পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও তাঁর মুক্তির কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা যেমন উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত, তেমনি জনসাধারণও এক ধরণের উদ্বেগের আছে। কেননা, বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দীর্ঘ তিন যূগের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এদেশের মানুষের মনে ইতিবাচক স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রবীণ এ রাজনৈতিক নেত্রীর এ কারাবাস অনেককেই বেদনার্ত করেছে। একজন সাধারণ গৃহবধু থেকে রাজনীতির জটিল খেলার মাঠে এসে বেগম খালেদা জিয়া পরিচয় দিয়েছেন দক্ষতার। সাফল্যও ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর প্রথম নির্বাচনেই বাজিমাত করেছেন। হয়েছেন দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এ পর্যন্ত যতগুলি সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছেন, পরাজয় তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। এককভাবে সর্বাধিক আসনে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব তিনি অর্জন করেছেন। তিনি শক্ত হাতে যেমন দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি সরকারপ্রধান হিসেবেও স্বাক্ষর রেখেছেন দূরদর্শিতার। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে এসেছে বলে যে আওয়াজ আমরা শুনছি, তার পেছনে বেগম খালেদা জিয়া তথা বিএনপি সরকারের অবদান কম নয়। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে উন্নয়নের যেসব প্রকল্প-পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন আমরা পরবর্তিতে দেখেছি। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছেন মিতভাষী এই নেত্রী।
কথা শুরু করেছিলাম বেগম জিয়ার বন্দীদশা নিয়ে। আবার সেখানেই ফিরে যাই। বেগম খালেদা জিয়ার জেল হওয়ার আগে বিএনপি কর্মীদের শ্লোগান ছিল: ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দিব না।’ আর তিনি কারাগারে যাবার পর তাদের মুখে শ্লোগান শোনা যাচ্ছে: ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দী থাকতে দিব না।’ কিন্তু বাস্তবে এ শ্লোগানের কোনো প্রতিফলন দৃশ্যমান হচ্ছে না।
এটা ঠিক, বেগম খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে কারাগারে আছেন এবং আদালতের নির্দেশ ছাড়া তারা বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। হাইকোর্ট তাকে জামিন দিলেও দুদক আপীল করায় তিনি মুক্তি পান নি। সে আপীলের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ১৫ মে রায় দিবেন আদালত। রায়ে যদি জামিন বহাল থাকে, তারপরও বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাথে মুক্তি পাবার সম্ভাবনা কম। কেননা, ইতোমধ্যে তাঁকে অন্য আরো একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তার মুক্তি পেতে হলে সে মামলায়ও জামিন পেতে হবে। কেউ কেউ মনে করছেন, বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি মুক্তি পাবেন কীনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাদের মতে, তিনি যাতে সহসা জেল থেকে ছাড়া না পান, সরকার সেজন্য সব ধরণের প্রচেষ্টাই চালাবে। সরকার চাচ্ছে না বেগম জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। এমন কি তিনি যাতে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে না পারেন সে ব্যবস্থা করতেও সরকার সচেষ্ট থাকবে। সরকারের এসব কৌশলের বিপরীতে বিএনপির পদক্ষেপ নিয়ে নানা মহলে কথা উঠেছে। অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, শীর্ষ নেত্রীর অনুপস্থিতিতে দলটি কার্যত কাÐারীহীন হয়ে পড়েছে।
বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাবার আগে ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন বলে বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছিলেন। পরবর্তিতে মহাসচিবসহ কয়েকজন শীর্ষনেতা কারাগারে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করে এসে একই কথা বলেছেন। দৃশ্যমান বিষয় হলো, নেত্রীর সে নির্দেশনা মোতাবেক তারা এখনও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যেই আছেন। তবে, এ ধরনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বের কোথাও কোনো দাবি আদায় হয়েছে এমন নজির নেই। কেউ হয়তো বলতে পারেন, আদালতের রায়ে যেহেতু বেগম জিয়া কারান্তরীণ আছেন, তাই তাঁর মুক্তির বিষয়টিও আদালতের এখতিয়ার। আদালতের বিষয় রাজপথে ফয়সালার সুযোগ কোথায়?
এরও ব্যতিক্রম আছে। রাজপথের আন্দোলনে কোর্টের রায় শুধু নয়, পুরা মামলাই বাতিল হওয়ার নজির ইতিহাসে আছে। তবে, সে আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্তি থাকতে হবে, তীব্র হতে হবে তার বেগ। এ প্রসঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদাহরণ দেয়া যায়। স্বৈরশাসক আইয়ূব খান শেখ মুজিবুর রহমানসহ ওই মামলার আসামীদের সাজা দেয়ার বন্দোবস্ত প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছিল। কিন্তু ঊনসত্তরের গণঅভূত্থান আইয়ূব খানের সব পরিকল্পাকে ধূলিস্মাৎ করে দেয়। এটা সম্ভব হয়েছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে। বাংলাদেশে যে এখন সে রকম প্রেক্ষাপট নেই তা বলাই বাহুল্য। রাজপথে তীব্র আন্দোলন করে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনবে এমনটি আশা করা বাতুলতা মাত্র। ফলে তাদেরকে আদালতের মর্জির ওপরই এখন ভরসা করতে হবে।
গত ৯ মে একটি জাতীয় দৈনিকের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেগম জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামী ঈদের পর বিএনপি কঠোর কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে। পত্রিকাটি লিখেছে, দলটির ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে শীর্ষ নেতৃত্ব এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জেলার নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, যে পদ্ধতিতে বর্তমানে আন্দোলন চলছে, তাতে দাবি আদায় সম্ভব নয়। দাবি আদায় করতে হলে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং জনগণকে তাতে সম্পৃক্ত করতে হবে। আন্দোলনের জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রস্তুত বলেও তারা অভিমত দিয়েছেন। বিএনপি সর্বশক্তি নিয়ে রাজপথে নামতে চায় এমন খবর মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। অন্য একটি পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলনকে ধাপে ধাপে কঠোর করতে চায় বিএনপি। বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করে তারা জেলা পর্যায়ে সমাবেশ করবে। তাছাড়া গোটা রমজান মাস তারা দলকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করার জন্য কাজে লাগাবে। ইতোমধ্যেই রমজান মাসকে সাংগঠনিক মাস হিসেবে ঘোষণা করেছে দলটি। বলা হয়েছে, রমজান মাসে ইফতার মাহফিলসহ নানা ঘরোয়া কর্মসূচীর মাধ্যমে ওয়ার্মআপ করবে বিএনপি। যাতে ঈদের পরপরই কঠোর আন্দোলনে নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সে আন্দোলনে কোন দাবিটির ওপর জোর দেবে বিএনপি? দলীয় চেয়ারপার্সনের মুক্তি, নাকি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি? বস্তুত, বিএনপির সামনে এখন কঠিন সমস্যা। যে দু’টি ইস্যু নিয়ে তারা মাঠে নামতে চাচ্ছে, তা দলটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চেয়ারপার্সনকে দ্রæত কারামুক্ত করা তাদের জন্য অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। আবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়াটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ এ দু’টি ইস্যুতেই সরকারের মনোভাব অত্যন্ত কঠোর। আইনী মারপ্যাচে বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত করার সর্বাত্মক চেষ্টা তারা যেমন করছে, তেমনি তিনি যাতে নির্বাচনে অযোগ্য হন সে চেষ্টাও অব্যাহত আছে বলে বিএনপি অভিযোগ তুলেছে। স্পষ্টত, বেগম খালেদা জিয়া সরকারের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি জেলে থাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা বা জনগণের সহানুভূতি বাড়ছে। অন্যদিকে জেল থেকে ছাড়া পেলে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হবে, তাতে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অভাবনীয় পরিবর্তন আসতে পারে, যা সামাল দেয়া সরকারের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। আর সে জন্যই সরকার চেষ্টা করছে আইনী পদক্ষেপের মাধ্যমে বেগম জিয়ার কারাবাসকে দীর্ঘায়িত করতে। অন্যদিকে বিএনপির দ্বিতীয় ইস্যু অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়েও সরকারের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার ও কঠোর। সরকারের তরফ থেকে স্পষ্ট করেই বলে দেয়া হয়েছে যে, বর্তমান সংবিধানে বর্ণিত বিধান মোতাবেক নির্বাচন হবে। বিএনপিকে যদি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হয়, তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে বহাল রেখেই তা করতে হবে।
বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, তাদের নেত্রীর মুক্তি ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। তারা এটাও বলেছেন, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। বিএনপির সামনে এখন কঠিন সময়। সরকার যদি উভয় ইস্যুতে নমনীয় না হয়, তাহলে তারা পড়বে ভীষণ বেকায়দায়। একদিকে নেত্রীকে দ্রæত মুক্ত করতে না পারলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসবে। অপরদিকে নির্বাচন বর্জন করলে দলটি পড়তে পারে অস্তিত্বসঙ্কটে। এ উভসঙ্কট থেকে বিএনপি কীভাবে বেরিয়ে আসবে তা কারোরই বোধগম্য হচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের কথা প্রায়ই বলা হচ্ছে। আলোচনায় বসার জন্য তারা সরকারকে আহŸানও জানাচ্ছে। কিন্তু সরকার তাতে মোটেই ভ্রæক্ষেপ করছে না। লক্ষ্যণীয় হলো, অতীতে এ ধরণের রাজনৈতিক সঙ্কটে সরকারকে দেখা যেতো বিরোধী দলসমূহকে আলোচনায় বসার আহŸান জানাতে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি যে, সরকার নয়, প্রধান বিরোধী দলই উল্টো সরকারকে আলোচনায় বসার আহŸান জানিয়ে আসছে। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের আগ্রহ একেবারেই নেই। কারণ তারা গদীতে আছেন এবং খুব ‘ভালো অবস্থানে’ আছেন। ‘ভালো অবস্থান’ বলতে জনপ্রিয়তা বা জনসমর্থনের কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে বিএনপির দুর্বলতার কারণে সরকারের শক্ত হয়ে বসে থাকার কথা।
বিএনপি নেতৃবৃন্দ বলছেন, এ মুহূর্তে দলের চেয়ারপার্সনের মুক্তিই তাদের কাছে মূখ্য বিষয়। তাঁর মুক্তির পরেই তারা অন্য বিষয় নিয়ে ভাববেন। অথচ বেগম জিয়া সহসা মুক্তি পাচ্ছেন এমন সম্ভাবন কম। বিএনপি অবশ্য বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পাশাপাশি দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টির চেষ্টাও চলছে। দেশে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের বিষয়টি অবহিত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টির চেষ্টা দৃশ্যমান। কিন্তু এটা ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে বিদেশীরা এড়িয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া এ বিষয়ে কোনো বিদেশী শক্তি মুখ খুলবে বলে মনে হয় না। কারণ এর সাথে বিদেশীদের কোনো স্বার্থ জড়িত নয়। তাহলে বিএনপির সামনে খোলা রইল এক পথ- আন্দোলন। কিন্তু সে আন্দোলন তারা কবে নাগাদ কীভাবে সংগঠিত করবে এবং দুর্বার করে তুলবে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। গত কয়েক বছর ধরে ‘ঈদের পরে’ ‘পরীক্ষার পরে’ কঠোর আন্দোলনের কথা মানুষ বহুবার শুনেছে। ফলে এবারও ঈদের পরে কঠোর আন্দোলনের কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। আর সেজন্যই যে প্রশ্নটি সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন জনপ্রিয় নেত্রীর কারাবাস আর কত প্রলম্বিত হবে?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।