Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হালদাকে বাঁচাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৮, ৯:৫৩ পিএম

দক্ষিণ এশিয়ার মিঠাপানির মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী ভয়াবহ দূষণের কবলে পতিত হয়েছে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কেমিক্যালের অব্যাহত পতনে পানি ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও বন্যার পানিতে আশপাশের শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশে নদীতে পড়ায় পানি দূষিত হয়ে গেছে। দূষণের মাত্রা এতই বেশি যে মাছ মরে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে অন্যান্য জলজপ্রাণীও। প্রতিদিনই অসংখ্য মরা মাছ ভেসে উঠছে। ইতোপূর্বে এমন দূষণ আর কখনো দেখা যায়নি। স্থানীয় লোকদের অভিমত, হালদার সঙ্গে সংযুক্ত ছোট-বড় খাল ও ছড়ায় দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা শিল্প-কারখানার বর্জ্য, আবর্জনা ও কেমিক্যাল পাহাড়ী ঢল বন্যার পানির সঙ্গে মিশে একযোগ হালদায় পতিত হওয়ায় এই নজিরবিহীন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, মাছের ব্যাঙ্ক হিসাবে পরিচিত হালদা মাছশূন্য হয়ে পড়তে পারে এবং এর জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হতে পারে অপূরণীয়। নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ অত্যধিক এবং অক্সিজেনের পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়ায় মাছ ও জলজপ্রাণী এভাবে ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, গত এপ্রিলে অনুকূল আবহওয়া ও পরিবেশ বিরাজমান থাকায় হালদায় মা মাছ রেকর্ড পরিমাণ ডিম ছাড়ে। জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীরা উৎসবের আমেজে ডিম সংগ্রহ করে। গত ১০ বছরের মধ্যে এত ডিম তারা সংগ্রহ করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে তখন এক খবরে উল্লেখ করা হয় যে, সংগৃহীত ডিম থেকে যে রেণু তৈরি হবে তার প্রতি কেজিতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ পোনা হবে, যার মূল্য হবে প্রায় ৪ কোটি টাকা। আহরিত শত শত কেজি ডিম থেকে উৎপন্ন পোনা ও মাছে কত কোটি টাকা উপার্জন হবে, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। বলা যায়, শুধু এই খাত থেকেই অর্থনীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকার যোগান আসতে পারে।
এরকম একটি মাছের খনি, টাকার খনি শুধুমাত্র শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কেমিক্যাল দূষণে ধ্বংস হয়ে যাবে, তা কখনই মেনে নেয়া যেতে পারে না। সুন্দরবন যেমন বিশ্ব-ঐতিহ্য এবং সম্পদের অফুরান উৎস, হালদা নদীও তেমনি বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ এবং সম্পদের ভাÐার। দুটিই প্রকৃতির দান। সুন্দরবনের আশপাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প-কারখানা স্থাপন যেরূপ অসমর্থনযোগ্য, অনুরূপভাবে হালদার আশপাশে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার অস্তিত্বও বরদাশতযোগ্য হতে পারে না। শিল্প-কারখানা অনেক তৈরি করা যাবে কিন্তু সুন্দরবন ও হালদা তৈরি করা যাবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা সামনে রেখে সুন্দরবনের সন্নিকটবর্তী এলাকায় কোনো রূপ ক্ষতিকর শিল্প-কারখানা যেমন তৈরি করা যাবে না, একইভাবে হালদার পানি ও পরিবেশে দূষণকারী শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কিছু শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিলে জাতি ও দেশের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না; কিন্তু মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রটি ধ্বংস হয়ে গেলে যে ক্ষতি হবে তা আর কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা যাবে না। অতএব, যে কোনো মূল্যে হালদার পানি দূষণরোধ করতে হবে, তাকে বাঁচাতে হবে। বুড়িগঙ্গার কথা আমরা জানি। রাজধানীর খোলা জানালা হিসাবে পরিচিত এই নদী দখল ও দূষণে শেষ হয়ে গেছে। বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েও একে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। এর মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। হালদারও তেমন পরিণতি হোক, কেউই তা চাইতে পারে না। মিঠাপানির মাছের প্রধানতম উৎস হালদা দীর্ঘদিন ধরে দখল ও দূষণের শিকার। এর নিকটবর্তী এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন, নির্বিচার দখল, রাবার ড্যাম নির্মাণ, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ এহেন অনাচার নেই যা চালানো হয়নি বা হচ্ছে না। এরই খেসারত হিসাবে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এসব নিয়ে অতীতে পত্র-পত্রিকায় কম লেখালেখি হয়নি। সামাজিক আন্দোলন পর্যন্ত জারি আছে। সরকার কিছু পদক্ষেপ অবশ্য নিয়েছে। এর মধ্যে রাবার ড্যাম নিচু করা, বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা এবং নদীর সাত্তার ঘাট থেকে মদুনা ঘাট পর্যন্ত মা মাছ শিকার নিষিদ্ধ করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে সুফলও পাওয়া গেছে। এবার ডিম সংগ্রহ ১০ বছরের চেয়ে বেশি হওয়া তার প্রমাণ। কিন্তু হালদাকে এখনও সম্পূর্ণ নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কেমিক্যাল দূষণ বন্ধ করা না গেলে হালদাকে নিরাপদ করা যাবে না। মাছের নিশ্চিত নিরাপত্তা এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা দূষণ নিরোধ করতে হবে।
হালদাকে বাঁচতে প্রথমত, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয়, দূষণ-দখলসহ সকল অনাচার বন্ধে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। এ মুহূর্তে দূষণ রোধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নির্ধারন করে দ্রæত পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, তাও নির্ণয় করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে একসাথে বৈঠকে বসতে হবে। বিশেষজ্ঞদেরও সংযুক্ত করতে হবে। সর্বাগ্রে বিষয়টির ওপর প্রাথমিক এবং পরে ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত চালাতে হবে। এখনই পানি দূষণ প্রতিরোধে উপযোগী কেমিক্যাল প্রয়োগ করতে হবে, যাতে যে মাছ এখনও টিকে আছে তা রক্ষা করা যায়। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো গেলে মাছ ও জলজপ্রাণী বাঁচবে। বলাবাহুল্য, তৎক্ষণিক সমাধান যেহেতু স্থায়ী সমাধান নয়, তাই ভবিষতের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কেমিক্যাল দূষণ রোধে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ওই বর্জ্য কেমিক্যাল নদীতে পড়তে না পারে। শিল্প-কারখানার মালিক-কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে সতর্ক করতে হবে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের ন্যূনতম ব্যর্থতাকেও প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। দরকার হলে দূষণকারী শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। আশা করি, সরকার এদিকে অবিলম্বে নজর দেবে এবং হালদাকে বাঁচাতে যা কিছু করার, দ্রæত ও আন্তরিকতার সঙ্গে করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন