তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
এখন ২০১৮ সাল চলছে। কথা সাহিত্যিক শাহেদ আলী সাহেব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পনের বৎসর আগে ২০০১ সালের ৬ই নভেম্বর। আমার বয়সও তখন সত্তুর বছরের দ্বারপ্রান্তে। শরীর ও মনে অবসন্নতার ছায়া নেমেছে। জীবনের আনন্দ উল্লাস অনেকটা মøান হয়ে আসছে। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে থাকে বিদেশে। বাবাকে শেষ বিদায় জানিয়ে চলে গেছে নিজ নিজ ঠিকানায়।
বাড়িতে আমি এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে আছি। তারাও কর্মজীবি। সারাক্ষণ নানান ব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটে তাদের। আমি জীবনভর অধ্যাপনা করেছিলাম। এখন অবসরপ্রাপ্ত। আমার বড় ছেলে রুমী কানাডায় বিখ্যাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়ালমাট এর ফার্মেসী শাখার একজন ফার্মাসিষ্ট। একদিন তাগিদ এলো আমাকে কানাডায় বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে।
দেশ-বিদেশ ঘুরতে আনন্দবোধ করেছি আজীবন। এবার কিন্তু মনের বিশেষ সাড়া মিলছে না। তার পরেও মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা গোপন পুলক অনুভব করলাম। কয়েকদিন ভেবে-চিন্তে সাহস সঞ্চয় করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।
৭ই আগস্ট ২০০৫। রাত এগারটায় ড্রাগন এয়ারলাইন্সে যাত্রা শুরু হল আমার কানাডার পথে। আমাকে হংকং হয়ে কানাডায় যেতে হবে। হংকং এ যাত্রা বিরতি আট ঘণ্টা। তারপর কানাডা এয়ারলাইন্সে চড়ে আকাশ পথে পাড়ি দিতে হল টানা পনের ঘণ্টা।
সাধারণত বিমান ভ্রমণে আমি আনন্দ পাই। এবার যেন কোন আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি না। এর আগে আমি আরও কয়েকবার দূর দেশে বিমান পথে পাড়ি দিয়েছি। একা গিয়েছি সুইডেন, অস্টেলিয়া, নরওয়ে। পথে কোন কষ্ট ও অস্বস্তি বোধ করিনি। অচেনা জগত দেখার জন্য একটা দুর্বার আকর্ষণ মনকে টেনে নিয়ে গেছে। এবার অনুভব করলাম ব্যতিক্রম। এমন কাউকে পেলাম না যার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়।
তাছাড়া কানাডা এয়ার লাইন প্লেনটাও ভাল ছিল না। পরিসর সংকীর্ণ। সিটগুলো ছোট ছোট। একটানা প্লেন পাখা মেলে ক্ষণে মেঘের মধ্য দিয়ে ক্ষণে রোদের ঝিলিক মেরে উড়ে যাচ্ছে তার গন্তব্য পথে। এয়ার হোস্টেসরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে নীরবে। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে যে চারিদিক তাকাবে তারও উপায় নেই। অসহায়ভাবে বসে থেকে সময় দেখছি বারবার কখন এই বিরক্তিকর যাত্রার সমাপ্তি হয়।
অবশেষে এক সময় কষ্টকর বিমান ভ্রমণের অবসান হল। মাইকে উচ্চারিত হল কানাডা এসে গেছে। সবাই যার যার বেল্ট পড়ে নেন। কানাডার সবচেয়ে বড় এয়ারলাইন্স পোর্ট পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এয়ার কানাডার মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে আমরা যাত্রীরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। সঙ্গে রাখা ব্যাগ ও ব্যাগেজ হাতে নিয়ে সবার শেষে প্লেন থেকে নামলাম। আমি হুইল চেয়ারের যাত্রী ছিলাম বলে এয়ারপোর্টের ভেতরে আনুষ্ঠানিকতায় আমার বিশেষ কষ্ট পেতে হয়নি। হুইল চেয়ার ধরে যে মহিলা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল সেই সব কিছু ঠিক করে আমাকে নিয়ে এল বহির্গমনের দোরগোড়ায়।
প্লেন থেকে নেমে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। এতক্ষণের বিরক্তিকর যাত্রা এক নিমিষে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই সেই স্বপ্নের কানাডা। যার নাম অল্প বয়সি তরুণ-তরুণী থেকে মাঝারি বয়সের তরুণ-তরুণী সবার মুখে মুখে শোনা যায়। কানাডা বলে একটা দেশ আছে জানতাম। কিন্তু কোনদিন এদেশে আমি আসব একথা স্বপ্নেও ভাবিনি। আল্লাহর অশেষ মেহের বাণীতে সেই কানাডার মাটিতে আমি পা রেখেছি। শোকরিয়া আল্লাহর দরবারে। আগেই বলেছি কানাডা এখন সব বয়সি মানুষের স্বপ্নের ভূবন। সব মহলের মানুষেরা এখন কানাডার অভিবাসী হতে পারলে বিশেষ গৌরববোধ করে।
গেইটে অপেক্ষারত ছেলে রুমী, বউ লীনা ও নাতী ফাহাদ আমাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগ, ব্যাগেজ আমার কাছ থেকে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করল। ওদের দেখে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করলাম। প্রায় পাঁচ বছর পর ওদের সাথে আমার দেখা হচ্ছে। নাতি ফাহাদ অনেক বড় হয়ে গেছে। কথা বার্তা, আচার-ব্যবহার অনেক ধীর, স্থির, অমায়িক স্বভাবের।
এয়ারপোর্ট থেকে রুমীর বাসার দূরত্ব পয়তাল্লিশ কিলোমিটার। সবাই গাড়িতে বসে কথাবার্তা ও গল্পগুজব করে এগিয়ে যাচ্ছি বাড়ির দিকে। রুমীর বাসা কানাডার টরেন্টো শহরে। টরেন্টো কানাডার যে কোন এলাকা থেকে বড়। টরেন্টো অনটারিওর রাজধানী।
কানাডার পাঁচটি বড় লেকের মধ্যে অনটারিও একটি। রুমী গাড়ি ড্রাইভ করে এগিয়ে যাচ্ছে ওর বাসার দিকে। আমি শিহরিত হচ্ছি অভাবনীয় এক পূলক নিয়ে। টরেন্টোর নীরব শান্ত প্রকৃতির সৌম্য রূপ আমার চোখে প্রশান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিল। রাস্তার দুই ধারে দেশীয় বৃক্ষের শ্যামল পাতার বর্ণালী রঙ মনকে স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন করছে বারবার। সবুজ কারুময়তা ঘন বিটপীর সবুজাভ স্নিগ্ধতা গোটা রাস্তাটাকে মোহনীয় করে তুলেছে। মাঝে মাঝে বাড়িঘর, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, ছেলে-মেয়েদের স্কুল, প্রাইভেট কারের নীরব আসা-যাওয়া, বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ ঘাসের গালিচা সবকিছুতেই নতুনত্ব লক্ষ্য করছি।
কিন্তু সবুজাভ প্রকৃতিই টরেন্টোর প্রধান আকর্ষণ আমার কাছে। রাস্তার দুইধারে বৃক্ষগুলির মাটির বুকে চারিদিক শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে খুশিতে ডগমগ করছে যেন। নীরব, নির্জনতা, বোতল রঙা সবুজের আলো ছায়া দেখতে দেখতে এক সময় এসে গেলাম রুমীর বাসার সামনে। মহান আল্লাহতায়ালার শোকরিয়া জানিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। সুন্দর দোতলা বাড়ি তার। অনেক কষ্ট, শ্রম ও অধ্যাবয়াসের ফলে বাড়িটি করা সম্ভব হয়েছে। বাড়িটির ঠিকানা ৮৫ নং পাইনারি টেইল, স্কার ব্রো, টরেন্টো। সামনে ছোট একটি ফুলের বাগান। কাঠের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা বাড়ির চারিদিকের সীমানা। বেক ইয়ার্ডে বারবিকিউ এর জন্য টেবিল পাতা একদিকে। অন্য দিকে মিষ্টি কুমড়া, চাইনিজ লাউ গাছের লতা পাতা যৌবনের লাবণ্যে ডগমগ করছে। মাটিতে শুইয়ে আছে বিশাল আকারের একটা লাউ। উচ্চতা প্রায় আমার সমান। রুমী ও লীনা আমার অবাক হওয়া দেখে বলল, ইচ্ছে করেই লাউটি কাটিনি আপনাকে দেখাবার জন্য। এখনকার মাটি খুবই উর্বর এতদিনতো পতিত পড়েছিল। সবে নতুন নতুন বাড়িঘর হচ্ছে। ঠান্ডার দিন ছাড়া যে কোন সময় ফসলাদি লাগালে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে।
প্রথম দুই তিনদিন খুব ভালো লাগল। পরে নিজেকে খুব একাকি অনুভব করতে লাগলাম। সারাদিন ছেলে, বউ, নাতী, নাতনী সবাই বাইরে কাটায়। নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত সবাই। আমাকে সময় দেয়ার মত অবসর নেই তাদের। রবিবার পুরো দিনটা আর রাতে ঘরে পাওয়া যায়। কথাবার্তা আর গল্প গুজব চলে শুধু ভাতের টেবিলে। ভাতও প্রতিদিন রান্না করার সময় নেই তাদের। কোন সময় একদিন রেধে দুইদিনের খাবার ফ্রিজে রেখে দেয়। খাওয়ার সময় গরম করে খায়। আবার কোন কোন দিন হোটেল থেকে খাবার এনে রান্নার ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকে। ঘরে সপ্তাহের প্রায় দুই চার দিন আমাকে একা কাটাতে হয়। ওদের ছুটি নেই বলে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার অবকাশ মিলে না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে অবশেষে রুমী একটা উপায় বের করল।
নায়েগ্রা জলপ্রপাতের নাম সবার কাছে নিশ্চয়ই পরিচিত। কানাডায় আমার ভ্রমণ শুরু হল নায়েগ্রা জলপ্রপাত দেখার মধ্যে দিয়ে। একদিন ছুটির দিনে সবাই মিলে আমরা রওনা দিলাম নায়েগ্রা জলপ্রপাত দেখতে। রুমীর বাসা থেকে নায়েগ্রা ১৮০ কিলোমিটার দূরে। নায়েগ্রায় পাশাপাশি দুইটি জলপ্রপাতের অবস্থান। একটা টরেন্টোতে আরেকটা ইউএসএ-তে। সমতল জায়গা থেকে প্রবল বেগে পানির ঢল অনেকটা ঝুলান পর্দার মত গভীর পাদদেশে রংধনুর রঙ ছড়িয়ে তরঙ্গের উপর শুভ্র ফেনার পাহাড় সৃষ্টি করে অন্টারিও হ্রদের দিকে প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। রাতে নাকি নায়েগ্রার পানির উপর বিদ্যুতের ছটা এবং দিনে সূর্য কিরণের আলোক রশ্মি মিলে একটি ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। নায়েগ্রার জলপ্রপাত দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের অনেক পর্যটক এসে ভিড় করে। আকস্মিক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার রেলিংয়ের বেস্টনী দিয়ে দর্শকদের দাঁড়িয়ে দেখার ব্যবস্থা আছে।
আমরা অনেকক্ষণ অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অনন্ত যৌবনা নায়েগ্রার তরঙ্গায়িত রূপের খেলা দেখলাম। নায়েগ্রার আশপাশে অনেকদূর পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন বাগানে বাগানে সু-শোভিত। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে রাতে বাসায় ফিরে এলাম নায়েগ্রার মনোহর রূপকে চোখে বন্দী করে।
আবার কিছুদিন আমি ঘরে একটানা বন্দী। ঘরে অনেক বই। আমার বড় নাতনী ওর দাদার মত অনেকটা সাহিত্য মনস্ক। মনটা মাঝে মাঝে ভারী হয়ে থাকে। তখন ওর ঘরে গিয়ে বই পড়ি। তবুও দিন কাটে না। রুমী এবং তার মত যারা অভিবাসী হয়ে কানাডা এসেছে তাদের একটা দল এই জায়গার প্রথম অভিবাসী।
আমি যেদিন প্রথম রুমীর ঘরে এসে ঢুকেছিলাম, রুমী বলেছিল- সে ও তার মত টরেন্টোতে নতুন অভিবাসী হয়ে আসা ছয়শত পরিবারের আবাসন ভূমি এই এলাকা। তিন বছর আগে বাসা কেনার পর যখন প্রথম বাসায় আসে তখন চারিদিক গহীন ঝোপঝাড়ে ভরা ছিল। মাঝে মাঝে শিয়ালের মত অদ্ভুত জন্তু জানোয়ার এখানে সেখানে দেখা যেত। এই সব প্রাণী নাকি খুবই হিংস্র। মানুষকে কামড় দিলে তাকে বাঁচানো দুঃসাধ্য। অথচ, এখন দেখেন তিন বছরের মাথায় কেমন বদলে গেছে জায়গাটির চেহারা। সুন্দর, পরিষ্কার জনবসতিপূর্ণ এলাকা হয়েছে।
খালি ঘরে একা থাকলে যখন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ যায়, দূরে দূরে কিছু গাছপালা দেখা গেলেও বাড়ির সম্মুখে এবং পিছনে একলাইনে সারি সারি এক প্যাটানের অনেক বাড়ি দেখা যায়। তখন রুমীর প্রথম দিনের সেই কথাগুলো মনে পড়ে।
ঘুমিয়ে থাকা বাড়িগুলোর মৌন গাম্ভীর্য দেখে আমার মনেও একধরনের বিষণœতার ছায়া ফেলে। এত একা এত জনমানবশূন্য পৃথিবীতে মানুষ বাঁচে কেমন করে জানি না। এখানে অভিবাসী হয়ে আসা লোকজনদের কাজকর্ম, হাসিখুশি মুখ দেখলে নিজের বিষণœতার কারণ খুঁজে পাই না। মাঝে মাঝে নাতনী ফারাহকে নিয়ে বিকেল বেলা বেড়াতে বের হই। রুমীর আশপাশে অনেকেই বাড়ি কিনেছে। কেউ আফ্রিকার কেউ শ্রীলংকার তাছাড়া পাকিস্তানি ও বাঙালিদের অভাব নেই। তাদের চলাফেরা ও পোশাকের ভিন্নতা চোখে পড়ে। কিন্তু ফুল বাগানটা সবার বাড়ির সামনে একই রকম। হাঁটতে বের হলে ফুলের বাগানের শোভা চোখ টানে।
টরেন্টো বড় শহর। সেই অনুপাতে এখানে লোকসংখ্যা কম। সরকারের অসাম্প্রদায়িক মনভাবের কারণে বিশ্বের জনগোষ্ঠির জন্য এদেশের দ্বার উন্মুক্ত। কিছু কিছু শর্ত পালন করতে পারলে এইদেশ বিশ্বমানবের চিরস্থায়ী ঠিকানা হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি নানান বর্ণ, জাতি নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষা করে পারস্পারিক সৌহাদ্যের বন্ধন বজায় রেখে বসবাস করতে পারে।
রুমী ও লীনার চেষ্টা চলছে আমাকে টরেন্টোর দর্শনীয় জায়গাগুলো কেমন করে দেখানো যায়। ১৬ই আগস্ট ২০০৫ আমাকে নিয়ে গেল অন্টারিও লেকে স্পীড বোর্ডে চড়ে বেড়াতে। রুমী, ফারাহ, লামিহা ও লীনাসহ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম ইতিহাস খ্যাত অন্টারিও লেকের বুকের উপর। এই লেকের পশ্চিম তীরে নি¤œভূমিতে গড়ে উঠেছে টরেন্টো শহর। এখানে অনেক শ্বেতাঙ্গদের বসবাস। শহরে আসতে হলে ওরা ফেরীতে আসে। লেক ভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম শহরে। ইতিহাস বলে প্রায় চৌদ্দ হাজার বছর আগে বরফ ও হিমবাহে নিমগ্ন ছিল এই সুন্দর শহরটি। এই লেকের পশ্চিম তীরের শেষ মাথায় খ্রিস্টীয় এক হাজার বছর আগে এবরিজিনরা এসে বসতি করেছিল। শিকার করা, মাছ ধরা ও চাষাবাদ করাই ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম।
পরে আবার যেতে হল রুহীর বন্ধু মনিরের বাসায়। মনির থাকে হ্যামিল্টন শহরে। কানাডার মধ্যে নবম বৃহত্তম নগরী। এখানে অভিজাত নাগরিকদের প্রাধান্য বেশি। উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা। মনিরের বাসার কাছে আসতে মনে হল তাসমানিয়ার লনচেস্টনের মত সুন্দর ও ছিমছাম পরিপাটি। এখানে এসে দেখা পেলাম, মনিরের খালু ড. কাইয়ুম ও তার সহধমির্ণী ড. রাজিয়া সুলতানার সাথে। দু’জনেই বিদগ্ধ গুণীজন।
১৯৫৪ তে আমরা তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলাম। মনির আমাদেরকে পেয়ে মহাখুশি। সে তার বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখাল। বেজমেন্ট দেখাল। অবাক কান্ড এই অল্প বয়সি ছেলেটি হ্যামিল্টনের মত জায়গায় তার পূর্ব পুরুষদের ভুলেনি। সবার ছবি সংগ্রহ করে বেজমেন্টের একটা রুমে সাজিয়ে রেখেছে। আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম মনিরের বাসায়। সে আমাদের বারবিকিউ করে খাওয়াল। তারপর ফিরে এলাম রুমীর বাসায় অনেক আনন্দ বুকে ধরে। প্রথম দিকের মনের মধ্যে যে বিষণ্ণতা ছিল সব যেন কোথায় ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
পরেরদিন ছিল শুক্রবার। রুমীর পরিবারসহ এলাকার বিখ্যাত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদে জুমার নামাজে সামিল হলাম। আমার মনে হল জীবনে আমার বিরাট প্রাপ্তি এই নামাজে শরিক হওয়া। গোটা হল জুড়ে মেয়েদের জন্য জামাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছেলেদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা আছে।
সরকারের উদার মানসিকতা কারণে এই দেশ বিশ্ব মানবের কাছে মিলন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। অনাস্বাদিত তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। এর পরে দেখার মত দর্শনীয় আরও বহু কিছু থেকে গেল। তারপরেও সময় করে রুমী দেখাল ঈঁষষবহ এবৎফবহ ও মিনিয়েচার ভিলেজ নামে পরিচিত দুইটি দর্শনীয় স্থান। এই সিটির নাম হুইটবাই নামের এক সাহেব ও তার স্ত্রীর নামে। তারা দুজনেই পৃথিবীর নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে দর্শনীয় বাগান ও পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত জায়গাগুলো দেখে স্বপ্নের মত একটা বাগানের রূপ দিয়েছে এই জায়গাটিতে। ৩৬ একর জমির উপর কত বিচিত্র কায়দায় অগণিত ফুলের এবং বনসাই জাতীয় গাছের বাহারি শোভা দেখলাম যে তার কোন রকম বর্ণনা দেওয়ার ভাষা আমার নাই।
মিনিয়েচার ভিলেজে ১৬০ একর জমির উপর অনেক বিল্ডিং, কটেজ, ছোট ছোট ঘর, গীর্জা, সামরিক ছাওনি, পুকুরের মধ্যে ছোট ছোট স্পীড বোর্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট রেললাইন বাগানের মধ্যে দিয়ে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছোট ছোট ট্রেন, মালগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে। সোজা কথা এই বাগানটা দেখলে মনে হয়, মর্ত্যরে পৃথিবীতে আমি যেন বেহেস্তের নমুনা দেখছি। এইসব দেখে দুর্ভাগা বাংলাদেশি ভাইবোনদের জন্য মনটা হাহাকার করে উঠল। জানি না ওদের মধ্যে কারা কারা এই সমস্থ অভাবনীয় শিল্প কৌশলের দেখা ও জানার সুযোগ পাবে।
দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। আমার দেশে ফিরে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। টরেন্টোতে আমার আত্মীয়-স্বজনদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু সবার বাড়ি যাওয়ার সময় কই। সময় পেলে কারও কারও বাড়িতে রুমী নিয়ে যাচ্ছে। কেউবা নিজে নিজে আমাকে দেখতে আসছে। হৃদয় দেওয়া ও নেওয়ার এক উৎসব মুখর জগতের ভ্রমণচারী আমি। উত্তর আমেরিকার শেষ মাথায়, দেশ থেকে অনেক দূরে পরিচিত স্বজনদের হৃদয়ের এমন উষ্ম উত্তাপে অভিষিক্ত হব তা ভাবতেও পারিনি।
আরেকদিন রুমী আমাকে নিয়ে বের হল পৃথিবীর আদিমকাল থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত ব্যবহৃত জুতা সংরক্ষণাগার দেখাতে। সভ্যতার অগ্রগতিতে অসভ্য, অশিক্ষিত এবরিজিনদের ব্যবহৃত জুতা থেকে শুরু করে রাজ-রাজড়াদের খেয়াল খুশির কারণে মোগল হেরেমের বেগমদের সৌন্দর্য্য প্রকাশের লক্ষ্যে কত রকমের জুতো তৈরি হয়েছিল তার প্রদর্শনীর কেন্দ্র।
দেখলাম শুকনা, খড়, ও চুল দিয়ে তৈরি জুতো।
দেখলাম গ্রিস, মিশরীয়দের ব্যবহার্য ছেড়া জুতো, পুরোনো জুতো, দড়ির তৈরি জুতো, লোমের জুতো সযত্নে শোকেসে ঠাঁই করে নিয়েছে। ডায়নার ব্যবহার করা শেষ জুতো দেখে বেরিয়ে এলাম। মুসলমানদের যুগে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ব্যবস্থা চালু হলে জুতোর ব্যবহারে পরিবর্তন হয়। এই প্রদর্শনীয় কেন্দ্রটা বাটা কোম্পানীর। অনেক ধরনের জুতোর কথা বাদ দিয়ে ডায়নার জুতোর সামনে এসে দাঁড়ালাম।
রোজা শুরু হয়ে গেছে। প্রকৃতির মনের রংয়ের পরিবর্তন ঘটে ঋতুভেদে, প্রকৃতির মনে এখন খুশির ছোঁয়া। যেদিকে তাকাচ্ছি গাছে গাছে লাল, হলুদ রং গায়ে মেখে সারা টরেন্টোতে হলি খেলার উৎসব চলছে। গাছের নিচে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে লাল, হলুদ, কমলা রঙের বর্ণিল পাতা। তাসমানিয়ার নার্সারিতে পাঁচ হাজার ফুলের নমুনা দেখেছি। কিন্তু গাছের পাতার এত বাহার দেখিনি।
এখন নভেম্বর মাস। গোটা শহরের স্নিগ্ধতা স্রোত শুভ্র বরফের আবরণে ঢাকা। টরেন্টোর নতুন রূপ দেখে আমি ব্যথাকাতর। ঘরে বসে আমি দেখছি গোটা বনভূমি বরফের শুভ্রতায় ঢেকে আকাশের সাথে মিতালি পেতেছে। বাড়িঘর, ছাদ, বাগান দেখি শুধু সাদা আর সাদা। তুষার কণা ভেসে বেড়াচ্ছে ধুনো তুলার মত টরেন্টোর আকাশে। শত সংস্কৃতির মিলিত জয়যাত্রার দেশ মানবতার জয়গানে প্রকৃতির শুভ্রতায় এক অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সব রকম মালিন্যের উদ্ধে তুষার শুভ্র পবিত্রতার পোশাক গায়ে মাখা একটা নতুন পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আপাতত আমার ভ্রমণ কাহিনীর কিছু কথা পাঠকদের উপহার দিয়ে ইতি টানলাম।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।