পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তিস্তার পানিচুক্তি সরকারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। সেই ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে তিস্তার পানিচুক্তি প্রধান্য পেয়ে আসছে। বাংলাদেশে পর পর দুই মেয়াদে আওয়ামীলীগ সরকার এবং ভারতে মনোমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারের পর এখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। এই সময়ে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও ক‚টনৈতিক ইস্যুতে তিস্তা চুক্তিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভারতের সাথে সম্পর্কের উচ্চতার কথা দুই পক্ষের তরফেই বার বার উচ্চারিত হয়েছে। সেই সাথে ক্ষমতাসীন দুই সরকারের সময়েই তিস্তার পানিচুক্তি হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত বছর ভারত সফরের সময়ও শোনা গিয়েছিল। এখন মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে প্রধানমন্ত্রী আজ দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত যাচ্ছেন। ভারতেও পরবর্তী নির্বাচন খুব বেশী দূরে নয়। এর আগেই তিস্তার পানিচুক্তি হওয়া উচিৎ। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন এবং সেখানে বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা আজ কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর সাথে মত পার্থক্যকে তিস্তাচুক্তির একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এবার কলকাতায় দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতি এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির একটি বড় মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। তবে সামগ্রিক বাস্তবতা ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলক্ষে মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে তেমন কোন আশাবাদি বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলেছেন, কোন অগ্রগতি হলে যথাসময়ে জানানো হবে, এই মুহুর্তে এর বেশী কিছু বলার নেই। গতকাল প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে সফরসঙ্গী হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, পররাষ্ট্র, জ্বালানী, তথ্য প্রযুক্তি, বাণিজ্যমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নাম থাকলেও পানিসম্পদমন্ত্রীর নাম নেই। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তিস্তাচুক্তির মত ইস্যু এ সফরে তেমন কোন আশাব্যঞ্জক অবস্থান নেই। সফরে অনেকগুলো মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী অর্ন্তভুক্ত থাকলেও পানিসম্পদমন্ত্রীর নাম না থাকা অস্বাভাবিক। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও বা সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য কোন একটি গতানুগতিক বিষয়। কলকাতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের সুযোগে মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসেও তিস্তার পানিচুক্তির এমন হতাশাজনক বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়না। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিস্তাচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অঙ্গীকার-প্রতিশ্রæতি কেবলই কথার কথা মাত্র।
বাংলাদেশের নদনদীগুলো মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা, প্রাকৃতিক পরিবেশসহ জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর প্রবাহ ঠিক রাখা এবং পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভারতের শৈথিল্য ও বেপরোয়া আচরণের নির্মম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। গঙ্গার পানিচুক্তি হলেও চুক্তি অনুসারে পানি পাচ্ছেনা বাংলাদেশ। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার বিশাল অংশ ও শাখানদীগুলো বিলীন হয়ে গেছে। উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মান করায় এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তানদী এখন ধুধু বালুচর। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কোটি কৃষকের স্বপ্নের তিস্তা সেচপ্রকল্প এখন প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। তিস্তাপাড়ের কোটি কোটি মানুষের হাহাকার ভারতীয়দের চেতনায় তেমন কোন অনুরণন সৃষ্টি করে বলে মনে হয়না। পানিবন্টন প্রশ্নে তাদের বেপরোয়া মনোভাব এবং দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বের কথিত উচ্চতা একসাথে যায় না। পাকিস্তান আমলে ভারতের পানিআগ্রাসন দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অভিন্ন নদীর পানিসমস্যা সমাধানকল্পে ভারত-বাংলাদেশ জয়েন্ট রিভার কমিশন (জেআরসি) গঠিত হলেও ভারতের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এই কমিশন ঠিকমত কাজ করতে পারছেনা। ভারতের অনাগ্রহের কারণে বছরের পর বছর ধরে জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের কোন বৈঠক হয়না। যৌথনদী কমিশন আইনের আর্টিকেল ৩ এর ধারা অনুসারে প্রতি বছর পালাক্রমে দুই দেশ থেকে এই কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেও ২০১০ সালে দিল্লীতে সর্বশেষ বৈঠকটি হওয়ার পর আর কোন সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় গত ৮ বছর ধরে ভারতীয়রাই জেআরসি’র চেয়ারম্যান পদ ধরে বসে আছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার চিঠি ও তাগিদ দেয়া হলেও ভারতীয় পক্ষের কোন সাড়া পাওয়া যায়না। অভিন্ন নদীর পানি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশের সংকট নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বিদ্যমান বাস্তবতা যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে তিস্তাচুক্তির দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চায় দেশের মানুষ। দুই দেশের সরকার বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত সংকটকে মূল্য দিয়ে তিস্তা, গঙ্গাসহ অভিন্ন সব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং অববাহিকাভিত্তিক আঞ্চলিক পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জরুরী উদ্যোগ নেবে, এটাই বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।