা ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৫৫ এএম says : 0
    এটা দেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ সঙ্কেত।
    Total Reply(0) Reply
  • রিয়াজ ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৫৫ এএম says : 0
    গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত কম পাওয়া ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে
    Total Reply(0) Reply
  • লাভলু ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৫৬ এএম says : 0
    এটা এক ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মতো হয়ে গেল
    Total Reply(0) Reply
  • মারুফ ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৫৭ এএম says : 0
    বাজারে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে কম সুদে আমানত পাওয়া কঠিন হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • বাবুল ৯ জুলাই, ২০১৮, ৩:৫৮ এএম says : 0
    দেশে ভয়াবহ বেকার সমস্যা দূর করতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ঋণের সুদের হার অনেক আগেই সিঙ্গেল ডিজিটে আনা প্রয়োজন ছিল।
    Total Reply(0) Reply
  • Babul ৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:১৯ পিএম says : 0
    Good News for Daily Inqilab. This is reality....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ