চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম
“ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতুল কাদরে। ওয়ামা আদরাকা মা লায়লাতুল কাদরে। লায়লাতুন কাদরে, খায়রুল মিন আলফে সাহরিন। তানাযালুল-মালায়িকাতো ওয়াররুহু ফিহা বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি-আমরিন। সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলায়িল ফাজরে।” সূরা কাদর-১-৫ আয়াত, এরশাদ হচ্ছে-১। আমি ইহা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে; ২। আর মাহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কি জান ? ৩। মাহিমান্বিত রজনী সহ¯্রমাস (অর্থাৎ ৮৩ বৎসর ৪ মাস) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ৪। সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাহাদিগকে প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। ৫। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।
রমযানুল মোবারকের রাত্রি সমূহের মধ্যে একটি রাত্রিকে “শবে ক্কদর” বলা হয়। উহা বড়ই খাইর ও বরকতের কল্যাণময় রাত। কালামে পাকে উক্ত রাতকে এক হাজার মাস অপেক্ষো উত্তম বলা হয়েছে। এক হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। ভাগ্যবান ঐসব লোক যাদের উক্ত রাত্রির ইবাদ বন্দেগী নসীব হয়। কেননা এই একটি মাত্র রাত যে ইবাদতে কাটালো সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়ে বেশী সময় ইবাদতে কাটালো। আর এই বেশীর অবস্থায়ও জানা নাই যে উহা হাজার মাস অপেক্ষা কত মাস অধিক উত্তম। প্রকৃত পক্ষে বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ পাকের সেরা অবদান শবে-ক্কদর। আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে নিজেই বলেছেন যে, পবিত্র রমজান মাসে কুরআন মজীদকে অবতীর্ণ করা হয়েছে যে তিনি ক্কদরের রাত্রিতে কুরআন পাক নাযিল করেছেন। “দররাতুন নাসেহিন” কিতাবে উল্লেখ আছে যে, নবী করিম (সাঃ) বনী ইসরাইলের সামউন গাজী (রঃ) কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতেন এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য এক উটের বাহন অস্ত্র সঙ্গে রাখতেন, দিনের বেলা রোজা রাখতেন এবং সারারাত ইবাদতে কাটাতেন। এর প্রতি সাহাবীগণের মনে ঈর্ষা ও হতাশার ভাব দেখা দিলে আল্লাহ্ তায়ালা উহার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কেবলমাত্র উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সেরা অবদান শবে ক্কদর দান করে সূরা ক্কদর নাযিল করেন। হযরত আইয়ুব (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ) প্রত্যেকেই ৮০ বছর পর্যন্ত আল্লাহ্পাকের ইবাদতে অতিবাহিত করেন, মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর নাফরমানী করেন নাই। কাজেই শবে ক্কদরের একটি বিশেষ রাতে যে ইবাÍ বন্দেগীতে কাটালো সে যেন মহা সৌভাগ্যবান এবং উক্ত রাতে যে ব্যক্তি আল্লাহ্র করুণা ও কল্যাণ হতে বঞ্চিত থাকে সে সর্বহারা ও চিরবঞ্চিত। উক্ত রাতে ফেরেস্তা এবং রূহ আল্লাহ্র রহমত ও করুনা নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন। উক্ত রাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল শান্তি আর শান্তি এবং উক্ত রাতে বরকত ও কল্যাণ ভোর পর্যন্ত থাকে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয় যে ব্যক্তি মহিমান্বিত শবে ক্কদরে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের নিয়্যতে ইবাদত করার জন্য দন্ডায়মান হয় তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন যে, রমজানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে শবে ক্কদর তালাস কর। বোখারী শরিফের অপর হাদীসে পাওয়া যায় রসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণকে শবে ক্কদরের সুনির্দিষ্ট সংবাদ দেওয়ার জন্য বাইরে আসেন। কিন্তু সেই সময় দু’জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল বলে উহার নির্দিষ্ঠতা আল্লাহর তরফ থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হাদীসের বিশেষ শিক্ষনীয় এই যে, দু’জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ কঠিন অপরাধ। উহার জন্য কল্যাণ ও বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়, পারস্পরিক সুম্পর্ক সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আর পরস্পর কলহ বিবাদ দ্বীনকে ধ্বংস করে যেমন ক্ষুর মাথার চুলকে বিনাশ করে। হযরত কাব (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এই আল্লাহর একত্ববাদে অটলভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ রাতে তিনবার “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পড়বে, প্রথম বার পাঠ করার বদৌলতে তাকে ক্ষমা করা হবে, দ্বিতীয়বার পড়ার কারণে যে নরক থেকে পরিত্রান লাভ করবে এবং তৃতীয়বার বলার কারণে সে বেহেস্তে প্রবেশ করবে। অপর দিকে পিঠে পাহাড় তুলে দিলে যেরূপ ভারী মনে হয় মোনাফেক, মুশরেক ও কাফেরের জন্য লাইলাতুল ক্কদর সেরূপ ভারী মনে হবে।
শবে ক্কদরের শিক্ষা ও মহিমা অপার। এই রাতেই লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে কোরআন মজীদ নাযিল করা হয়। ধরাবাসীর কল্যাণ পরিবেশনের উদ্দেশ্যে রহুল কুদ্দুস তথা হযরত জীবরাঈল (আঃ) অসংখ্য ফেরেস্তাসহ আল্লাহর নির্দেশে ধরায় অবতরণ করেন, উক্ত রজীনতে আধ্যাত্মিক ও জৈবিক উন্নতি ও কল্যাণ বৃদ্ধির এক বর্ষা মুখর রাতে বৃষ্টির ধারার মত বর্ষণ হতে থাকে । ঐ রাতে সংশ্লিষ্ট বছরে সম্পাদনীয় বিশ্ব ব্যবস্থার যাবতীয় উল্লেখযোগ্য বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়ে থাকে। ঐ রাতে শান্তি ও সাত্ত¡নার রাত, নিরাপত্তার রাত, আল্লাহর বিশিষ্ট বান্দাগণ উক্ত রাতে এক অনির্বচনীয় শান্তি ও মাধুর্য্য উপভোগ করে থাকেন। বিখ্যাত তফসীরে কাদেরীতে উল্লেখ আছে যে, ইমাম শাফী (রাঃ) রমজানের ২১ ও ২৩ রাত্রিতে শবে ক্কদর উদযাপনে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেন, অধিকাংশ আলেমগণ এবং হানাফী মাযহাবে ২৭ শে রাত্রিতে শবে ক্কদর উদযাপনের উপর বেশী গুরুত্ব দেন। কারণ স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয় যে, আরবী লাইলাতুল ক্কদরে নয়টি অক্ষর রয়েছে এবং সূরা ক্কদরে লাইলাতুল ক্কদর কথাটি তিনবার নির্ধারিত রয়েছে। কাজেই (৯ঢ৩=২৭) অক্ষর ইশারা করা হয়েছে যে, রমজান মাসের ২৭ শে রাত্রিতেই শবে ক্কদর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী এবং মুসলিম বিশ্বে রমজান মাসের ২৭ শে রাত্রিতে শবে ক্কদর রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। রমজান মাসে যারা জামাতের সাথে নিয়মিত তারবীহর নামাজ, এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ আদায় করেন তারা শবে ক্কদরের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হন না।
রমজান মাসের শেষ দশকে যারা সুন্নতে মোয়াক্কাদা কেফায়া হিসাবে মসজিদে এতেকাফ পালন করেন তারা অবশ্যই ক্কদরের রাত পেয়ে থাকেন। সব রকম পাপাচার ত্যাগ করে মানব মনের পশু প্রবৃত্তিকে ও ষড় রিপুকে দমন করে পূর্বের পাপরাশির স্মরণে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে এই মহান রজনীতে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর নিকট পাপের মার্জনা ভিক্ষা করতঃ আল্লাহর ইবাদ বন্দেগীতে উক্ত রাত অতিবাহিত করা ঈমানদার বান্দাগণের মহান কর্তব্য। সর্ব প্রকার পাপকর্ম, পাপ প্রেরণা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা বিসর্জন দিয়ে দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য শবে ক্কদরের মহান রাতের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক ঈমানদার মানুষের একান্ত কর্তব্য এবং এতেই বিশ্বশান্তি ও মানব কল্যাণ নিহিত।
আল্লহ আমাদিগকে শবে ক্কদর রাতের সদ্ব্যবহার করার তৌফিক দিন।
লেখক: সভাপতি, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন
(সরকার অনুমোদিত)
খলিফা, মানিকগঞ্জ সিদ্দিকনগর দরবার শরীফ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।