০ উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের বেশিরভাগ নারী
০ পূজিবিহীন ব্যবসায় ঝুঁকছেন শিক্ষার্থী ও গৃহিনী
০ প্রায় ১৫ হাজার পেইজে চলছে কেনাবেচা
ফারুক হোসাইন : ফেইসবুক এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ নেই। পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদান, তথ্য বিনিময়ের পাশাপাশি এই মাধ্যমটি এখন ভার্চুয়াল মার্কেট হিসেবেও গড়ে ওঠেছে। ঘরে বসেই পছন্দের জিনিস হাতে পাওয়া, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটা। অনলাইন কেনাকাটায় পিছিয়ে নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকভিত্তিক পেইজগুলোতে। বিনাপূঁজিতে ব্যবসার সুযোগ থাকায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও আগ্রহী হচ্ছেন এতে। সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বিও হচ্ছেন অনেকেই। ফেইসবুকে নির্দিষ্ট পণ্য কিংবা ভিন্ন কোন নামে পেইজ তৈরি করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাতে বিক্রি করছেন দেশি বিদেশি নানান ধরণের পণ্য। আর ফেইসবুক কেন্দ্রীক বিপণনে উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই নারী। এসব অনলাইন পেইজে নারীদের জন্য শাড়ি থেকে শুরু করে সালোয়ার, দেশিয় হস্তশিল্পের জুয়েলারি, বিদেশি জুয়েলারি, দেশি-বিদেশি প্রসাধনী পণ্যের আসরই বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া দেশীয় বাজারে সহজলভ্য নয় এমন ‘এক্সক্লুসিভ প্রোডাক্ট’ কেনার জন্যও দারুণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেইসবুক পেইজগুলো। বাদ যাচ্ছে না স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসক পরামর্শও।
উদ্যোক্তা এবং ক্রেতারা জানান, গৃহবধু থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পণ্য ও সেবা দিয়ে আয়ের পথ তৈরি করছেন। ফেইসবুক উদ্যোক্তারা আরও জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন শপিংয়ের সবচেয়ে সহজ হলো এর জন্য কোন পূঁজির প্রয়োজন হয়না। প্রয়োজন নেই কোন বাড়তি জায়গা বা লোকবলেরও। বিক্রেতার সঙ্গে ফেইসবুক পেইজে বা ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। কোনো পণ্য না থাকলেও ফেইসবুকের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তা আনিয়ে দেয়। উদ্যোক্তাদের মতে, নতুনদের পাশাপাশি বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেইসবুক। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। কোনো দোকান ঘর লাগে না, ব্যবসা পরিচালনা করা যায় ঘরে বসেই। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এ মাধ্যমটি।
ফ্যাশন ডিজাইনার আলী আফজাল নিকোলাসের ফেইসবুক পেজ ‘ত্রয়ী’ জনপ্রিয় একটি অনলাইন শপ। দেশীয় শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জবিসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে ত্রয়ীতে। ঈদ উপলক্ষে জর্জেট ও সিল্কের লং এবং শর্ট সিøভসের কারচুপি কাজের বেশ কিছু নতুন ডিজাইনের গাউন পাওয়া যাচ্ছে ত্রয়ীতে। ফেইসবুক পেইজে পণ্য বিক্রির উদ্যোক্তা নওরীন আক্তার বলেন, তার পেইজে লাইক বাড়ছে সাথে সাথে বিক্রিও বাড়ছে। তিনি পেইজে হ্যান্ড মেড পণ্য বিক্রি করেন। বিশেষ করে হ্যান্ড মেড জুয়েলারি। নওরীন বলেন, নিজে পড়ার জন্য শখের বসে প্রথমে গহনা তৈরি করতাম। এগুলো দেখে আশপাশের অনেকেই প্রশংসা করতো। অনেকেই আবার চেয়ে নিত। এ থেকেই আমার হ্যান্ড মেড গহনা বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে। আর সেখান থেকেই ফেইসবুকে অনলাইন শপ-এর কাজ শুরু করি। প্রচুর সাড়াও পাচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেইসবুক পেইজে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে সুতি, জামদানি, মসলিন, সিল্কের শাড়ি, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক, আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, শার্ট, জিন্স প্যান্ট, আমদানি করা জুয়েলারি, ঘড়ি, চশমা, চামড়ার বেল্ট, কিডস আইটেম, সাজ কিংবা হেয়ার স্টাইল পণ্য, ওয়ালেট, ঘর সাজানোর সামগ্রী, বিউটি কেয়ার প্রডাক্টসহ নানা পণ্য। রঙ, সাদা-কালো, প্রবর্তনা, নগরদোলাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকও বিক্রি হচ্ছে ফেইসবুক পেইজে।
অনলাইন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর জানান, বাংলাদেশে দু’ধরনের অনলাইন শপ আছে। এক ধরনের হলো যারা নিজেরাই ওয়েবসাইট খুলে পণ্য কেনা-বেচা করেন। আরেক ধরনের হলো ফেইসবুকে পেইজ খুলে কাজ করেন। তবে ফেইসবুকে কতগুলো পেইজে কেনাবেচা হচ্ছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল জানান ফাহিম।
বাংলাদেশে এখন ফেইসবুক ভিত্তিক ই-কমার্স সবচয়ে দ্রæত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইক্যাব)-এর সাবেক সভাপতি রাজীব আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন ওয়েবসাইট ভিত্তিক এক হাজার এবং ফেইসবুক ভিত্তিক আনুমানিক ১৫ হাজারের মতো ই-কমার্স সাইট আছে।
ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে নিয়মিত কেনাকাটা করা ফারজানা সুলতানা বলেন, অনলাইন শপ আমাদের অনেক সময় ও টাকা বাচায়। যানজট পাড়ি দিয়ে শপিংমলে গিয়ে দরকষাকষিতে অনেক সময় ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু অনলাইনে পণ্য দেখে অর্ডারের সুযোগ আছে, পছন্দ না হলে ফেরতেরও সুযোগ থাকে। তিনি বলেন, যদি ই-কমার্স সাইটগুলো তাদের সততা ধরে রাখে তাহলে আগামীতে দেশের অর্ধেক লোকই অনলাইনে কেনাকাটা করবে।
শারমিন আক্তার নামে আরেকজন ক্রেতা বলেন, যে কোন পণ্য কিনতে চাইলে বিভিন্ন পেইজে ঘুরে ফিরে দেখা যায়। এছাড়া পেইজগুলোতে লাইক দিয়ে রাখার কারণে যে কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনই ফেইসবুক খুললেই দেখা যায়। তাছাড়া বিদেশি কসমেটিকস পাওয়া যায় এমন পেইজেরও কমতি নেই।
ফেইসবুক পেইজে অনলাইন একটি শপের নাম ‘এ সেল বিডি’ যেখানে পাওয়া যায় তরুণদের সৌখিন বিভিন্ন পণ্য। ব্যবসা শুরুর সময় এবং বর্তমানে বেচাকেনার কেমন পার্থক্য জানতে চাইলে পেইজের সত্ত¡াধিকারী জাকির হোসেন বলেন, আগে খুব বেশি বিক্রি হতো না। তবে বর্তমানে প্রতি দিন গড় শতাধিক অর্ডার আসে সারাদেশ থেকে। যা আমরা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দিই। ক্যাশ অ্যান্ড ডেলেভারি অর্থাৎ পণ্য হাতে পাওয়ার পর ক্রেতা পণ্যের দাম পরিশোধ করে।
‘শৌখিন ফ্যাশানের’ কর্ণধার বিলকিস ইরানী জানান, ইদানিং ফেইসবুক ভিত্তিক অনলাইনের জনপ্রিয়তা অনেক গুণে বেড়েছে। আমার যেহেতু পণ্যের সিংহভাগ লেডিস আইটেমের কালেকশন, সেহেতু বছরের সব সময় ক্রেতাদের চাহিদা থাকে। তবে ঈদ, পূঁজা, বিশেষ দিবসে চাহিদা অনেক বেশি হয়।
ফেইসবুকে স্টাইল ওয়ার্ল্ড কালেকশন নামের একটি পেইজে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মেয়েদের জন্য শাড়ির বিপুল সমাহার। পাশাপাশি ছেলেদের পোশাকও রয়েছে। এই একি নামে গুলশানের একটি শপিং মলে তাদের দোকান রয়েছে। স্টাইল ওয়ার্ল্ডের মালিক মিস পলি বললেন, ২০০৫ সাল থেকে তিনি ঐ শপিংমলে দোকান দিয়েছেন। বেচাকেনা খুব একটা খারাপ ছিল না। তবে ফেইসবুকে একটি পেজ খুলে তার দোকানের সব পণ্যের ছবি আপলোড করাতে বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ।
তবে কেনাকাটায় সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে রাজীব আহমেদ বলেন, ফেইসবুকে কেনাকাটা করার সময় বা আগে, যে পেইজ থেকে কিনতে যাচ্ছেন বা অর্ডার করছেন সেই পেইজ এবং এর কর্ণধার সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেওয়া ভালো। কারণ অনেক সময়ই ‘ফেইক পেইজে’র পাল্লায় পড়ে ভুগতে হয়েছে অনেককেই। তবে কেউ প্রতারিত হলে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন, ভোক্তা অধিকার ফোরাম এবং আমাদের ইক্যাব-এ অভিযোগ করতে পারবেন।