Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

কুমিল্লায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ

কমছে কৃষিজমি, কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় নষ্ট হচ্ছে খাস জমিও

| প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা থেকে : উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুমিল্লায় বাড়ছে শহরের সংখ্যা। সম্প্রসারিত হচ্ছে অবকাঠামো সুবিধাও। এতে কুমিল্লায়ও নগরায়নের ফলে কমছে কৃষিজমি কমছে ফসল বিলের বুকে গড়ে ওঠছে বহুতল ভবনও। অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা ও বসতবাড়ি নির্মাণের কারণে কুমিল্লায় দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গত দুই দশকে কুমিল্লা কৃষিজমি কমেছে কমপক্ষে দ্ইু হাজার একর। এতে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইট পাথরের দালানে গ্রাস করছে উর্বর শক্তির এই ধানি জমিগুলো। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা নির্মাণে ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই কমছে কৃষি জমি। জলাভূমিও ভরাট করে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, পুকুর খনন, মাছ চাষ ও নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। আবার নগদ টাকার লোভে জমি বিক্রি করে বাস্তুহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট। আবার কোথাত্ত কোথাত্ত সরকারী ভূমি কতিপয় কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।
কুমিল্লায় পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের ছোবলে বৈচিত্র্যও হারাচ্ছে কৃষি। ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। নানাভাবে কৃষি জমি অনুৎপাদনশীল কর্মকান্ডে ব্যবহার চলছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকে কুমিল্লায় কৃষি জমির ব্যাপক সঙ্কটের হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট সব গবেষণার ফলাফলেই কৃষি জমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া এবং অচিরেই বিপন্নতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিপন্নতা মোকাবিলায় সরকারের কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেই। নেই আধুনিক বাস্তবসম্মত কোনো আইন। স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে ফসলি জমির ওপর। পরিবার বিভক্ত হলে তার প্রথম ধকলটিই পড়ে কৃষি জমিতে। এক বাবার চার সস্তান পৃথক হওয়ার পরক্ষণেই আবাদি জমিতে যার যার বাড়িঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ দেখা যায়। অনেকে চাকরির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি জমির কোনো প্রয়োজনবোধ করছেন না। এর পরও আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল। প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে সহ¯্রাধিক হেক্টর জমি। আবাসন ও নির্মাণকাজে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে, তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এখনই কৃষি জমি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
কুমিল্লায় সরকারি কর্মকর্তাদের গাফলতি কারনেও কমছে কৃষি ও সরকারী খাস জমি এমন অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় সরকারী খাস জমি বা পুকুর ভরাট করে শ্রেনী পরিবর্তন করলেও উপজেলায় ভূমি কর্মকর্তারা এসব দেখেও না দেখার ভ্যান করায় প্রতিবছরেই দখল হচ্ছে ত্তইসব খাসজমি। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নে খাস খতিয়ানে থাকা সরকারের সম্পত্তিতে দোকান ঘর নির্মাণ করেন স্থানীয় মো.জামাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। জামাল হোসেন দাবি করছেন খাস যায়গায় টিনের ঘর নির্মাণ হচ্ছে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার জন্য নয়, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে জানান। তবে স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তা সরকারি সম্পত্তি দখলের পর দোকান ঘর নির্মাণের বিষয়টি এখনো শুনেননি বলে জানিয়েছেন। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা বাইশগাঁও ইউনিয়নের শাকতলা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার দিকে একটি কাঁচা রাস্তা পাশে তিন শতকের বেশি সম্পত্তি দখল করেন জামাল হোসেন। এরপর টিন, বাঁশ ও সিমেন্টের পিলার দিয়ে দোকান ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। জামাল নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে ওই ঘর নির্মাণের তদারকি করছেন। গত এক মাস আগ থেকে শুরু হওয়া ওই কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাইশগাঁও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহসিলদার) মো.জাকির হোসেন বলেন, সরেজমিনে গিয়ে দখলের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি লিখিতভাবে উপজেলা ভূমি অফিসকে জানানো হয়েছে। এছাড়া দখলকারী স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি তিনি না সরান তাহলে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ওই স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসমিন আক্তার বলেন, এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এক মাস অতিবাহিত হলেত্ত দখলকারীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থায় নেয়নি ভূমি কর্মকর্তা। এদিকে কুমিল্লা দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ এলাকায় শত বছরের একটি ঐতিহ্যবাহী মোবারকপুর মৌজার ৬০২ দাগের ১১৮ শতক পুকুরের বিভিন্ন পাড় মাটিভরাট কার্যক্রম শুরু হলেও প্রশাসন যেনেও এটি বন্ধের কোন উদ্দ্যেগ নেয়নি। ফলে ভরাটের কাজ চলছে পুরোদমে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোন প্রকার ভাবনা নেই পুকুরটি রক্ষা করার। স্থানীয়রা জানায়, স্থানীয় ভূমি অফিসের পিয়ন এসে পুকুর ভরাট করতে নিষেধ করলেও তাতে কোন কাজ হয়নি। পুকুর ভরাট করার জন্য ভূমিদস্যুরা দাউদকান্দির বড় বড় কর্তাদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভরাটের কাজ করেই যাচ্ছে। এই বিষয়ে ভূমি কর্মকর্তা মোশাররফ জানান, প্রাথমিকভাবে আমরা বাধা দিয়েছি। বিষয়টি আমার উপরস্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি। এই বিষয়ে দাউদকান্দি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি বলেন আমি ডিসি অফিসে একটি পরীক্ষার ইন্টারভিউর কাজে ব্যস্ত আছি । তবে বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দিলেও ঘটনার আজ দেড় মাস অতিবাহিত হলেত্ত ত্তই কর্মকর্তা কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। এছাড়াত্ত জেলার মুরাদনগর, চান্দিনা, তিতাস উপজেলার ভূমি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
তবে প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে কৃষি জমিতে আবাসন, শিল্পকারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো রকম অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। জমি যে ধরনেরই হোক না কেন, তা কৃষি জমি হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। দেশের যে কোনো স্থানের কৃষি জমি এ আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত হবে এবং কোনোভাবেই তা ব্যবহারে পরিবর্তন আনা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই উর্বর জমিতে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেয়া যাবে না। যে কোনো ধরনের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। আইনে বিচার ও দন্ড হিসেবে বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘনকারী বা সহায়তাকারীর অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাদন্ড বা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ দন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে। এ আইনের অধীনে অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা বা বন ও মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মামলা করতে পারবেন। কুমিল্লা ঢাকা জেলার রাজধানী পার্শ্ববর্তী হওয়ায় যত্রতত্র গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্পসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। প্রকল্পে কৃষি জমি গ্রাস করায় এ এলাকায় দ্রæত কমছে আবাদযোগ্য জমি। নতুন আবাসন এলাকাগুলো আবাসনের উপযোগী করে তোলার জন্য মাটি ভরাট করতে হয়। পরবর্তী সময়ে এ জমিগুলো আর চাষাবাদের যোগ্য থাকে না। সরজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশের কৃষি জমি শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে অকৃষিতে পরিণত হচ্ছে। আইন প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে অপরিকল্পিত আবাসন, বাড়িঘর তৈরি, উন্নয়নমূলক কাজ এবং শিল্প-কারখানা বা রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে প্রতিনিয়তই ভূমির প্রকৃতি ও শ্রেণিগত পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি, জলাশয় অথবা জলমহাল বিনষ্ট হয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। পরিবেশেও মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর শিল্প-কারখানা বা রাস্তাঘাট তৈরি রোধ করে ভূমির শ্রেণী ও প্রকৃতি ধরে রেখে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখা জরুরি হয়ে পড়ছে। সেই লক্ষ্যে কৃষি জমি ও কৃষি প্রযুক্তির প্রায়োগিক সুবিধার সুরক্ষাসহ ভূমির পরিকল্পিত ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এদিকে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় ফসলি জমি দখল করে বহুমুখী মৎস্য চাষ প্রকল্প নামের একটি মৎস্য খামার স্থাপন করে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছে এক প্রভাবশালী চক্র। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করে কোনো রকম সহায়তা না পেয়ে দখলদারদের হাত থেকে কৃষিজমি রক্ষায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ভুক্তভোগী জমির মালিক ও কৃষকরা। গত সোমবার (২৩ এপ্রিল) উপজেলার ভিটি পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে প্রকল্পটির সামনে মুরাদনর-ইলিয়টগঞ্জ সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে কৃষক ও জমির মালিকদের মধ্যে বক্তব্য দেন খোরশেদ আলম, কারী আব্দুল জলিল, ইউছুফ মিয়া, খোরশেদ আলম, ছুফিয়া বেগম, আব্দুল হক, রফিকুল ইসলাম, আমেনা খাতুন, রিনা বেগম, হাসিয়া বেগম, মরিয়ম বেগম প্রমুখ। বক্তারা বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে জোরপূর্বক ফসলি জমি দখল ও বিভিন্নভাবে কৃষকদের লোভ দেখিয়ে ১০ বছরের জন্য ইজারা নিয়ে ১০ বিঘা জমিতে বহুমখী মৎস্য চাষ প্রকল্প নামের একটি মৎস্য খামার স্থাপন করে একটি প্রভাবশালী চক্র। ওই চক্রের নানা হুমকিতে সাধারণ কৃষকরা ভয়ে নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। ২০১২ সালে ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও জোরপূর্বক দখল করে মাছ চাষ চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কুমিল্লা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ