Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আস্থা-অনাস্থার পাশাখেলা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত ৪ মে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত আইনের শাসন ও গণতন্ত্র শীর্ষক আলোচনায় দেশবরণ্য ব্যক্তিবর্গ তাদের বক্তব্যে প্রকাশ করেছেন যে, ‘আইনের শাসন দেশে চলছে না, চলছে পুলিশের শাসন। দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে জগাখিচুড়ি চলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে, আমরা নিঃশেষ হয়ে যাবো।’ এ কথাগুলি শুধু রাজনৈতিক দল বলছে না, এখন বলছেন দেশবরণ্য আইনজীবীবৃন্দ যারা রাজনৈতিকভাবে এক প্লাটফর্মের যাত্রী নয়, যাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেন যিনি এক সময় আওয়ামী ঘরনার তথা আওয়ামী লীগের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন। 

সেকালের জমিদারদের লাঠিয়াল ও একালের পুলিশের কার্যক্রমের তেমন কোন তফাৎ নেই। লাঠিয়ালের দায়িত্ব ছিল প্রজা দমন, খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে গরু বাছুর টেনে আনা, বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়া প্রভৃতি। পুলিশ সৃষ্টি হয়েছিল দুষ্টের দমন ও ভালোকে রক্ষা করার জন্য, যদিও পুলিশ সে দায়িত্ব থেকে সড়ে গিয়ে নিয়োগকর্তার মনোরঞ্জনকেই তাদের প্রধান দায়িত্ব হিসাবে বেছে নিয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দিক থেকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। মনোরঞ্জনের অর্থাৎ তৈল মর্দনও হচ্ছে বিভিন্ন পদ্ধতিতে। যারা আইনগতভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন তারাও আজ্ঞাবহতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কত বড় দেশপ্রেমিক, একথা সাধারণত আলোচনা হয় না, বরং কে নিয়োগকর্তার প্রশংসায় চাপাবাজি ও তৈলমর্দনে পারঙ্গম তা নিয়েই আলোচনা বেশি হয় এবং তৈল মর্দনকারীর গুরুত্ব ক্ষেত্র বিশেষ সে ভাবেই চক্রবৃদ্ধি হারে পরিমাপ হতে থাকে।
মেরুদÐ বাঁকা হয়ে পড়া বা মাজা ভাঙ্গা কোন ব্যক্তি যেমন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে আমাদের বিচারাঙ্গন যেন সে অবস্থায় পড়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আস্থা/অনাস্থার পাশাখেলা। রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা/গ্রেফতার প্রভৃতির পরে রিমান্ড জামিনের পর জেল গেইটে গ্রেফতার এবং একটি মামলায় জামিন হওয়ার পর অন্য আর একটি মামলায় ঝযড়হি অৎৎবংঃ করে জামিন অকার্যকর করে দেয়ার প্রবণতার পিছনে রয়েছে নিয়োগকর্তাকে খুশি করার একটা ব্যাপার। পরিতাপের বিষয় এই যে, পুলিশের সকল অপকর্ম ও বাণিজ্যের সার্বিক বিষয়গুলি জায়েজ হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে। আদালত যখন বিবেক দিয়ে বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় তখনই পুলিশী আইন নামক অস্ত্রের মাধ্যমে নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। জনগণ এ নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য যেখানে আশ্রয় নেবে, সেখানেও তাদের আশ্রয় মিলছে না।
দেশে চলছে পুলিশী শাসন, একথা আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবীরা বলছেন, এ কথাটি সাধারণ মানুষেরও যারা ভুক্তভোগী। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব হেজাক লাইট বা টর্চ লাইট দিয়ে খোঁজার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আলোচনা করার পূর্বে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার সুফল দেশবাসী কতটুকু ভোগ করছে তা নিয়ে একটু কথা বলা প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতার চেতনার কথা বললে গোটা জনগোষ্ঠি স্বাধীনতার চেতনা কতটুকু ভোগ করছে তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। আব্রাহাম লিংকন, ডাইসি, অ্যরিস্ট্যাটল প্রমুখ রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ‘রাষ্ট্র’ এবং রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক নির্ধারণে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। কিন্তু আধুনিক জগতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা একটি নতুন সংজ্ঞা যোগ করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ‘নাগরিকদের ভয় মুক্ত রাখাই রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব।’ এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশের তথা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কি ভয়মুক্ত অবস্থায় দিনযাপন করতে পারছে?
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ.ঠ. উওঈঊণ বলেছেন যে, ‘বিলাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কারণ বিলাতের গণতন্ত্র হলো জনমত ভিত্তিক, কেবল আইন ভিত্তিক নয়।’ ঞযব খধি ড়ভ পড়হংঃরঃঁঃরড়হ (১৯১৫) রাষ্ট্রের স্বার্বভৌমত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, ইবযরহফ ঃযব ংড়াবৎরবমহ যিরপয ঃযব ষধুিবৎ ৎবপড়মহরুবং, ঃযবৎব রং ধহড়ঃযবৎ ংড়াবৎবরমহ ঃড় যিড়স ঃযব ষবমধষ ংড়াবৎরবমহ সঁংঃ নড়.ি এখানেও জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্যই গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিয়ে স্বৈরতন্ত্রকেই গ্রহণ করেছে। সরকারের নিকট সব ক্ষমতা রয়েছে। একজন নারীকে পুরুষ এবং একজন পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করা ছাড়া সরকার সবই করতে পারে। এমতাবস্থায় সরকারের কবল থেকে জনগণকে যারা নিরাপত্তা দিবে সে বিচার বিভাগ কি মুক্ত?
গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন যে, উবসড়পৎধপু সবধহং ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব. কিন্তু গণতন্ত্র তার সেই আসল রং হারিয়ে এখন নকল রংয়ে রঞ্জিত হয়েছে। গণতন্ত্র স্বাধীনতার মূল চেতনা এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় আছে কি? বাংলাদেশের গণতন্ত্রে এখন জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন গুরুত্ব না পেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে পুলিশ, যাদের কাছে রয়েছে বৈধ অস্ত্র এবং মিথ্যা মামলা দেয়ার সীমাহীন ক্ষমতা। এদেশে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার রাজনৈতিক ভাষণে যেমন মিথ্যার ফুলঝুরি ছুটে তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ আছে। এ অবস্থা থেকে জাতিকে যারা রক্ষা করবে, যাদের সংবিধানের অভিবাবক বা ঝধভব মঁৎফ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় সে বিচার বিভাগের স্বাধীন অস্তিত্ব কোথায়? বিভিন্ন রাষ্ট্র গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও প্রায় প্রতিটি দেশ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কিন্তু নিজ নিজ সুবিধা মত প্রদান করছে। যেমন বাংলাদেশ সরকার বলছে, উন্নয়নের গণতন্ত্র অর্থাৎ দিনের পর দিন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় থাকাকেও গণতন্ত্র বলে চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশের বিচার বিভাগ কি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ভ‚মিকা রাখতে পারছে? পুলিশ যাকে তাকে যে কোন সময় যে কোন অবস্থায় গ্রেফতার করছে, অভিযোগ থাকুক বা না থাকুক, যদি সে সরকার বিরোধী ঘরনার লোক হয় তবে তো কোন অভিযোগেরও প্রয়োজন হয় না। জামিন হওয়ার পর জেল গেইট থেকে পুরানো মামলা দেখিয়ে পুনরায় গ্রেফতার করে কোর্টে প্রেরণ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোর্ট জামিন না মঞ্জুর করে পুনরায় চাহিদা মতো রিমান্ড মঞ্জুর বা জেল হাজতে প্রেরণ করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, অভিযুক্ত জেলে থাকা অবস্থায় তাকে ঝঐঙডঘ অজজঊঝঞ অর্থাৎ গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করা হয়নি কেন? এ প্রশ্নটি যাদের করার কথা অর্থাৎ বিচার বিভাগ তারাও এ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলে না, বরং পুলিশ যেভাবে চায় সেভাবেই আদালত আদেশ প্রদান করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিচার বিভাগের ভ‚মিকা রাখা প্রয়োজন।
বিচার ব্যবস্থা অর্থাৎ প্রভাববিহীন বিচার ব্যবস্থাই স্বাধীনতার অন্যতম চেতনা। সংবিধান নিশ্চিত করেছে যে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ অর্থাৎ নাগরিকদের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য পবিত্র সংবিধান প্রতিশ্রæতি প্রদান করলেও সে অধিকার কি জনগণ পাচ্ছে? সাংবিধানিক প্রতিশ্রæতি রক্ষা করার জন্য বিচার বিভাগের উপর যে সাংবিধানিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সকল ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ কি সে দায়িত্ব পালন করতে পারছে?
বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু কার্যতঃ আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান পেক্ষাপটে বাস্তবতার নিরিখে সংজ্ঞায়িত করলে কি ধারণা পাওয়া যাবে? বলা বাহুল্য যে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যতটুকু প্রভাবমুক্ত সে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে ততটুকু নিরাপদ। ব্রিটেনে বিচার ব্যবস্থার একটি প্রবাদ রয়েছে যে, ব্রিটেনের একজন অসহায় নিঃস্ব নাগরিকের কুড়েঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকতে পারে, সুর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে, ঘর থেকে চাঁদের আলো দেখা যেতে পারে কিন্তু বিধিবদ্ধ বিধান ছাড়া ব্রিটেনের রানী সে কুড়েঘরে প্রবেশ করতে পারে না।’ অর্থাৎ রানীর প্রতিনিধি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন নাগরিককে বিধিবদ্ধ বিধান ছাড়া নাজেহাল, হয়রানি বা গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ সে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত। অথচ আমাদের রাষ্ট্রের পুলিশের ক্ষমতার নিকট ক্ষেত্র বিশেষে আদালত অসহায়। বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব জনগণের আস্থা-অনাস্থার পাশাখেলায় পরিণত হয়েছে যার অবসান করার জন্য একটি প্রভাবমুক্ত শক্তিশালী বিচার বিভাগ অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন