Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা হীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা

মুজিবুর রহমান মুজিব | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৬ এএম


বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খাঁ একজন বীর যোদ্ধা ও প্রজাবৎসল নৃপতি ছিলেন। এই বীরযোদ্ধাকে কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধক্ষেত্রেই কাটাতে হয়েছে। মারাঠা দস্যু, বর্গী, ভাস্কর পন্ডিতের রোষানল ও হামলাকে দুঃসাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। কঠোর হস্তে বিদেশি আক্রমণকারীগণকে পরাজিত-বিতাড়িত-নিশ্চিহ্ন করে সুবে বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। নবাব আলীবর্দী ছিলেন অপুত্রক, তিন কন্যা সন্তানের জনক। বাংলার নবাব তাঁর প্রিয় প্রজাসাধারণকে নিজ সন্তানের মতই মনে করতেন। কন্যা আমিনা বেগমের প্রথমপুত্র মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলাকে পুত্রের মত ¯েœহ করতেন তিনি। সিরাজকেই দত্তক নিয়ে যুদ্ধবিদ্যা, রাজ্যশাসন ও রাজ্যপরিচালনায় শিক্ষা দিয়ে যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তোলেন। এক সময় ইরাকের নযফ থেকে ভাগ্যান্বেষী একটি পরিবারকে আশ্রয় এবং সেই পরিবারের সুদর্শন ও বিনয়ী মো. জাফর আলীকে একশত টাকা বেতনে উমেদারের চাকরি দেন আলীবর্দী। জাফর আলীর বিনয়াচরণে মুগ্ধ হয়ে বড় মন ও বড় মাপের মানুষ আলীবর্দী খাঁ তাঁর বৈমাত্রেয় ভগ্নি শাহী খানমকে তার সঙ্গে শাদী দেন। নযফি সৈয়দ বলে কথিত মো. জাফর আলীর পারিবারিক পদবী ছিল মীর। বাংলা ও বাঙ্গালির ইতিহাসের ঘৃণিত নাম, নিন্দিত নাম, বেঈমান মীর জাফর আলী খাঁন। বাংলাদেশে বিশ^াস ঘাতকের আরেক নাম মীর জাফর। বাংলার নবাব আলীবর্দী দয়াপরবশ হয়ে মানবিক কারণে যে ভিনদেশিকে আশ্রয়, চাকরি, সম্মান ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাজপ্রাসাদে ঠাঁই দিয়েছিলেন সেই বেঈমান অর্থের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছে, যারা নবাব আলীবর্দীর বংশধরদের নির্বংশ করেছিল নির্মমভাবে।
আজীবন লড়াই-সংগ্রাম ও বার্ধক্যজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী খাঁ। তার সময় শেষ অনুধাবন করে তিনি তার উত্তরসুরী ও প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে কাছে ডেকে এনে বলেন, ‘আমার মৃত্যু সন্নিকটে। তোমার কাছে আমার শেষ উপদেশ, তোমার শত্রæদের দমন করতে এবং বন্ধুদের মর্যাদায় রাখতে সমস্ত অন্তর দিয়ে তুমি চেষ্টা করবে। দেশের জনগণের উন্নতি বিধান এবং অত্যাচার ও বিশৃঙ্খলা দমন করতে তোমাকে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ জীবনের অন্তিম সময়েও বৃদ্ধ নবাব বাংলার প্রজাসাধারণের কল্যাণের কথা বলেছেন, চিন্তা করেছেন, তরুণ সিরাজকে ইংরেজদের বিষয়ে সাবধান ও সতর্ক থাকতেও উপদেশ দিয়েছেন। ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল জোহরের নামাজের সময় আল্লাহ-রসুলের নাম নিতে নিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। এক সপ্তাহ রাষ্ট্রীয় শোক পালন শেষে ১৭৫৬ সালের ১৫ এপ্রিল মনসুরুল মূলক উপাধি নিয়ে মির্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা সুবে বাংলার নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পর্যন্ত বাংলার স্বাধীন নবাব ছিলেন তিনি। পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব রাজ্য-সিংহাসনহারা হন। অতঃপর তারই প্রাসাদে গৃহবন্দী। ২ জুলাই রাতে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন তিনি। মীর জাফর, মীর সাদেক আলী খান মিরনের ইচ্ছা ও ইঙ্গিতে বেঈমান মোহাম্মদী বেগ নবাবকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
সুবে বাংলার নবাব হয়ে গৃহবিবাদ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুটিয়ালদের বেআদবির সম্মুখীন হন স্বাধীনচেতা তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র কঠোরহস্তে দমন করেন তিনি। কুটিয়ালরা কোলকাতা দখল করলে কোন আলোচনা-আপোসের সুযোগ না দিয়ে স্বয়ং কোলকাতা অভিযান করেন তিনি। কোলকাতা বিজয় করে প্রিয় দাদুর নামে কোলকাতার নতুন নামকরণ করেন আলীনগর। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সিপাহসালার মীর জাফর আলী খাঁ, ভাগ্যবান ধনকুবের জগৎশেঠ, শক্তিমান রায় দুর্লভ, কুচক্রী উর্মি চাঁদ গং ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে বাংলার নবাবীকে কোম্পানির কাছে বিকিয়ে দেয়। সেই মোতাবেক মাত্র হাজার তিনেক সৈন্য, গোটা কয়েক কামান নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করেন। গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে কোন আলোচনার জন্য অপেক্ষা না করে দশ সহ¯্রাধিক পদাতিকসহ প্রায় অর্ধলক্ষ সৈন্য ৫৩টি কামান, বিপুল সংখ্যক পদাতিক সৈন্য নিয়ে স্বয়ং যুদ্ধযাত্রা করেন বাংলার নবাব। পলাশীর প্রান্তরে এসে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন, বৃহস্পতিবার পলাশীর যুদ্ধে ভাগ্যবিপর্যয় হয়ে গেল সুবে বাংলার ভাগ্যাহত নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পলাশীর প্রান্তরে সিপাহসালার মীর জাফরের নেতৃত্বে রাজা রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, উর্মি চাঁদ, এয়ার লতিফের হাজার হাজার সৈন্য পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ইংরেজদের রণনৈপুন্য দেখছিল আর বাংলার নবাবের পতন কামনা করছিল। বীরের মতো যুদ্ধরত অবস্থায় নবাবের বিশ^স্থ সেনাপতি মীর মদন যুদ্ধক্ষেত্রেই শাহাদাত বরণ করেন। নবাবের একান্ত অনুগত সেনাপতি রাজা মোহন লাল প্রাণপণ যুদ্ধ করে যুদ্ধের গতি যখন নবাব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন তখন সেনাপতি মীর জাফর সেদিন যুদ্ধ বন্ধ করে রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন। বাংলার নবাব মাথার পাগড়ি খুলে নিচে রেখে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের আহŸান জানালে বেঈমান মীর জাফর পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ আল কোরআনের ওপর হাত রেখে শপথ ও দোহাই দিয়ে পরদিন যুদ্ধে নামার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলে সরল বিশ^াসে বাংলার নবাব রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আদেশ দেন। বিশ^াসঘাতক মীর জাফর গুপ্তচর মারফত এই সংবাদ ক্লাইভ শিবিরে পাঠালে ইংরেজবাহিনী নবাব শিবিরে আক্রমণ করে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা পিছু হটে পুনঃ পরিকল্পনা ও শক্তি ও সৈন্য সংগ্রহের আশায় রাজধানী মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন করেন। ইংরেজ শিবিরে কোম্পানির বিজয় ডংকা বেজে উঠে। পলাশীর প্রান্তরে সুবে বাংলার স্বাধীনতা অস্থমিত হয়। মুর্শিদাবাদ ফিরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাষ্ট্রীয় কোষাগার খুলে দিয়ে সৈন্য সংগ্রহের জন্য অনেককেই বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেন। টাকা পয়সা নিলেও কেউই সৈন্য সংগ্রহ করে নবাবের কাছে ফিরে আসেননি। স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানি কিংবা বিশ^াসঘাতক সিপাহসালার মীর জাফরের কাছে আত্মসমর্পণ, কিংবা ঐক্যমতের সরকার গঠন কিংবা নবাবী ও মসনদকে ভাগ বাটোয়ারা কিংবা কোম্পানির কুঠি নির্মাণ, সৈন্য সমাবেশ কিংবা বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অনুমতি প্রদান ও বাংলা ও বাঙ্গালির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোন প্রস্তাব পাঠাননি, বরং পাটনায় গিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করে পুনরায় ব্রিটিশ বিতাড়ণ এবং বেঈমান মীর জাফরচক্রকে উচিত শিক্ষা দিতে মনস্থির করেন। সেই মর্মে বাংলার হতভাগ্য নবাব রাতের আঁধারে বেগম লুৎফুন্নেছা এবং তিন বছর বয়সী একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জহুরাকে নিয়ে নৌকা যোগে পাটনায় রওয়ানা হন। এই গমন-পলায়ন ছিল না, ছিল রাজ্য উদ্ধারের জন্য শক্তি ও সৈন্য সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পথেই গ্রেফতার হন তিনি। গ্রেফতার হওয়ার পরও প্রাণভিক্ষা চাননি নির্ভীক দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলা। তাকে তারই জাফরগঞ্জ প্রাসাদে অসম্মানজনকভাবে বন্দি করে রাখা হয়। ২ জুলাই রাতে মতান্তরে ৩ জুলাই প্রাতে মোহাম্মদী বেগ ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। সিরাজউদ্দৌলার লাশকে অসম্মানজনকভাবে হাতির পীঠে উঠিয়ে শহরে ঘোরানো হয়। দুঃখিনী মাতা আমেনা বেগমের প্রাসাদ সম্মুখে লাশ নিয়ে আনন্দ উল্লাস করা হলে আমেনা বেগম মূর্ছা গেলেও মীর জাফরচক্রের কোন দয়া হয়নি। পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী নবাব সিরাজউদ্দৌলার ধর্মীয় বিধিবিধান মোতাবেক সসম্মানে গোসল, জানাজা, দোয়া, দুরূদ-জিয়ারতের বিধান থাকলেও মীরচক্রের ভয়ে কেউই এগিয়ে আসেননি। হৃদয়বান মির্জা জয়নুল আবেদীন বাকাওয়াল সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসে লাশের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। খুশবাগের শাহী গোরস্থানে দাদু আলীবর্দী খাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে। ইতিহাস গবেষক-পর্যটকগণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার রুহের মাগফিরাত কামনা করে কবর যিয়ারত করেন আর বেঈমান মীর জাফরের বাসস্থান-কবর গাহে নিমক হারামের দেউরি হিসেবে পদাঘাত ও ঘৃণা প্রদর্শন করেন।
২৩ জুনের পলাশীর বিশ^াসঘাতকতা এবং ২ জুলাই নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাহাদাত বরণের পর সুবে বাংলার রাজনীতি ও সমাজ জীবনে গুণগত মৌলিক পরিবর্তন আসে। নবাবের বংশকে নির্বংশ করার জন্য মীর জাফর-মীরনচক্র নবাবের কনিষ্ট ভ্রাতা মির্জা আক্রামুদ্দৌলা এবং মির্জা মাহদীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক সিপাহসালার মীর জাফর আলী পুতুল নবাব হলেও রাজস্ব আদায়সহ সকল ক্ষমতার মালিক হয় ক্লাইভচক্র। বাংলার পুতুল নবাব হন কোম্পানির ভাতা-বেতনভূক কর্মচারী মাত্র। কোম্পানি এবং সুদখোর জগৎশেঠ চক্রের বল্গাহীন লুণ্ঠন-শোষণে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাংলার ইতিহাসে কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মনন্তরে লক্ষ লোক না খেয়ে মারা গেলেও মীরচক্র বিলাস-ব্যাসনে গা ভাসায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন