Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সন্তান কখনোই বিচ্ছেদ চায় না

তালাকে ক্ষতি বাচ্চাদের : হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

পরিবার ও সমাজে সমঅধিকার, নারী স্বাধীনতা, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা ইত্যাদি চর্চার কারণে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে শিশুদের কচি হৃদয়ে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। বাবা-মায়ের বিবাহ ‘বিচ্ছেদের বলী’ অবুঝ শিশুদের স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেয়। বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদে শিশুদের কচি হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয় তা সারাজীবন বয়ে বেড়ায়। নানান কারণে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা বেড়েছে। শহর-গ্রাম, উচ্চশিক্ষত-অশিক্ষিত বিভিন্ন মত পথ ও পেশার মানুষের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অধিকার বঞ্ছিত শিশুর সংখ্যা।
বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল প্রণিধানযোগ্য পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। হাইকোর্টের মন্তব্য হলো- ‘প্রতিটি বিয়েবিচ্ছেদের কারণে সন্তানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সন্তান কখনোই মা-বাবার বিচ্ছেদ চায় না। সারাদেশে ডিভোর্স হওয়া দম্পতিদের সব সস্তানের অনুভূতি একই। তাদের মধ্যে কেউ তা প্রকাশ করতে পারে, কেউ তা প্রকাশের সুযোগ পায় না। দুই ছেলে ধ্রæব (১২) ও লুব্ধককে (৯) নিজের কাছে রাখতে চেয়ে কামরুন নাহার মল্লিকার আবেদনের বিষয়ে শুনানিকালে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।
আদালতে দুই ছেলের মা কামরুন নাহারের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ। অন্যদিকে ধ্রæব ও লুব্ধকের বাবা মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। শিশু ধ্রæব ও লুব্ধককে উদাহরণ হিসেবে এনে হাইকোর্ট বলেন, ‘এ দুটি বাচ্চা আমাদের কাছে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। এ ধরনের অনেক পরিবারের (ডিভোর্স হওয়া) কোনও শিশু হয়তো তার ‘চাওয়ার কথা’ প্রকাশ করতে পারে, কোনও শিশু হয়তো প্রকাশের সুযোগ পায় না। ধ্রæব ও লুব্ধকের বাবা-মা শুনলেও অন্য বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের অনুভূতি কানে নিচ্ছেন না।’
দুই পক্ষের আইনজীবীদের কাছে শুনানির শুরুতে আদালত জানতে চান, পরিস্থিতির কি কোনও উন্নতি হয়েছে? বাবার আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, ‘হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। ছোট ছেলে লুব্ধক তার বাবাকে একদিন রাতে বাসায় থেকে যাওয়ার আবদার জানায়। বাবা রাজি হলেও মা তাতে সায় দেননি। এ কারণে সেদিন রাত ১টায় বৃষ্টির মধ্যেই মেহেদী হাসানকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল।’ এই আইনজীবীর অনুরোধ, ‘দুই সন্তান যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রয়োজনে তিনি ড্রয়িং রুমে থাকবেন।’ আদালত তখন বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন সবকিছুই হবে।’
পারিবারিক সমস্যার কারণ দেখিয়ে ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ার কারণে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে ধ্রæব ও লুব্ধকের বাবা মেহেদী হাসানের চাকরি চলে যায়। পারিবারিক এই ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে আদালত বলেন, এই ঘটনা মিডিয়ায় কীভাবে এসেছে দেখেছেন? জনগণের সেন্টিমেন্ট দেখেছেন? এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময় মেহেদী হাসানের আইনজীবী আদালতকে জানান, মেহেদী হাসান সারেন্ডার করেছেন। দুই সন্তান যেভাবে চাইবে তিনি তাই করবেন। আদালত তখন প্রশ্ন করেন, ‘এটাকে কি পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?’ তাপস কান্তির উত্তর, ‘কিছু তো উন্নতি হয়েছে।’ মেহেদীর আইনজীবীর সঙ্গে আদালতের এই কথোপকথনের সময় কামরুন নাহারের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। সুতরাং দু’জনের মধ্যেই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য আরও সময় লাগবে।’ এই অভিমতের সঙ্গে একমত হয়ে আদালত বলেন, ‘ঠিক, এটা তো রাতারাতি উন্নতি হবে না।’
এ সময় আদালত দুই শিশু ‘ধ্রæব ও লুব্ধককে সামনে ডেকে তাদের খোঁজ-খবর নেন। ধ্রæবকে আদালত জিজ্ঞাসা করেন, ফুটবল বিশ্বকাপে তুমি কোন দল করো? তার জবাব, ‘ব্রাজিলকে সাপোর্ট করি।’ এরপর আদালত লুব্ধককে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কোন দল করো? উত্তরে সে নিজেকে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার জানায়। এরপর আদালতের প্রশ্ন- ‘সবকিছু ভালো আছে তো?’ এ সময় লুব্ধক জবাব দেয়, ‘সবকিছু ভালো আছে।’
মা কামরুন নাহারের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জানায়, ধ্রæব ও লুব্ধক ইতোমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তারা খুশি। প্রতিদিন স্কুলে আনা-নেওয়া করছেন তাদের মা। এই তথ্য শোনার পর আদালত বলেন, ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হয় না। ধ্রæব ও লুব্ধকের কাছে আদালত জানতে চান, নতুন স্কুল কেমন লাগছে? ধ্রæব জানায়, ‘ভালো লাগছে।’ আদালতের প্রশ্ন, তোমরা ঘুরতে গিয়েছিলে? ধ্রæবের উত্তর-হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি জানান, মা ছুটি নিয়ে ঘুরছেন। বাবাও ছেলেদের নিয়ে ঘুরতে যেতে চান। আদালত তখন বলেন, বাবাও ঘুরতে পারবেন। প্রয়োজনে তাদের মাকেও সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন।
স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ এবং আদালতে দুই শিশুর আকুতির ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহারকে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই বলেছেন, ‘তোমরা পূণ্যের কাজ করেছো।’ এ ঘটনায় আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চাশা বেড়ে গেছে। ‘সমঝোতার জন্য সময় দিয়ে শিশুদের কল্যাণের কথা ভেবে পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার বার্তা দিয়েছেন কোর্ট।’ ‘ধ্রæব ও লুব্ধকের বাবা-মা’র উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনারা উভয়ে শিক্ষিত। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।’ আদালত আদেশ দিয়ে বলেন, মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহারের নিজেদের মধ্যে সমঝোতা প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতির জন্য দুই পক্ষ সময় চেয়েছে। সময় মঞ্জুর হয়েছে। এ মামলার পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ধার্য করা হলো। ওই তারিখে তালাক হয়ে যাওয়ার পরও শিশু সন্তানদের কথা বিবেচনা করে মেহেদী হাসান ও কামরুন নাহার মল্লিকা আবার ‘এক হতে চান’ কিনা সেটা আগামী পহেলা আগস্ট আদালতকে অবহিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিচ্ছেদ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ