হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
সাধারণ মানুষ এখন মহাবিপদে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা, বিতাড়িত করার অপসংস্কৃতি অব্যাহতভাবে চলছে। এতে সচেতন ও সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। আপাত শান্ত রাজনীতি যে আর কয়েক মাস পর অশান্ত হয়ে উঠতে পারে, এ ব্যাপারে তারা অনেকটাই নিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক দমন-পীড়নের শিকার প্রধান বিরোধী দল যে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হবে তা মোটামুটি সবাই জানেন। এর ফলে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে। জীবন ক্ষয় হবে। এ শঙ্কায় এখন থেকেই সাধারণ মানুষ শঙ্কিত। ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়া নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে যে এক ধরনের কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি হবে, তা অনুমাণ করা লাগে না। এর ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। এটাই যেন তাদের নিয়তি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোন ভ্রæক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। ‘মাইট মেইকস রাইট’ গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের এই উক্তি বাস্তবায়নে তারা বদ্ধপরিকর। তাদের আচরণে এখন এটা স্পষ্ট, তারা চাচ্ছে, যে কোনো উপায়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে হবে। লোক দেখানো ভোটের আয়োজন এবং তা যতই বিতর্কিত হোক, তার মাধ্যমেই ক্ষমতায় থাকতে হবে। ক্ষমতাসীন দল এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও আচরণের দিক থেকে একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলকে কোনো ধরনের স্পেস দিচ্ছে না। এই যে খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলো, তাতে একটি বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দল এক নতুন স্টাইলে মানুষকে নির্বাচন দেখিয়ে বিজয় নিশ্চিত করেছে। এ নিয়ে সমালোচনায় তারা কান দিচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ জুলাই যে তিন সিটি কর্পোরেশন যথাক্রমে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতেও একই চিত্র দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের আগে হারতে চাচ্ছে না। প্রশাসনকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে এবং ভোটের মাঠ থেকে প্রধান বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিতাড়নের মাধ্যমে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার ধারা অব্যাহত রাখতে চাচ্ছে। বলা যায়, ক্ষমতাসীন দল জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব নির্বাচনকে রিহার্সেল হিসেবে নিয়েছে। এর লক্ষ্য স্পষ্ট, জাতীয় নির্বাচনেও প্রশাসনের সহায়তায় লোকদেখানো বা নামকাওয়াস্তে অভিনব কায়দায় বিরোধী দলকে মাঠ থেকে বিতাড়িত করে বিজয় নিশ্চিত কর। এটা গণতন্ত্রের জন্য যে এক মহা অশনি সংকেত তা ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা তাদের মতামতে প্রকাশ করেছেন। অথচ ক্ষমতাসীন দল এই প্রক্রিয়াকেই গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করছে।
দুই.
বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ টেনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বলছে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানোর জন্য তারা কাজ করছে। এটা যে এক ধরনের প্রহসন, তা সচেতন মানুষ মাত্রই বোঝেন। গত শনিবার বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম চট্টগ্রামে এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, দেশ ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছে। দেশে এখন গণতন্ত্রহীনতা, সা¤্রাজ্যবাদ ও লুটপাটতন্ত্র বিদ্যমান। তিনি বলেন, ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল পাকিস্তানের গোলামি থেকে বাঁচতে। তার মানে এই নয়, আমরা আমেরিকা বা ভারতের দাসত্ব করব। তিনি গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এ নির্বাচন দুটি যেন পি সি সরকারের জাদুকরি প্রহসনের মতো। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে গণতন্ত্র এবং সার্বিক পরিস্থিতি কী! এর বিপরীতে ক্ষমতাসীন দল তার মতো করে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে এবং দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের যে চিরকালের রীতিনীতি তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছে এবং তাই জনগণকে জোর করে মেনে নিতে বাধ্য করছে। গণতন্ত্রে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, সুশাসন, অন্যের মত পছন্দ না হলেও শ্রদ্ধা পোষণ করতে হয়, তার ন্যূনতম নমুনা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যায়, প্রবল শক্তি ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতি এবং মানুষের মতামতকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কথা বাদই দেয়া যাক, এই যে গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবীদারদের যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেছে, এর মাধ্যমেই বোঝা যায় ক্ষমতাসীন দল কোনোভাবেই কারো স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে দিতে রাজী নয়। ক্ষমতাসীন দলের এই যে অসহিষ্ণু ও নিষ্ঠুর আচরণ তা খুব কম দেশেই দেখা যায়। অথচ তার মন্ত্রী-এমপিরা গণতন্ত্রের কথা উচ্চস্বরে বলে যাচ্ছেন। এ থেকে এটা মনে হতে পারে, ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্র কী, তা জানে না। জানলেও তা পালন করছে না। একরোখা মনোভাব নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো দেশ শাসন করে চলেছে। সেবক নয় শাসকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রের রীতি-নীতিই হচ্ছে, সব দলের রাজনৈতিক অধিকার, পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এবং সমঝোতা নিশ্চিত করা। সরকারি দলের দায়িত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিরোধী দলের সাথে পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়া সৃষ্টি করা। সে তা করেনি, করতে চেষ্টা করেনি এবং করবে বলেও মনে হয় না। সে প্রতিটি নির্বাচন ফাঁকতালে পার হতে চায়। গণতান্ত্রিক ধারার দেশে গণতন্ত্রকে এভাবে গিনিপিগে পরিণত করার নজির আর কোনো দেশে আছে কিনা, তা জানা নেই। এমন পরিস্থিতির মুক্তি কীভাবে ঘটবে, তা কোনোভাবেই অনুমান করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যায়, এথেন্সে যখন থার্টি টাইরেন্টস বা ৩০ জনের স্বৈরশাসন চলছিল, সক্রেটিস নির্ভয়ে তাদের ক্রমাগত সমালোচনা করেছিলেন, এমনকি মৃত্যুদÐ মাথায় নিয়েও সমালোচনা চালিয়ে যান। স্বৈরশাসকরা তখন তাকে কাউন্সিলের সামনে হাজির করে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার পরামর্শ দিতে বলে। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘যেখানে নিজেই বুঝতে পারছি না কিভাবে আমার জীবন পরিচালনা করব, সেখানে জনসাধারণ কিভাবে জীবনযাপন করবে, তা কী করে বলব!’ সক্রেটিসের এ কথার মর্মার্থ সাধারণ মানুষ বুঝলেও, ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে থাকা ক্ষমতাসীন দল বুঝতে পারছে না। সে মনে করছে, জনসাধারণ ভাল আছে। সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। তাবে জনগণ কতটা সুখে আছে বা তার সম্পর্কে কী ভাবছে, তা পরীক্ষা করার শক্তি যে ক্ষমতাসীন দলের নেই, তা নির্বাচনে হারার ভয়ে যে কোনো উপায়ে জিততে হবে-এ মনোভাব থেকেই বোঝা যায়। তার কাছে জনগণ নয়, ক্ষমতাই মুখ্য এবং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে হবে। তার বোধ-বুদ্ধি চাঙ্গা করার জন্য সক্রেটিসের মতো উচিত কথা যে কিছু সচেতন রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষক এবং বিদ্ব্যৎ সমাজের প্রতিনিধি বলেননি, তা নয়। ক্রমাগত পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও টেলিভিশন টকশোতে বলেছেন এবং বলছেন। কে শোনে কার কথা! উল্টো তাদের ক্ষমতাসীনদের তীব্র কটাক্ষের শিকার হতে হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা মনে করছে, তাদের সমালোচনা করা মনে বিরোধী দলের পক্ষে কথা বলা। কাজেই তারা সরকারের ভাল চায় না।
তিন.
নব্বইয়ের পর থেকে যতগুলো সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে, দেখা গেছে ক্ষমতায় থাকাকালীন জনআকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থতার জন্য জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ২০০১ সাল ছাড়া তাদের বিদায় খুব সুখকর হয়নি। ক্ষমতার শেষ দিকে হরতাল-অবরোধ এবং তা প্রতিহত করতে গিয়ে দেশের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। মানুষ মরেছে, রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। বলা যায়, মানুষের মৃত্যু ও সম্পদ ধ্বংসের পথ ধরে এক দল ক্ষমতা ছেড়েছে, অন্যদল ক্ষমতাসীন হয়েছে। ২০১৩ সালে এসেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেখার বিষয়, সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত পথ ধরে কে ক্ষমতায় যায় এবং কাকে বিদায় নিতে হয়। অর্থাৎ মানুষের রক্ত ও রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্টের পথ ধরে ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ হয়নি, কবে বন্ধ হবে তা অনিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করেন, তারাই আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন, আর কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। তারা এতটাই ক্ষমতান্ধ হয়ে আছে যে, দেশে বিরোধী দল বলে কিছু থাকুক, তা চান না। ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দলকে সহায়ক শক্তি বা ছায়া সরকার মনে না করে পথের কাঁটা মনে করছেন। অথচ ব্রিটেনে বিরোধী দলের শক্তিশালী ছায়া সরকার রয়েছে, যে সব সময় সরকারকে গাইড করছে। সরকারও গুরুত্বের সাথে তার মতামতের মূল্যায়ণ করছে। আমাদের দেশে বিরোধী দলকে মূল্যায়ণ দূরে থাক, কিভাবে তাদের নির্মূল করা যায়, ক্ষমতাসীনরা এ মনোভাব পোষণ করে। তাদের কথা-বার্তা এবং বডি ল্যাংগুয়েজ সবসময়ই আক্রমণাত্মক থাকে। বিষয়টি এমন, বিরোধী দলকে দুই আঙ্গুলে পিষে ফেলতে পারলে স্বস্তি পাওয়া যেত। বিরোধীদলের প্রতি ক্ষমতাসীনদের এমন প্রতিহিংসামূলক মনোভাব ও দমন-পীড়ন অব্যাহতভাবে চলছে। এই বৈরি আচরণের কারণেই বিরোধী দল মনে করে এবং মনে করা স্বাভাবিক, ক্ষমতায় যেতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। ফলে বাধ্য হয়ে অস্তিত্ব রক্ষা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিরোধী দলের সামনে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। এতে যে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হবে, তাতে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল যে বিরোধী দলের এই আন্দোলন নানা শক্তি দিয়ে দমন করবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। পারস্পরিক প্রতিহিংসার রাজনীতির মাধ্যমে জনসাধারণকে আতঙ্কে রাখার অধিকার রাজনৈতিক দলগুলোর আছে কিনা, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। স্বাধীন দেশে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার জন্য মানুষের জীবন বিপন্ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের প্রতিহিংসামূলক এই রাজনৈতিক কর্মকাÐ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বলা বাহুল্য, মানুষের কাছে জীবনের চেয়েও স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি। ’৭১-এ স্বাধীনতার জন্য এদেশের ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছে। তাদের জীবনের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তা উপভোগ করার জন্য, পুনরায় জীবন দেয়ার জন্য নয়। জনগণের নামে গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য মানুষকে জিম্মি হতে বা জীবন দিতে হবে কেন? রাজনৈতিক দলগুলোকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকেই এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
চার.
কয়েক বছর আগে আল জাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তার ব্যক্তিগত দ্ব›দ্ব নেই। আদর্শগত দ্ব›দ্ব আছে। তার কথা শুনে সাধারণ মানুষ আশাবাদী হয়েছিল। তারা মনে করেছে, ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের ‘তোমার মতের সাথে একমত না হতে পারি, তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে পারি’ উক্তির মতো না হলেও অন্তত দুই নেত্রীর পারস্পরিক বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা বন্ধ হবে। তাদের এ ধারণা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া এখন জেলে। ব্যক্তিগত, দলীয় এবং গোষ্ঠীগত আদর্শ বা দর্শন থাকা স্বাভাবিক। কারোই যেমন তার আদর্শ বা দর্শন থেকে সরে আসা উচিত নয় এবং সে অনুযায়ী চলা উচিত, তেমনি অন্যের আদর্শ ও দর্শনকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনও তার আদর্শিক দায়িত্ব। সক্রেটিসের যখন বিচার চলছিল, তখন তিনি কোর্টে বলেছিলেন, ‘যদি কেউ তার আদর্শ থেকে সরে আসে, তবে তা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃত্যু ভয়ে একজন সৈনিকের পালিয়ে আসার মতো। এটা কাপুরুষতা ছাড়া কিছুই নয়।’ অর্থাৎ আদর্শবান ব্যক্তির আদর্শের কাছে মৃত্যু তুচ্ছ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ তাদের দালের গঠনতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তাদের আদর্শ, যেকোনভাবে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়া। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষককে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে আদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তা থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটেছে। এই বিচ্যুতির কারণেই একে অপরের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবর্তে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। দেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা যেমন চলমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ, তেমনি রাজনীতিহীন দেশও চায় না। তারা চায় হিংসা-প্রতিহিংসা এবং হানাহানির পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং আস্থার রাজনীতি। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে, জনগণ তাদের সাথে আছে, তবে জনগণের এ পাল্স তাদের বুঝতে হবে। জনগণের দোহাই দিয়ে তাদের ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার কথা, জনগণ এখন আর বিশ্বাস করে না। তাদের কথা জনগণের কাছে পলিটিক্যাল রেটোরিক বা কৃত্রিম বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা ও আস্থাহীন রাজনৈতিক কথা-বার্তায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও অসার কথা-বার্তা থেকে বেরিয়ে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাপূর্ণ কথা বলতে হবে। শুধু বলার জন্য বলা নয়, তাদের কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে হবে, তাদের রাজনীতির লক্ষ্য নিজেদের আখের গোছানো নয়, দেশ ও জনসাধারণের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীর সাথে যে আদর্শের দ্ব›েদ্বর কথা বলেছেন, তা আদর্শগত এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। আদর্শকে আদর্শ দিয়ে এবং যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করা অপরিহার্য। আদর্শিক দ্ব›েদ্বর নামে একে অপরকে দমন-পীড়ন প্রবণতা কাম্য নয়। যে যত কথাই বলুক, বাস্তবতা হচ্ছে, ঘুরে-ফিরে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির উপরই জনগণ কর্তৃক দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। এই দুই দলের মধ্যেই আপ অ্যান্ড ডাউন হয়। উইনস্টন চার্চিলের ভাষায়, ‘পলিটিক্স ইজ এন এক্সাইটিং ওয়ার। সো, ইন পলিটিক্স ইউ ক্যান বি কিল্ড ম্যানি টাইমস।’ উভয় দলকে এ সত্যতা মানতে হবে এবং রাজনীতিতে পরাজয়ের মানসিকতা নিয়ে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করে সচেতন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা বা দমন-পীড়ন করে উড়িয়ে দেয়ার মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়। একজনের অস্তিত্ব আরেকজনকে স্বীকার করতে হবে। গেøাবাল ভিলেজে পরিণত হওয়া অগ্রগামী বিশ্বে সামিল হতে গোষ্ঠীগত স্বার্থে ক্ষমতাসীন হওয়ার মতো সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘ক্ষুদ্র ও সাময়িক স্বার্থের কারণে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় করণীয় যারা বিসর্জন দেয়, তারা কখনোই স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য নয়’, আমেরিকান রাষ্ট্রনায়ক ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের এই উক্তির প্রতিফলন জনসাধারণ কখনোই দেখতে চায় না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।