পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মিঠাপানির বড় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী বিশ্বের অনন্য সম্পদ ও ঐতিহ্য। সংরক্ষণ ও নিরাপদ করতে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ : গবেষক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া
শফিউল আলম : নদীর বুকে সারি সারি নৌকা। চৌকস জেলের দল। মৌসুম আর আকাশের মতিগতি বুঝে নৌকা ছুটে চলে। এখানে-সেখানে নজর বুলিয়ে মা-মাছেদের ছেড়ে দেয়া ভাসমান ডিম সংগ্রহের ব্যস্ততা। চকচকে মুক্তার দানার মতো ডিম। রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস ইত্যাদি কার্প জাতীয় অর্থকরী মাছের ডিম। জেলেদের নিজস্ব বুদ্ধি-কৌশল কাজে লাগিয়ে ফোটানো হয় ‘ধান রেণু-পোনা’, ‘অঙ্গুলি পোনা’।
মাছের পোনা দেশের সোনা সারাদেশে পুকুর, দীঘি, জলাশয়সহ মৎস্য খামারে চাষের জন্য কিনে নিয়ে যান মৎস্যজীবীরা। মুক্তাদানা থেকে উৎপাদিত পোনা ও বড় মাছের মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। যার জোগানদার বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন চট্টগ্রামের হালদা নদী। দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণ হালদাকে বলেন ‘জীন ব্যাংক’, ‘জাদুকরি মাছের ব্যাংক’, ‘মুক্তার খনি’, ‘অর্থনৈতিক নদী’ ইত্যাদি হরেক নামে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে এ নদীতে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদকে আল্লাহতায়ালার অপার নিয়ামত হিসেবে বিস্ময়ের চোখে দেখেন বিজ্ঞানীরা। এবারে মা-মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে (১৯ ও ২০ এপ্রিল) গত দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহের রীতিমেতা উৎসব জমে ওঠে। ডিম থেকে ৯৬ ঘণ্টায় রেণু ফোটানোর পর প্রতিকেজি রেণু থেকে হয় সাড়ে ৪ কেজি পোনা। রেণু ও অঙ্গুলি পোনা বিক্রি হয় কেজি ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়।
প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ সময় ও পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস মা-মাছ দলে দলে ডিম ছাড়ে। মা-মাছ সাধারণত এপ্রিল থেকে জুনে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ‘জো’র সময়ে ডিম ছাড়ে। এ সময় প্রচÐ বজ্রসহ বৃষ্টিপাত থাকতে হয়। বজ্রবর্ষণ স্থানীয়ভাবে এবং নদীর উজানেও হতে হয়। এরফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনার আকারে প্রবাহিত হয়। ‘জো’-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে নদীর জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই মা-মাছ ডিম ছাড়ে। উপযুক্ত পরিবেশে ডিম সংগ্রহ করে জেলেরা বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ জানান, হালদা নদীতে রুই জাতীয় মা-মাছের ডিম ছাড়ার বিষয়টি প্রাকৃতিক। বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যান্য নদ-নদী থেকে ভিন্ন। এর পেছনে তিনটি বৈশিষ্ট্য ও কারণ রয়েছেÑ ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক। ভৌতিক কারণগুলো হচ্ছে, হালদা নদীর বাঁক, বেশকিছু নিপাতিত পাহাড়ি ঝরণা বা ছড়া, প্রতিটি ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, নদীর গভীরতা, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব। রাসায়নিক কারণ হচ্ছে, কম কন্ডাক্টিভিটি, সহনশীল দ্রবীভূত অক্সিজেন। জৈবিক কারণ হচ্ছে, প্র্রথম বর্ষণের পর বিল এবং দু’কুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুর জৈব উপাদানের মিশ্রণ ঘটে। ফলে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে, যা প্রজনন-পূর্ব মা-মাছের পরিপক্কতায় সাহায্য করে। অনেকগুলো পাহাড়ি ঝরণা বিধৌত পানিতে প্রচুর পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়। এরফলে হালদায় অনুকূল পরিবেশে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। যা বিশ্বের অন্য কোনো নদীতে হয়না। হালদা নদীর বাঁকগুলোর (অক্সবো বাঁক) প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পানির প্রচÐ ঘূর্ণন ঘটে। ফলে পানিতে গভীর খাদ সৃষ্টি হয়। স্থানীয়ভাবে তা ‘কুম’ হিসেবে পরিচিত। উজান থেকে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে জমা হয়। ফলে পানি অতি ঘোলা হয়। তখন মা-মাছেরা কুমের ভেতরে এসে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ছাড়ে স্বচ্ছন্দে। মা-মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প হারে ডিম ছাড়ে। একে বলে ‘নমুনা’ ডিম ছাড়া। তখন যদি ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পায় তাহলে মা-মাছ নিজের দেহের মধ্যেই ডিমপুঞ্জ নষ্ট করে দেয়।
বিশেষজ্ঞের অভিমত
হালদা নদীর সমস্যা-সঙ্কট এবং সম্ভাবনা প্রসঙ্গে গতকাল (মঙ্গলবার) দৈনিক ইনকিলাবকে দেয়া সাক্ষাতকারে বিভিন্ন বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া। হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ড. মনজুরুল বলেন, মিঠাপানির বড় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী শুধু বাংলাদেশের নয়; পৃথিবীর অনন্য ঐতিহ্য ও সম্পদ। হালদার সমস্যা সম্পর্কে তিনি জানান, প্রধান সমস্যা নদীদূষণ। অক্সিজেন-কুলগাঁও এলাকা পর্যন্ত বামনখালী, খন্দকিয়া খালের তীরে অপরিকল্পিতভাবেই ‘অনন্যা’ আবাসিক এলাকা স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পুরোপুরি আবাসন গড়ে উঠলে বিশাল এলাকার বর্জ্য-আবর্জনা খালগুলো হয়ে হালদায় যাবে। নদীর পরিণতি ঘটবে বুড়িগঙ্গার মতো। ইতোমধ্যে বামনখালী খাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হালদা দূষণ রোধে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ড্রেনেজ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত হালদায় অবৈধ বালু উত্তোলন বিশেষ করে ড্রেজার দিয়ে নদীর তলদেশের মাটি খনন করে তোলার কারণে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন হালদার বালু উত্তোলন বন্ধ ঘোষণা করেছে, তবে তা যেন স্থায়ীভাবে বন্ধ থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত হালদা নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যাহার করা হচ্ছে। উজানে ফটিকছড়ির ভূজপুরে রাবার ড্যাম এবং গতিপথে বিভিন্ন স্থানে ১৮টি ¯øুইচ গেইট ও ধুরং কংক্রিট ড্যাম স্থাপন করা হয়েছে। এভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে কোনো পরিবর্তন ও প্রতিবন্ধক থাকতে দেয়া যাবে না। হালদাকে বাঁচাতে এগুলো তুলে নিতে হবে।
চতুর্থত হালদায় মা-মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। এরজন্য হালদার তীরবর্তী এলাকার জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করে মা-মাছ রক্ষা করা সম্ভব। হালদায় মা-মাছ নিধনসহ বেআইনী তৎপরতা রোধে সম্প্রতি অভিযানে ১ লাখ মিটার জাল আটক করা হয়। এতে বোঝা যায় হালদায় মা-মাছ নিধনের ভয়াবহতা। একটি মাছ মা-মাছে পরিণত হতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগে। পঞ্চমত হালদার উৎসস্থান মানিকছড়িতে শত শত একর জমিতে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। কেননা তামাকের বর্জ্য হালদায় গিয়ে মাছের স্বাভাবিক বিচরণ, প্রজনন পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে।
হালদা নদীর সম্ভাবনা তুলে ধরে ড. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, জোয়ার-ভাটা নির্ভর মিঠাপানির একমাত্র এ নদীতে রুই-কাতলা জাতীয় বড় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে এর অর্থনৈতিক সরাসরি মূল্য কমপক্ষে ৮শ’ কোটি টাকা। মা-মাছের ডিম সংগ্রহের ঐতিহ্য, উৎসব ও টেকনিক সারাবিশ্বের জন্য অসাধারণ এক ঐতিহ্য। যা ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবি রাখে।
তাছাড়া চট্টগ্রামের ৬৫ লাখ মানুষের জন্য বিশুদ্ধ মিঠাপানির সর্বাপেক্ষা বড় উৎস হালদা নদী। এখান থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার মদুনাঘাট পানি শোধন প্রকল্পের মাধ্যমে দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, নতুন আরেকটি প্রকল্পে আরও ৯ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাবে। হালদার সাথে মানুষের জীবন ও জীবিকা নিবিড়ভাবে জড়িত। এ নদী প্রাকৃতিক জীন ব্যাংক। এখানে রুই কাতলা জাতীয় মাছ প্রাকৃতিক পরিবেশেই ডিম ছাড়ে। হাইব্রিডের মাছের পোনার তুলনায় এর গুণগতমান, বর্ধনশীলতা ও অর্থনৈতিক মূল্য কয়েকগুণ বেশি। হালদায় বিশ্বের বিরল প্রজাতির প্রায় ২শ’ গাঙ্গেয় ডলফিন রয়েছে, যা সারাবিশ্বে আছে মাত্র ১২শ’টি।
বাংলাদেশের ৭ থেকে ৮শ’ নদ-নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। তবে হালদা হচ্ছে একমাত্র নদী যার উৎপত্তি বাংলাদেশে এবং শেষও দেশেই। আমি ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি হালদার সাথে কোন নদীর বিরল গুণগত বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বের তুলনা হয়না। সরকার ২৫ হাজার কিমি নৌপথ সংরক্ষণের অঙ্গিকার প্রদান করেছে। তাহলে মাত্র ১শ’ কিমি হালদা কেন সংরক্ষণ করতে পারছি না? হালদার মা-মাছ থেকে ডিম সংগ্রহ ও ফোটানোর বর্তমান ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরীয়ার অভিমত, সরকারি উদ্যোগে হ্যাচারিতে ডিম থেকে রেণু ফোটানোর কারণে অপচয় ও গুণগতমান নষ্ট হয়। এরজন্য জেলেদের অতীত ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে হালদা তীরে মাটির গর্ত বা কুয়ায় ডিম সংরক্ষণ করে রেণু পোনা ফোটানোর উদ্যোগের সাথে একটু আধুনিকায়ন হলেই তা সুফল দেবে। লাভবান হবে গোটা জাতি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।