দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মানব জীবনে সুন্নতের গুরুত্ব অপসীম। সুন্নত ছাড়া উম্মতপাড়ার ঈমান-আমল রয়ে যায় অসম্পূর্ণ। ইসলামী শরীয়তে সুন্নতে নববীর অনুসরণ উম্মতের জন্য অপরিহার্য। হাদীসে এসেছে ‘যে ব্যক্তি শেষ যামানায় একটি সুন্নত জিন্দা করবে সে এক’শ শহীদরে সওয়াব পাবে।’ সুন্নতের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে মিছওয়াক একটি মূল্যবান সুন্নত। হাদীসে সুন্নতটির কথা বার বার উলেখ করা হয়েছে। এ মিছওয়াক সম্পর্কে মেডিকেল সাইন্স তথা বিভিন্ন ডাক্তার ও র্দাশনিকদের রয়েছে দুরদর্শী ভাবনা। রয়েছে ইতিবাচক দৃিষ্টভঙ্গি।
বর্তমান বাজারে অনেক ধরণের মিছওয়াক পাওয়া যায়। তন্মধ্যে উলেখযোগ্য হলো- নিম, যাইতুন, সাজারাতুল আরাক, এটার অন্য নাম পিলু। এখন সৌদি আরবসহ বিশ্বরে সবখানে পিলু মিছওয়াক পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পিলুর মতোই প্যাকিং ছাড়া এ মিছওয়াক বিক্রি করতে দেখা যায়। পিলুর মতো যাইতুন এবং নিম এর ডালও অনেক উপকারী। তবে যে গাছের-ই ডাল হোক, যদি সেটাকে রাসূল সা. -এর সুন্নত মিছওয়াক হিসেবে ব্যবহার করা হয় তবে সত্যিকারার্থে মিছওয়াকের ছওয়াবে তার মধ্যে কোনো কমতি হবে না। এ জন্য এটাকে পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে ওযুর গুরুত্ব দিয়ে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘আমি আমার উম্মতের উপর যদি কষ্ট মনে না করতাম তবে তাদের ওপরে মিছওয়াক কে ফরজ করে দিতাম, যেমনি ফরজ করেছি ওযুকে।’ [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-১৫৬৫৬, বোখারী শরীফ, হাদীস নং-৮৮৭, সুনানুন নাসাঈ, হাদীস নং-৩০২, মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১৩১]
মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য অনেকে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়। অথচ বাড়ির আশ-পাশের মিছওয়াক বানানো যায় এমন গাছ-গাছালী আমাদের না জানার কারণে অব্যবহৃত রয়ে যায়।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- ‘মিছওয়াক আলাহর সন্তুষ্টি ও মুখের দুর্গন্ধ দূরিভুত হওয়ার মাধ্যম।’ [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-৬২, ২৪৩৩২, দারেমী, হাদীস নং-৭১১, মুসান্নাফ ইবনে আবি সাইবা, হাদীস নং-১৭৯২, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২৮৯, মুসনাদুস শাফেঈ, হাদীস নং-৭১, সুনানুন নাসাঈ, হাদীস নং-৫, ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১৩৫] [ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-১০৬৮, মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-২৭৬, ৭৪৯৬]
রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. মিছওয়াক রে ১০-টি গুণ বর্ণনা করেছেন-
১. আলাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
২. শয়তানের অসন্তুষ্টির কারণ।
৩. ফেরেশতারা আনন্দিত হয়।
৪. দাঁতের মাড়ি মজবুত (দাঁতের আটাজাতীয় ময়লা দূর) হয়।
৫. মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।
৬. দৃষ্টি শক্তি তীক্ষè হয়।
৭. মুখে সুগন্ধি আনে। কফ ঘ্রাস করে (কেটে ফেলে)।
৮. এটা রাসূলের সুন্নত।
৯. নেক-আমল তথা সওয়াব বৃদ্ধি করে। [সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-৪১৬০]
হাদীসে আরও বর্ণিত হয়েছে- ‘রোযাদার ব্যক্তির সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ গুণ হলো মিছওয়াক করা।’ [মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৭৪২]
একটি সাধারণ কাজ, যা সহজ-সরলভাবে করা যায়, অথচ এ সুন্নতটির প্রতি রয়েছে আমাদের চরম অবহেলাা। হযরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘তোমরা মিছওয়াক থেকে উদাসীন হয়ো না; কেননা তাতে বহু গুণাগুণ রয়েছে।’ আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়ুতি রহ. ‘শরহুছছুদুর’ কিতাবে উলেখ করেছেন- ‘মিছওয়াক করার বরকতে মৃত্যুর সময় রুহ সহজে বের হয়। এর প্রমাণ হলো রাসূল সা.ও মৃত্যুর পূর্বে মিছওয়াক করেছিলেন। এছাড়াও মিছওয়াক করার দ্বারা- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন হয়। মিছওয়াককারী বিজলীর ন্যায় পুলসিরাত পার হয়ে যায়। নামাযের আগে মিছওয়াক করলে নামাযের ফযীলত ৭০ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। স্বচ্ছলতা বয়ে আনে।
মেডকিলে সাইন্সে মিছওয়াকের উপকারিতা
মিছওয়াক করার দ্বারা কিডনীর পাথর প্রতিরোধ হয়। থাইরাইড গ্লান্ডরে আক্রান্ত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। গভীর অধ্যাবসায় সুক্ষè ভাবনার প্রতিফলন ঘটে। মুখের সৃষ্ট ক্ষত নিরাময়ের কারণ। এলার্জি দূরিভুত হওয়ার মাধ্যম। সৃষ্টির প্রতি দয়া-মায়া ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। মুখের ব্রুণ ও কালো দাগ মুছে ফেলে। ঘুমের মধ্যে সৃষ্ট শ্বাস-প্রশ্বাসে রোগ প্রতিরোধ করে। দেহ সতেজ রাখে। মাথা ব্যথা দূর হয়। মস্তিস্ক সতেজ ও সহায়ক হয়। দাঁতের ব্যথা দূর হয়। দাঁতের শুভ্রতা ও উজ্জলতা বৃদ্ধি পায়। দাঁত শক্ত হয়। ফেরেশতা নূরানী চেহারায় মুসাফাহা করে। মাথা ঠান্ডা রাখে। চুলের গোড়া শক্ত হয়। চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়। খাওয়ার রুচি বৃদ্ধি পায়। গলায় মাংসপিন্ড বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। রক্ত পরিষ্কার রাখে। সর্দি-কাশি নিরাময়ে ফলপ্রসূ হয়। হৃদপিন্ড ব্যাধির উপকারিতা। পাকস্থলীর কার্যকর ভালো থাকে। শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পায়। বাকশক্তি সুন্দর ও আর্কষণীয় হয়। স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি পায়। অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়। নেকী বৃদ্ধি পায়। শরীরের অতিমাত্রার তাপ বা আদ্রতা দূর হয়। শরীর ইবাদতের উপযোগী হয়। সর্ব প্রকার ব্যথা দূর হয়। পিঠ মজবুত হয়। জ্বর থাকলে কমে যায়। জিহ্বা তেজস্বী হয়। জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্তানাদি নেক ও ভদ্র হয়। ফেরেশতাগণ মিছওয়াক কারীকে দেখে বলতে থাকে- ‘ঐ ব্যক্তি নবীগণের অনুসারী।’ মৃত্যুর সময় ফেরেশতাগণ এমন আকৃতিতে আসেন যেমন আকৃতিতে নবীগণের কাছে আসতেন। মুখের জড়তা, তোতলামি, বাকরুদ্ধতা দূর হয়। যৌনশক্তি বৃদ্ধি পায়। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত মিছওয়াক কাশি দূর করে। যাদের শরীরে ও মাথায় চুল এবং পশম নেই মিছওয়াক করার ফলে সেখানে চুল ও পশম গজায়। শরীরের রং উজ্জ্বল ও আর্কষণীয় হয়। শয়তানের ওয়াসওয়াসা দূর হয়। নিয়মিত মিছওয়াকের দ্বারা দাঁতের হলুদবর্ণ দূর হয়। দাঁত সাদা ও ধবধবে উজ্জ্বল হয়। জান্নাতে মিছওয়াক কারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মৃত্যুর সময় কালিমা নসীব হয়।
মিছওয়াকের এ সুন্নত মানব জীবনের প্রতিটি ধাপে বাস্তবায়ন করা সময়রে দাবী। ইসলামী শরীয়তে মিছওয়াকের এ সুন্নত মানুষের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। চমকদার হিরার টুকরো ফেলে দিয়ে মূল্যহীন একটি কাঁচরে টুকরো যেমনি বুদ্ধিহীনতার কাজ তেমনি মিছওয়াকের মতো মূল্যবান সুন্নতকে বাদ দিয়ে টুথপেস্ট গ্রহণ অনুচিত। সাহাবায়ে কেরামের যামানায় যুদ্ধের সময় কাফেররা মুসলমানের মিছওয়াকের অবস্থা দেখে বলতে লাগলো- ‘ মিছওয়াক যে জাতির খাদ্য (দাঁত খিলাল) সে জাতির সাথে জয়ের আশা বোকামী’ ফলে ভয়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে যুগে একটি সুন্নতের উপর আমল করার কারণে মুসলমানদের বিজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এজন্য পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে মিছওয়াকের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যান্য সুন্নতের সঙ্গে নবীজির এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত মিছওয়াককেও প্রাধান্য দেয়া বাঞ্ছনীয়। সুন্নতে নববীর ছোঁয়ায় জীবনের প্রতিটি অঙ্গন হয়ে উঠুক সফলতার বর্ণিল ক্যাম্পাসে সমৃদ্ধ। শেষ জামানায় একটি সুন্নত আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের কাক্সিক্ষত অধ্যায়কে করে দিতে পারে সুন্দর্যের শোভায় শোভামন্ডিত। এ প্রত্যাশাই করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।