Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দক্ষিণাঞ্চলে নদীভাঙন রোধে প্রকল্প অনুমোদনে ধীরগতি : বাস্তবায়ন জটিলতায় কালক্ষেপণ

| প্রকাশের সময় : ১৬ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম: দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, বিষখালী ও পায়রা সহ বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙনে একের পর এক জনপদ সহ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসমুহ বিলীন হলেও তা প্রতিরোধ কার্যক্রম এখনো খুবই দুর্বল। ভাঙন রোধ সহ নদী শাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ৩১টি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর কিছু যাচাই-বাছাই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী পুণঃগঠন করা হচ্ছে। কিছু প্রকল্প-প্রস্তাবনা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট-এ প্রেরণ করা হয়েছে অর্থের চাহিদা দিয়ে। আবার কিছু প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন সহ অধিকতর যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্প কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনাধীন বলে জানা গেছে। আবার কিছু প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের প্রি-একনেক সহ কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনাধীন রয়েছে। তবে অনেকগুলো প্রকল্পের অগ্রগতিই খুব একটা আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে নেই। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে পাঁচ সহ¯্রাধিক কোটি টাকা।
কিন্তু ঋতু চক্রের ধারাবাহিকতায় আরো একটি বর্ষা মৌসুম সমাগত। এসময়ে স্বাভাবিকভাবেই উজানের ঢলের সাথে নদী ভাঙনও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে থাকে। সারা দেশের নদ-নদীর পানি দক্ষিণাঞ্চলের বড় কয়েকটি নদী বহন করে সাগরে নিয়ে যায়। আর এ উজানের ঢলের সাথে নদী ভাঙনও আরো তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু তা থেকে পরিত্রাণে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সম্পদের ক্ষতি আরো বাড়বে। এমনকি নদী শাসন কাজ যত দ্রুত সম্পাদন করা সম্ভব, ক্ষয়ক্ষতি তত হ্রাস সহ ব্যয়ও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞগণ।
সুগন্ধা নদীর ভাঙন থেকে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের দোয়ারিকাতে ‘বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু’র সংযোগ সড়ক রক্ষায় প্রায় ৮ বছর আগে ১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন না হওয়ায় এখন ভাঙন রোধে প্রয়োজন হবে প্রায় সোয়া ২শ’ কাটি টাকা। এভাবে অনেক নদ-নদী ভাঙন রোধ প্রকল্প বাস্তবায়নে কালক্ষেপন অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে বরিশাল ও ভোলা জেলার বিভিন্নস্থানে ৮টি নদী শাসন প্রকল্প একনেক-এর অনুমোদন লাভ করায় কয়েকটির কাজ শুরু হয়েছে। আবার কয়েকটি প্রকল্প ‘উন্মুক্ত দরপত্র’র পরিবর্তে ‘সীমিত ক্রয় প্রক্রিয়া’য় সম্পাদনের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। ফলে কালক্ষেপন সহ কাজ শুরু নিয়েও জটিলতা বাড়ছে। গত নভেম্বরে বরিশাল মহানগরীর চরবাড়ীয়া এলাকার কির্তনখোলা নদীর ভাঙন রোধে ৩৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেক-এর অনুমোদন লাভ করলেও তার দরপত্র আহবান করা সম্ভব হয়নি এখনো। প্রকল্পটি উন্মূক্ত দরপত্রের পরিবর্তে সীমিত দরপত্রে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে জটিলতা বাড়ছে।
এছাড়া প্রায় ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনার ভাঙন থেকে ভোলা সদরের রাজাপুর ও পূর্ব ইলশা ইউনিয়ন রক্ষায় একটি প্রকল্পের প্রায় ৬০ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। মেঘনার ভাঙন থেকে ভোলার দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রায় ৯.৬০ কিলোমিটার নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ সহ ৭৮১ মিটার এলাকা ড্রেজিং-এর লক্ষ্যে ৫৫১ কোটি টাকার অপর একটি প্রকল্পের কাজও ২৫ ভাগ শেষ হয়েছে। ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকায় নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ সহ দেড় কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং কাজটিও চলছে প্রায় ৪৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে। কাজের অগ্রগতি প্রায় ৩০ ভাগ। ভোলার চরফ্যাশন পৌর শহরকে মেঘনার ভাঙন থেকে রক্ষায় ২১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প এখন বাস্তবায়নাধীন। প্রকল্পটির আওতায় প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ ছাড়াও এক কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করে মেঘনার গতিপথ পরিবর্তন করে ভাঙন এড়ানো সম্ভব হবে।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার সাথে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে মাসকাটা নদীর ওপর ক্রসড্যাম নির্মান প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করেছে। তবে এ প্রকল্পের জন্য এখনো নকশা উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। বরিশাল, পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার ‘সাতলা-বাগদা সেচ প্রকল্প’র পোল্ডার পুনর্বাসনে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও অনুমোদন লাভ করার পরে নকশা-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রকল্পটির আওতায় ২০ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, ৫১ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন, ২৪টি ইনলেট স্ট্রাকচার ও ১৩টি পানি অবকাঠামো মেরামত করা হবে।
তবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙন থেকে বিশাল জনপদ সহ যোগাযোগ অবকাঠামো এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পদ রক্ষায় আরো ৩১টি প্রকল্প-প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনের বিবেচনাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদন সহ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন পানি বিশেষজ্ঞগন। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী সময়মত অর্থ বরাদ্দের কথাও বলা হয়েছে।
এসব প্রকল্পের মধ্যে বরিশাল জেলার ৮টি স্থানে নদীভাঙন রোধে প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা, পটুয়াখালীর কুয়াকাটার ৫ কিলোমটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত রক্ষা সহ ৪টি প্রকল্পের জন্য ৮০৫ কোটি টাকা, ভোলায় মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর ভাঙন থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রক্ষায় ৮টি প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, ঝালকাঠীর সুগন্ধা ও কালিজিরা নদীর ভাঙন থেকে নৌ বাহিনীর আঞ্চলিক বেজ স্টেশন সহ ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা এবং বরগুনার ৩টি প্রকল্প বাস্তায়নে ৪২৭ কোটি টাকা প্রকল্প-প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সহ পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিবেচনায় রয়েছে। এছাড়াও পিরোজপুর জেলার দুটি প্রকল্পের জন্যও প্রায় ৫৪ কোটি টাকা প্রয়াজন। তবে জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার এ দুটি প্রকল্প জিওবির তহবিল সহ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সীমান্তের উজানের ৫৪টি নদ-নদী সহ সারাদেশের নদীসমূহ এবং বৃষ্টির পানি মেঘনা, তেতুলিয়া, বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা সহ দক্ষিণাঞ্চলের বড় বড় নদীগুলো দিয়েই সাগরে প্রবাহিত হয়ে থাকে। ফলে এ অঞ্চলের নদ-নদীর ভাঙনের তীব্রতাও অত্যন্ত ভয়াবহ। কিন্তু সে তুলনায় ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রম অতীতে খুব একটা গুরুত্ব লাভ করেনি। এমনকি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহ অর্থ বরাদ্দের অভাবে এ অঞ্চলের নদী শাসন কার্যক্রম এখনো যথাযথ নয়। বরিশাল নদী বন্দরের অপর পাড়ে চরকাউয়া ফেরি ঘাট সহ পুরো বন্দরটির তিন-চতুর্থাংশ এলাকা গত ২৫ বছরে কীর্তনখোলা নদীগর্ভে বিলীন হলেও অর্থের অভাবে যথাযথ ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়নি। গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধির মুখে কিছু থোক বরাদ্দ দিয়ে বালুর বস্তা ফেলে জনগনের টাকা নদীতে ফেলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের নদী শাসন সহ পানি সম্পদ বিষয়ক সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল মহলে আলাপ করা হলে ‘এ লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণের’ কথা জানান হয়। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল মহল থেকে, ‘যেসব প্রকল্প-প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রনালয় সহ পরিকল্পনা কমিশনের বিচেনাধীন রয়েছে তা অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে বড় ধরনের কোন নদী ভাঙন থাকবে না’ বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দক্ষিণাঞ্চল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ