তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
আমাদের সাহিত্যের সেরা পাঠক আবুল কাইয়ুমের ভাষায়, রনপা।
ফাহিম ফিরোজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলা কবিতার নতুন নক্ষত্র- সৈয়দ আসরার আহমদ (কলকাতার প্রভাবশালী লেখক)।
এ সংখ্যায় বহুল আলোচিত ফাহিম ফিরোজের ভাতঘুম কব্যাগ্রন্থের একটি আলোচনা।
চিন্তার উত্তোরণ ক্লাসিক সাহিত্যের প্রধান দাবি। প্রচলিত সাহিত্য ধারার মধ্য থেকে যিনি নিজেকে ভিন্ন আঙিকে উপস্থাপন করতে পারেন তাঁর সৃষ্টিকর্ম ক্লাসিক মর্যাদা লাভ করতে পারে। তবে চিন্তার এই উত্তোরণ সহজসাধ্য ব্যাপার নয়- অনেক উুহড়সরপ মেধা ও মননের পরিচায়ক। বলা চলে মানস বিপ্লব। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার রাজ্যে সার্থকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন বলেই, রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব সাহিত্যে নিজেকে রবীন্দ্রনাথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
রবীন্দ্রত্তোর পান্ডব গোষ্ঠী বাংলা কাব্যে চিন্তার নতুন নতুন দিক উন্মোচন করেন। কালের দিক থেকে তাঁরা তিরিশের সারথি, ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রবিরোধী। প্রচলিত কলাকৈবল্যবাদের মধ্যে থেকেও এই গোষ্ঠী নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বাংলা কবিতাকে একটি আন্তর্জাতিক রূপদানের চেষ্টা করেছিলেন। এক্ষেত্রে সফলতা তাদের প্রশ্ন সাপেক্ষে হলেও, প্রচেষ্টা তাঁদের প্রশ্নাতীত। সেজন্যই রচিত অনেক কাব্যগ্রন্থই ধ্রূপদী সাহিত্যের আসনে সমাসীন।
বাংলা কবিতার নানা রকম বিষয় বৈচিত্র্য আনয়নে নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত। বিশেষ করে সামপ্রতিককালে বাংলাদেশের কবিতা, আঙ্গিকে এবং চেতনায় অনেক দূর এগিয়ে। বাংলাদেশের কাব্য সাহিত্যের এই অগ্রবর্তী ধারায় ফাহিম ফিরোজের ‘ভাতঘুম’ এক ভিন্ন মাত্রিক সংযোজন। কবির শ্রমনিষ্টা এবং বক্তব্যের ঋজুতা কবিতা প্রেমিককে ভাবিয়ে তুলবে। আটপৌরে জীবনের হতাশা, যন্ত্রণা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ‘ভাতঘুম’-এ একটি স্নিগ্ধ বাতাবরণ তৈরি করেছে। অন্যদিকে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক জৈবিকতার সুঃসাহসিক প্রকাশ এই ‘ভাতঘুম’ কাব্যগ্রন্থ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রথা, সমাজ-সংস্কার, মূল্যবোধ- কাব্যের ভিত্তিভূমিতে রসদ যুগিয়েছে।
সার্থক কবি কবিতার মাধ্যমে নিজেকে চিনিয়ে দিতে পারেন। সেজন্য কবিতা পাঠ মাত্রই কবিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া রচনারীতির বড় বৈশিষ্ট্য। বাংলা কাব্যে একাজটি কবি জয় গোম্বামীর পর ওমর আলী এবং ফাহিম ফিরোজ খুব সফলতার সাথেই চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ওমর আলী Reporting মেজাজে, অন্যদিকে ফাহিম ফিরোজ বিষয়- বৈচিত্র্য প্রসারিত। ভাতঘুম তাই বাংলা কবিতার ল্যান্ডমার্ক। এখানেই ফাহিমের সফলতা। এ তরুণ কবি হয়েও তিনি ইতোমধ্যেই পাকা স্থান দখল করেছেন।
উত্তর আধুনিক সাহিত্য তত্তের সিঁড়ি বেয়ে কবি ফাহিম ফিরোজ কাব্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার ‘ভাতঘুম’ কাব্য Post Mordernism ঘরানার বলিষ্ঠ দলিল। আধুনিকতার শীর্ষ বিন্দু থেকে পূর্বাপর বিষয় বৈচিত্রে ফিরে যাওয়া উত্তরাধুনিক সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য। তাই উত্তরাধুনিকতাবাদের দর্শন ও উত্তরাধুনিক ভাবুকেরা জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করবে মহান আখ্যান থেকে ক্ষুদ্র উপাখ্যানে অবতরণের মাধ্যমে। সেজন্য তাঁর কাব্যে আবহমান জাতিগোষ্ঠীর সুখ, দুঃখ হাসি-কান্না উৎসব ঐহিত্য সংকট-প্রত্যাশা ছত্রে ছত্রে কাব্যিক সুষমা বিলিয়ে যাচ্ছে।
আজকাল প্রথাবিরোধী শব্দটি খুবই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এর সঠিক ব্যাখ্যা অস্পষ্ট। যদি প্রথার বিরোধিতা করার মধ্যে চমক সৃষ্টির হীন কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্ম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসাবে চিহ্নিত হবে। সেক্ষেত্রে শিল্পকর্ম হবে স্বল্পায়ু এবং ষ্ট্র্যান্ডবাজি। ফাহিম সে পথে হাঁটেনি দেশীয় সংস্কার এবং প্রথা, ফাহিম ফিরোজের কবিতায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন। মাটি ও মানুষের খুব কাছ থেকে কবি জীবনকে উপলব্ধি করেছেন। ‘ভাতঘুম’ কাব্যে মানুষের আজম্ন সংস্কার এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ অপরিসীম সচেতনতার সাথে শিল্প সুষমা লাভ করেছে। মনে রাখা দরকার, সৎ সাহিত্য সব সময়ই ঐতিহ্যের ভিত্তিভূমিতেই লালিত হয়। এক্ষেত্রে ইংরেজ কবি এলিয়ট ঐতিহ্যের ব্যক্তি মনিসার মিশেল দিয়ে আধুনিক কবিতার ভিত রচনার পরামর্শ দিয়েছিলেন (Tradition and individul Talent) ফাহিম ফিরোজের মানস দর্শন সম্ভবত খুবই শেকড় সন্ধানী-জীবনস্পর্শি-
উদাহরণ :
কাসুন্দির আমভর্তা টেনে নিয়ে আসে সবার
ভাবীছাপের নিকট (দেখুন, ভাল ভাঙ্গা শিলা ঝড়)
আমিও আমার ঠোঁটে থেকে লইজ্জায়
ফেলে দিই স্মৃতিময় সেই
(টাঙ্গাইলের চমচম, বগুড়ার দই)
আর কুমিল্লার রসমালাই (নিমফল, কবিতার আঙুর)
ঐতিহ্য সচেতন কবি নিষ্ঠার সাথে সোনালী অতীতের প্রত্যক্ষ করেছেন। আবার যন্ত্র ও যান্ত্রিকতার যুগে সমাজ জীবনের নানামুখী অবক্ষর কবিকে শঙ্কিত করে তুলেছে।
ও বাহে? পর্ণো আগুন
পর্দার আড়ালে
শহর গেরামে হয়ে যাইচ্ছে
হা করা একেকটি অগ্নিসাগর (মিষ্টার পুঁজিবাদ/সুশীল সমাজের দাবি)
অজানা আশঙ্কা কবিকে ভাবিয়ে তুলেছে:
মাওইর কাপড় ছিঁড়ে গ্যাছে
এদিকে গোয়ালঘর আবার খাঁ-খাঁ, কত বিপদ
চারিদিকে ঘুর ঘুর পায়ে পায়ে (তালুই সাবের দিন চিত্র)
আধুনিক কবি মানস শুধুমাত্র দুঃখের সাগরে ভাসতে পারে না। জীবনে দুঃখ থাকবে, সমাজে থাকবে অবক্ষয়- তার পরেও এই যন্ত্রণা থেকে উত্তোরণ কবির একান্ত কাম্য
উদাহরণ :
সামনে বাসস্ট্যান্ড। তার আগেই দৃশ্যমান গ্রাম প্রধান-
ঘামছি। কাঁপছি। ও বাহে, এক গ্লাস জীবের দাবি
গ্লাসের ভেতরে দেখি সাপ হয়ে ফুঁসছে তখন
ছাপ্পানো হাজার বর্গ মাইল (বিয়াইন বিষয় ছাপচিত্র অসম সম্পর্ক নিয়ে)
জগতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য মাত্রই বঞ্চিত মানুষের হৃদয়ের কান্না। বঞ্চনা, শোষণ, এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফাহিম ফিরোজের কবিতা এক আগ্নেয় দলিল। পুঁজিবাদী অর্থ লোলুপ সমাজ ব্যবস্থার জঘন্য দিকটা ‘ভাতঘুমে’ নিষ্ঠার সাথে বানীমূর্ত লাভ করেছে। বিশ্বায়নের নোংড়া হাতছানি আমাদের প্রজন্মকে বিপদগামী না করতে পারে, তার জন্য কবি সচেতন, আবার শঙ্কিতও বটে। ‘সুদখোরের প্রতিকৃতি’ মিষ্টার পুঁজিবাদ। ‘পর্দার আড়ালে কি হচ্ছে এসব’ ইত্যাদি কবিতায় কবির মানস বিপ্লবের সামগ্রিক চিত্রটা অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘রক্তপুরান’ এ তাঁর দুঃসাহসিক উচ্চারণ।
উদাহরণ
বাঁচছি না মরছি কিছু বুঝি না
তবে খুবই অপরিহার্য, এইক্ষণে
পুরো জাতির রক্ত বদলের
তবে মিয়াভাই শর্ত একটাই
আগে পুলিশের.....
শব্দ কবিতার প্রাণ। S.T Coleridge বলেন “Best words in the best orders” অর্থাৎ সর্বোত্তম শব্দাবলীর যথাযথ বিন্যাস। ‘ভাতঘুম’ কাব্যে ফাহিম ফিরোজের শব্দ চয়ন বৈদগতা অনস্বীকার্য। শব্দের দিক থেকে বিচার করলে ফাহিম ফিরোজ বাংলা কবিতার একটা স্বতন্ত্র আসনের দাবিদার। বড় শব্দ কুশলী কবি তিনি। অথচ শব্দ নিয়ে কোথাও কোন জোর জবর দস্তি নেই- সবত্র শব্দগুলো অনায়াস গতি লাভ করেছে। আটপৌরে জীবনের নিত্য কোথাও কোন জোর জবর দস্তি নেই- সর্বত্র শব্দগুলো অনায়াস গতি লাভ করেছে। আটপৌরে জীবনের নিত্য ব্যবহার্য শব্দগুলো কিভাবে কবিতার অনুসঙ্গ হতে পারে ফাহিম ফিরোজ ‘ভাতঘুম’ তা স্পষ্ট করে তুলেছেন। “চাচাজান, বুবুজান, আম্মাজান ভাবিসাহেব, ভায়েরাপুত, দেবরপো, বিয়াই-বিয়াইন, মিয়াভাই এসব গ্রামীণ শব্দ আমাদের কবিতায় এই
প্রথমবারের মতো ব্যবহার করে কবি দেখিয়ে দিলেন কবিতা সব কিছুই ধারণ করতে পারে। অনেক তীর্যক গতি সমগ্র কবিতার রূপ পরিবর্তন করে দিয়েছে-
উদাহরণ:
উপরে কর্গেট টিনের উত্তাপ
নিচে পাছায় মাটির ভাঁপ (দেখুম ডাল ভাঙ্গা শিলা ঝড়)
শব্দগুলো যেমন সাবলীল তেমনি তীর্যক। অনেক স্থানে ক্রিয়াপদের আঞ্চলকি রূপ তিনি ব্যবহার করেছেন। খাতি, গুতি, আছিল ইত্যাদি আঞ্চলিক ক্রীয়া পদ কাব্যের অনেক কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেন।
কাব্যে ইতিহাস এসেছে। আছে মিথের প্রয়োগ। কবির ইতিহাস চেতনা সমাজ চেতনারই অংশ। এখানে ইতিহাস যেন অতীতের একজন শিক্ষক। যিনি বর্তমানকে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করেছেন। অশোক থেকে বিক্রমপুর সবই যেন কালিক দলিল, যেন প্রেরণার সেতুবন্ধন।
উদাহরণ
ভিক্ষুরা ছিল আমার আত্মীয়
আছিল রক্তের র্নয় কাছাত্মীয়- অশোক ছিল প্রতিবেশী
আগেই বলেছি কবির ইতিহাস চেতনা অতীত শিক্ষকের মত। অতীতই আমাদের সাফল্যের প্রেরণা
উদাহরণ:
তাদের সেই সব বেদনা এবং আজকের গৌরবের সাথে
আমরাও আমাদের সেই স্থানে পিনাবদ্ধ করতে চাই
কেননা, আমরা বাবা আদম শহীদকে খুইয়েছিলাম সেনাস্ত্রে
আর তা ফেরত পেয়েছিলাম, বহুবর্ষ পর স্বাধীনতা বৃক্ষটির ভেতর। (ঐ)
কাব্যে অসংখ্য মিথের প্রয়োগ আছে। কবির মিথ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বিষ্ণু দে কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মত কবিত্ব শক্তির সহায়ক উপকরণ হিসেবে এখানে মিথের প্রয়োগ আসে নি। বরং ঐতিহ্যের ম্রীয়মান ধারাকে ফিরিয়ে আনতে মিথ এখানে সহায়ক শক্তির আধার।
‘ভাতঘুম’ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, রগরগে যৌনতার সিম্বল কাব্য এটি। কবি ফ্রয়ডীয় যৌনতা গ্রহণ করেছেন অত্যন্ত নগ্নভাবে। সম্ববত ফাহিম ফিরোজ মানুষের আদিম প্রবৃত্তিতে অস্বীকার করতে পারেননি। সেজন্য তার কাব্যের আদিরসাত্বক চেতনা দুঃসাহসিক কাব্য ভাবনার প্রাথমিক প্রয়াস। সম্ভবত কবি আধ্যাত্মবাদের আদলেই জৈবকতার নিকটবর্তী হয়েছেন। সেজন্য ফাহিম ফিরোজ অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য। হয়ত অলস পাঠক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য কবির নয়। তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন, কবিতা বোঝার জন্য মেধা এবং মননের প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক : প্রভাষক, চুয়াডাঙ্গা সরকারী কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।