Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

খেলাপি ঋণে রক্তাক্ত ব্যাংক খাত

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : ব্যাংকিং খাতে হু-হু করে বাড়ছে খেলাপিঋণ। পাহাড় সমান খেলাপি ঋণে রক্তাক্ত ব্যাংক খাত। গত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপিঋণ বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপিঋণ বেড়েছে। এতে সার্বিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপিঋণ ফের দুই অঙ্কের ঘর অতিক্রম করেছে। সবমিলিয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এ খাতে মোট খেলাপিঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা; যা এ সময় পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ স্বাধীনতার পর এ যাবত কালে সর্বোচ্চ। উল্লেখিত সময় ব্যাংক ব্যবস্থায় মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। তিন মাস আগে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে খেলাপিঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে, মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপিঋণের মধ্যে মন্দমানে পরিনত হয়েছে ৭৩ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এ মানের খেলাপিঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত ও আদায় জোরদায় করায় খেলাপিঋণ এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। কিন্তু চলতি বছরে খেলাপিঋণ আবার লাগামহীনভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো তাদের অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাই সেখানে ভালো অবস্থান দেখাতেই বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে থাকে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো-খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা নবায়ন। আর বছরের শেষ সময়ে এসে এই সুবিধা দেয়া-নেয়ার প্রবণতাও বাড়ে। এছাড়া শেষ সময়ে ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করা হয়। কিন্তু বছরের শুরুতেই ঋণ পুনঃতফসিল যেমন কম হয়, তেমনি আদায় কার্যত্রমেও সেরকম গতি থাকে না।
সূত্র বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে (নিয়মিত) বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আড়াই বছরেই এ সুযোগ নেন দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। এর আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। এর বাইরে বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলো নিজেরা আরও ৬৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করেছে। সবমিলে ওই সময় পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার ঋণ বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে ব্যাংক খাতে পাঁচশ’ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে- এরকম ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এসব ঋণ গ্রাহকরা যথাসময়ে ফেরত দিচ্ছে না। ফলে তা আবারো খেলাপি হতে শুরু করেছে।
সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেস্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপিঋণের সার্বিক পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। দেখা যাচ্ছে, শুধু পুনঃতফষসীল ও পুনর্গঠিত ঋণই নয়, অন্য ঋণও খেলাপি হয়ে পড়ছে। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপিঋণও অতিমাত্রায় রয়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক খেলাপিঋণ ফের দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে, যা উদ্বেগজনক। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে ব্যাংকের ঋণ পরিশোণ না করা যেন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ ঋণ ফেরত না দিলেও শাস্তি হচ্ছে না। যথাসময়ে যথাপোযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা না গেলে ঋণ ফেরত না দেয়ার এই প্রবণতা কমবে না বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তিস মাস আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপিঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপিঋণ বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। এর পরিমাণ ৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো। এ খাতের ছয় ব্যাংকে খেলাপিঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বিদেশী নয় ব্যাংকের বেড়েছে ৩৪ কোটি টাকা। তবে গত তিন মাসে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে নতুন করে খেলাপিঋণ বাড়েনি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তিন মাস আগে এই ছয়টি ব্যাংকের খেলাপিঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০১৮ সালের মার্চ শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২১ হাজার ২৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ শতাংশ। তিন মাস আগে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপিঋণ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। মার্চ শেষে বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩১ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০১ শতাংশ। তিন মাস আগে বিদেশী ব্যাংকগুলোর খেলাপিঋণ ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে, এ সময়ে সরকারি মালিকানার দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তিন মাস আগেও এই ব্যাংক দুটির একই পরিমাণ খেলাপিঋণ ছিল।
বিশ^ ব্যাংকের ঢাকা অফিসের মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণের উচ্চ পরিমান ও হারের কারণ ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতি।



 

Show all comments
  • সফিক আহমেদ ৪ জুন, ২০১৮, ৫:০৩ এএম says : 0
    ঋণ খেলাপি বন্ধ না হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার অবস্থা যে কী হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঋণ

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৯ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ