পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম ফরজ ইবাদত সিয়াম বা রোজা। কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া অর্জন তথা আত্মশুদ্ধির সর্বোত্তম মাস এই রমজান। বছর ঘুরে মহিমান্বিত এই মাস আসে রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির বারতা নিয়ে। বিশ্বমুসলিমকে শিক্ষা দেয় সংযত-সুন্দর ও নিষ্কলুষ জীবনযাপনের। রমজান অর্থ জ্বালিয়ে ফেলা, নিঃশেষ করা। হাদিস শরিফে এসেছে, এ মাসের নাম রমজান রাখার কারণ হলো এ মাসে মু’মিনদের গুনাহগুলো জ্বালিয়ে ফেলা হয়। তাই মুসলিম নর-নারীর কাছে পবিত্র রমজান মাস বহু কাক্সিক্ষত। পবিত্র এ মাসের মধ্যে নিহিত রয়েছে দুনিয়া ও পরকালের অশেষ কল্যাণ। মহান আল্লাহ এ মাসের প্রতিটি দিন ও মুহূর্ততে নির্ধারিত করে দিয়েছেন সংযম সাধনার জন্য। রমজানকে তাই তাকওয়া প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে মুসলমানরা কাজে লাগান।
সিয়াম অর্থ বিরত থাকা। আত্মসংযম, কঠোর সাধনা ও অবিরাম প্রচেষ্টা। পরিভাষায় সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে যাবতীয় পানাহার, পাপাচার ও স্ত্রীসম্ভোগ হতে বিরত থাকার নামই সিয়াম বা রোজা। শুধু পানাহার থেকে দিনের বেলায় বিরত থাকাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজের মুখ ও জিহŸাকে সংযত রাখতে হবে। শুধু প্রভাত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নয়, পুরো মাসের সবটুকু সময় সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই সিয়াম সাধনার প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে।
সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া অর্থ খোদাভীতি, পরহেজগারি, আত্মশুদ্ধি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও অনাচার বর্জন করে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানবজীবন অতিবাহিত করার নামই তাকওয়া। তবে অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে তাকওয়া হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশাবলি পালন করা এবং নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে বিরত থাকা। বিশ্বখ্যাত সুফি বাদশাহ ইবরাহিম বিন আদহাম বলেন, ‘তাকওয়া হলো সৃষ্টিজগৎ তোমার কথায় কোনো ত্রæটি পাবে না, ফেরেশতামÐলী তোমার কর্মে কোনো ত্রæটি-বিচ্যুতি পাবে না এবং আরশের মালিক তোমার কাজে কোনো দোষ বা ত্রæটি পাবেন না।’ মুত্তাকিরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর জেনে রেখো, নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গেই রয়েছেন’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৪)।
তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে মোক্ষম সুযোগ মাহে রমজান। আল্লাহ তা’আলার ঘোষাণা, ‘ওহে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম (রোজা) ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮২)। মহান আল্লাহর বাণী, ‘যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’Ñ দ্বারা এ কথা অতি স্পষ্ট যে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের খোদাভীতি অবলম্বনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেনÑ তা হলো সিয়াম সাধনা। পাশাপাশি আলোচ্য আয়াতে কারিমার আলোকে এ কথাটিও প্রণিধানযোগ্য যে সিয়ামের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করার নির্দেশ শুধু উম্মতে মুহাম্মদিকেই দেওয়া হয়নি; বরং এ নির্দেশ পূর্ববর্তী অন্য সব নবীর অনুসারীদের ওপরও ছিল।
নিজের এবং অন্যের ওপর জুলুম করা, অপচয় করা থেকে বিরত থাকা সিয়াম সাধনার অন্যতম প্রধান দাবি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, পবিত্র রমজানের এই দাবির ব্যাপারে আমাদের সমাজের অনেকেই বরাবরই বেখেয়াল। রমজান এলেই দেখা যায় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই মাসে অধিক মুনাফার আশায় বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে বসে থাকে।
প্রতিবছর রমজানের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম না বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করা হলেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে বাজারের মূল্যচিত্র বদলায় না। ফলে ক্রেতাদের জিম্মি করে বেশি মুনাফা লুটে নেয় ব্যবসায়ীরা। এই দৃষ্টিভঙ্গি পবিত্র রমজানের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রমজান মাসে সুবিধা বুঝে ভোগ্যপণ্যের অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা ঘোরতর অন্যায়। রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অধিক মূল্যের আশায় খাদ্যশস্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত আবদ্ধ রাখে, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট, ক্রোধান্বিত।’
মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম অধ্যুষিত অন্য দেশগুলোতে রমজান উপলক্ষে বিশেষ ছাড় চলে। আমাদের দেশে হয় উল্টোটা । ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলেÑ কে কার চেয়ে বেশি মুনাফা করতে পারবে। যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির অভাবের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে রমজানে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নেয়। ফলে ৩০ টাকার বেগুনের দাম হয় ১০০ টাকা!
সাম্প্রতিক এক খবরে প্রকাশ, রমজানে এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের সুপারশপগুলোতে বিশেষ ছাড় চলছে। চাল, ময়দা, ভোজ্য তেল, দুধ, ফল ও সবজিসহ পাঁচ হাজার রকমের খাদ্যপণ্যের দাম ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আরও চার হাজার পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে। দাম ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করতে সুপারশপগুলো ৪০০ বারেরও বেশি পরিদর্শন করবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এছাড়াও সৌদি আরব, জর্দান ও মিসরের বাজারগুলোর ৪০টি ভোগ্যপণ্যের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যথাযথ আমলে নিলে নিত্যপণ্যের দাম অন্তত সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা সম্ভব।
অন্যদিকে সিয়াম সাধনার এই মাসে সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীদের অনেকেই অপচয় করেন। ভোগ-বিলাসে মত্ত না হয়ে এ মাসে মানবতার সেবায় ব্যয় করলে অভাবক্লিষ্ট মানুষের কল্যাণ হয়। মানবতার মাধ্যমেই তো স্রষ্টার সস্তুষ্টি লাভ করা যায়, অর্জন করা যায় তাকওয়া। যা সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য।
পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ, গিবত, কটুকথা, প্রতারণা, বেহায়াপনা, কালোবাজারি, মজুদদারি, মুনাফাখোরি, চাঁদাবাজি, মিথ্যা, অন্যায় ও পাপাচারে মানবজীবন আজ কলুষিত। আমরা আইয়ামে জাহিলিয়ার সেই অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছি! আমাদের ইমান আজ কমজোরি, বিশ্বাসে গলদ। তাই সামান্য অজুহাতেই নামাজ-রোজা ছেড়ে দেই। নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকি। খাঁটি জিনিসকে ভেজাল মিশিয়ে বিষাক্ত করি, ওজনে কম দিই, নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দিই। আমরা রোজা মুখেই একে অন্যের কুৎসা রটনা করি, স্বজ্ঞানে প্রতারণা করি, দেশ ধ্বংসের কাজে লিপ্ত থাকি। মুখে বলি আল্লাহর ভয়ে রোজা রাখি, কলিজা শুকিয়ে গেলেও একফোঁটা পানি পান করি না; অথচ মন্দকর্ম ও হারাম ছাড়তে পারি না। লাগামহীনভাবেই ডুবে থাকি মিথ্যা ও পাপাচারে।
সুযোগ এখন তাওবা ও মাগফিরাতের। ক্ষমা ও মুক্তির। মাহে রমজান আমাদেরকে পরিত্রাণের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমরা কেনো উদাসীন থাকবো? যে মাসের প্রতিটি ক্ষণ রহমত ও বরকতে ভরা, সে মাসেও আমরা গাফিল রয়েছি! ধিক আমাদের জীবনে, শত ধিক। এই সুবর্ণ সুযোগ আমরা কেনো মিস করছি! রমজানের আলো দিয়ে কেনোই বা নিজেদের জীবন পরিশুদ্ধ করছি না? তবে কি আমরা মহান প্রভুর ঘোষাণা ভুলতে বসেছি! ‘এটা রমজান মাস। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাযিল হয়েছে, যা মানবমÐলীর জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করে’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)।
রোজা ঢাল স্বরূপ। আর এটি এমন একটি ইবাদত যার প্রতিদান স্বয়ং মহামহিম আল্লাহ আপন হাতেই প্রদান করবেন। হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে, ‘রোজাদারের জন্য দু’টি বিশেষ আনন্দের ক্ষণ রয়েছেÑ একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি হলো পরকালে তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’
আল্লাহর পক্ষ হতে মাগফিরাত বা ক্ষমা প্রাপ্তির মাস মাহে রমজানুল মোবারক। এ মাসেই মানব মুক্তির চির শাশ্বত সংবিধান মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। লাইলাতুল কদর এ মাসেই বিদ্যমানÑ হাজার মাসের চেয়েও অতি উত্তম যে রজনী। অতএব ইসলামী অনুশাসন মেনে পবিত্র এই মাসটিকে আত্মশুদ্ধি ও আত্মবিশ্লেষণের সোনালি সুযোগ ভেবে তাকওয়াভিত্তিক একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলাই সিয়াম সাধনার দাবি।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।