Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনুশোচনা

ফ রি দা হো সে ন । | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বরফ কুচীর মতো হিম ঝরা পৌষালী রাত।
রিকশায় উঠে জুত হয়ে বসতে যাব- এমনি সময় দেখি, একটি ছোট্ট মানিব্যাগ পড়ে আছে পা দানির উপর।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে অবাক হলাম।
বেশ ভারী ব্যাগটা।
দেখলাম লোলুপ দৃষ্টিতে চিক চিক করে উঠলো রিকশাওয়ালার কোটরগত চোখ দু’টো।
বলল.....
: ইধার মিললো হুজুর?
বললাম...
: এইতো পা দানিতে পড়েছিল। নিশ্চয়ই কোন প্যাসেঞ্জারের।
: আলবাৎ হুজুর।
আমার কথার মাঝখানেই বলল রিকশাওয়ালা।
দেখলাম-কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করছে সে।
একটা অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য ফুটে উঠেছে ওর-চোখে মুখে।
হঠাৎ আমার চোখে চোখ পড়ায় সহজ হবার চেষ্টা করে হেসে ফেলে বলল...
: হে: হে: বাবুজী।
রিকশাওয়ালার মনের অবস্থা আঁচ করে বললাম।
: তা আমি একটু পরে এলেই তো তোমার হয়ে যেতো ব্যাগটা। কি বল?
আমার কথায় বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললো রিকশাওয়ালা।
তারপর বলল...
: বদ নসীব হুজুর।
ব্যাগটা খুলে দেখলাম, একশো টাকার অনেকগুলো নোট। গুণে দেখলাম, এক হাজার টাকা। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এই দুর্মূল্যের দিনে এক হাজার টাকা মানে অনেকগুলো টাকা।
যার গেছে সে জানে কি গেছে।
কিন্তু আমি এখন কি করব? চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। কনকনে শীতের হাওয়া এসে বিঁধছে গায়ে সুঁচের মতো।
এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন কোনদিন হইনি। সুতরাং ভাবতে হচ্ছে। রিকশাওয়ালার দৃষ্টিবান লক্ষ্য করলাম। হঠাৎ খেয়াল হল নির্জন রাস্তায় এভাবে থাকাটা ঠিক নয়।
নড়ে ঠিক হয়ে বসে বললাম...
: চল।
: কি ধার যাব হুজুর?
পাল্টা প্রশ্ন করলো রিকশাওয়ালা।
সত্যি তো। কোথায় যাব?
যেখানে যাবার ছিল তার প্রয়োজন এখন ফুরিয়েছে।
এই টাকাগুলো নিয়েই তো বিপদ।
ব্যাগে মালিকের কোন নাম বা ঠিকানা কিছুই নেই।
এলোমেলো অনেক কথাই মনে আসতে লাগলো।
শেষে অনেক ভেবে চিন্তে -পত্রিকা অফিসে জমা দেওয়াই ঠিক করলাম।
রিকশাওয়ালাকে বললাম।
: ইত্তেফাক অফিসে চল। টাকার ব্যাগটা সেখানেই জমা দিয়ে আসি। দরকার হলে যার টাকা তিনি এসে নিয়ে যাবেন।
আমার কথায় যেন ভীষণ অবাক হলো রিকশাওয়ালা। অবিশ্বাস্য সুরে বলল...
: জমা দিবেন? আপনি নিবেন না?
: আমি!
হাসি পেল আমার।
বললাম...
না: আমি নেব কেন? পরের টাকা।
: তবু হো হাজার রূপেয়া হুজুর।
: হলোই বা...
পরম বিস্ময়ে বার কয়েক আমার আপদ মস্তক দেখে নিয়ে নিজের সীটে উঠে বসলো রিকশাওয়ালা। রিকশার গতি কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। আবার কখনো বা থামতে থামতে আরো জোরে টেনে চলেছে।
কিছু দূর এগুবার পর মুখ খুললো রিকশাওয়ালা।
বলল...
: হুজুর একটু আগে এক সাহেবকে তার বাড়ি পৌঁছে দে এলাম। আমি বলি কি, এই টাকা ওই সাহেবের।
: ঠিক জান?
: মুই ঝুট বলছি না হুজুর।
ঢোক গিলে উত্তর দিল রিকশাওয়ালা।
হঠাৎ কিছু বলতে পারলাম না।
মিথ্যাও তো হতে পারে।
লক্ষ্য করলাম আমার উত্তরের প্রতীক্ষায় উসখুস করছে রিকশাওয়ালা। চাকার গতি কমে গেছে আপনা থেকেই।
বললাম...
: না থাক। তুমি পত্রিকা অফিসেই চল।
চুপ করে রইল রিকশাওয়ালা।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটালো।
বুঝলাম আমার কথাটা ওর পছন্দ হয়নি।
রাস্তা কেটে কেটে রিকশাটা এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
হঠাৎ একটা বুক ভাঙ্গা আকুতিতে চমক ভাঙলো। কি এক অব্যক্ত ব্যথা যেন ডুকরে উঠলো রিকশাওয়ালার কণ্ঠে....।
: হুজুর।
: কি হলো।
: বদ-নসীব হুজুর আমার বদ-নসীব। মনে হলো যেন এখুনি ভেঙ্গে পড়বে রিকশাওয়ালা।
বললাম...
: কি চাও। কি বলতে চাও তুমি...?
আমার বদ-নসীব হুজুর। জীবন ভর সুখ পেলাম না। আপনি গরীবের মা-বাপ হুজুর। একটু দয়া করুন।
বলে এবার হু হু করে কেঁদে উঠলো রিকশাওয়ালা। হঠাৎ কিছু বুঝতে না পেয়ে থ’হয়ে রইলাম।
তারপর...
রিকশাওয়ালা ব্যর্থ জীবনের পুঞ্জীভূত বেদনায় গড়া ইতিহাস যখন আমায় শোনালো, তখন ওখানে স্থির হয়ে বসে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
টুকরো টুকরো কতোগুলো দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। জীবন যুদ্ধে পরাজিত ক্লান্ত এক পরিবার। ম্যালেরিয়া গ্রস্থ স্ত্রী। এক পাল কঙ্কালসার ছেলে-মেয়ে। “কুৎসিত আইবুড়ো মেয়ে টাকার অভাবে বিয়ের বাজার বন্ধ...।”
এদো পাড়ার, নোংরা বস্তীর অশ্লীল পরিবেশ।
একটা অসহ্য যন্ত্রণায় বুকটা আমার মোচড় দিয়ে উঠলো। আর ভাবতে পারলাম না।
রিকশা এসে থেমে গেছে পত্রিকা অফিসের সামনে। নামতে হলো। হাতের মুঠিতে তখনো ধরা রয়েছে টাকার ব্যাগটা।
পকেট থেকে টাকা বের করে ভাড়াটা দিতে গিয়ে বাধা পেলুম। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আমার পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়লো রিকশাওয়ালা।
বলল...।
: এ টাকাটা জমা দিবেন না হুজুর। এটা আপনাদের কাছে কিছু না। কিন্তু আমার কাছে এ টাকার দাম অনেক।
এ টাকা মালিক না পেলেও হয়তো কোন লোকসান হবে না। মাগার মোর সংসারের আগুন নিভবে। মেয়েটার সাদী হবে। জনমভর আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব হুজুর, দয়া করুন।
দু’হাত আমার পা জড়িয়ে ধরলো রিকশাওয়ালা। ওর অশ্রæ আমার পা ভিজিয়ে দিল।
মুহূর্তের জন্যে কেমন যেন হয়ে গেলাম।
কলের পুতুলের মতো টাকার ব্যাগটা এগিয়ে দিলাম। রিকশাওয়ালার দিকে। এরপর যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম-দেখলাম কেউ কোথাও নেই। শুধু হিম ঝরা কুয়াশাময় আকাশের নীচে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো- একি করলাম?
ভালো-কি মন্দ?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছি বহুদিন।
ভেবেছিও অনেক।
এরপর সেই ভাবনা ধীরে ধীরে কখন মনের আঙ্গিনা থেকে মুছে গেছে টেরও পাইনি।
আজও ছিল তেমনি এক পৌঁষালী রাত।
অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল সেই রিকশাওয়ালার সাথে।
ইসলামপুরের এক ঘিঞ্জি গলি। বোধ হয় মদ খেয়ে ঢুকছিল লোকটা একটা পুরোন বাড়ির সিঁড়িতে বসে।
চিনতে না পারাটাই স্বাভাবিক।
জট পাকানো একরাশ চুল-দাড়ি।
পরনে তেলচিটে নোংরা কাপড়।
শুনেছি জায়গাটা ভালো নয়।
তাই লম্বা লম্বা পা ফেলে পেরিয়ে যাচ্ছিলুম গলিটা।
এমনি সময় কানে এলো...
: হুজুর...
চমকে উঠলাম।
কি এক অজানা ভয় যেন বুকের মধ্যে ফণা তুলে উঠলো।
সিঁড়ি ছেড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা।
চলতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। বুকে টিপ টিপ শব্দটা ঘড়ির কাঁটার মতো স্পষ্ট হয়ে কানে বাজতে লাগলো।
হঠাৎ দু’পাটির দাঁত বের হয়ে হেসে উঠলো লোকটি।
: হে: হে: বাবুজী। ঠিক ঠাহর করেছি।
পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলাম কিন্তু পথ আগলে দাঁড়ালো লোকটা।
বলল...
: হ্যাঁ সেই হুজুর...
উ: অসহ্য।
সাহস সঞ্চার করে ধমকে দেবার ভঙ্গিতে বললাম...
: পথ ছাড়ো...
: আরে হুজুর তোমার মনে নাই-সেই হাজার রূপেয়া?
: ভাবলাম নির্ঘাত পাগল। না হলে এমন করে!
: আর টাকার ব্যাগ মেলে নাই হুজুর....!
হঠাৎ এক ঝটকা হাওয়ায় স্মৃতির পর্দা সরে গেল।
মনে পড়ে গেল সব।
কিন্তু...
একি সেই রিকশাওয়ালা?
কি অদ্ভুত পরিবর্তন ওর...?
নিজের অজান্তে হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
: মেয়ের বিয়ে দিয়েছো?
: বিয়ে! না: পারলাম না।
: পারলে না। পারলে না কেন?
আমি ততক্ষণে অনেকটা সহজ হয়ে এসেছি।
রিকশাওয়ালা বলল...।
: হ্যাঁ সাহেব দেখছো না কেমন আরামছে আছি। ঘর নেই, দোর নেই, বউ বচ্চার ঝামেলা নেই, সব শালা মরে ভূত হয়ে গেছে।
: এসব কি বলছো তুমি? তোমার পরিবার?
: ঠিক বলছি হুজুর। আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ির দিকে গেলুম। পথে ভাবলাম, বহুত দিন শরাব পি নাই। সাথে এক ইয়ার ভি ছিল দু’জনে মিলে ডাটসে শরাব পিলাম। বাড়ি গেলাম অনেক রাত করে। গিয়ে শুনলাম মেয়েটা কোন এক লেড়কার সাথে পেলিয়ে গেছে। আর পেটরা খুলে কিছু টাকা ভিলিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকতেই ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে এলো বউটা। মেজাজ বিগড়ে ছিল। দিলুম শালীর পেটে এক লাথি আর অমনি তড়াক করে দাওয়ার নীচে পড়ে ভিমরী খেলো হারামজাদী। ইয়ারটা ধারে কাছেই লুকিয়ে ছিল। টাকা চুরি করেছি বলে পুলিশ ধরিয়ে দিল।
দু’বছর বাদ শুশ্বর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছি। কাল রাতে এক বাড়িতে ঢুঁ মেরেছিলাম। মাগার কিছু লিতে পারিনি। আজ রাতে ভি ঢ়ুঁ মারবো।
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম এতোক্ষণ।
হঠাৎ একটা বিশ্রী হাসির শব্দে চমকে উঠলাম।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকার প্রবৃত্তি ছিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে দ্রæতপায়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একটা অপরাধ বোধ যেন আমার মধ্যে জেগে উঠলো।
সেদিন এই রিক্সাওয়ালার হাতে ওই টাকার ব্যাগটি দিয়ে আমি কি যে ভুল করেছিলাম...?
ওর আজকের এই জীবনের জন্য কি আমি-ই দায়ী...।
তীব্র এক অনুশোচনায় বুকের ভেতরটায় ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন