Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চারিদিকে বাড়ছে লাশের সংখ্যা

| প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন : সারাদেশেই পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বাড়ছে। নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ ফেলে আড়ালে সটকে পড়ছে দুর্বৃত্তরা। চারিদিকে লাশের সংখ্যা বাড়ায় সাধারন মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি বিরাজ করছে। পুলিশের সক্রিয়তা সত্তে¡ও প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও খুনের পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, কাদার ভেতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকান্ডই বীভৎস ও রোমহর্ষক।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড়। তারা বলছেন, ইন্টারনেটের অপব্যবহার. অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। দ্রæত বিচার না হওয়া ও এ ধরনের হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
জানা গেছে, গত সোমবার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল ইউপির নিভৃত পল্লী ডাবইর ও বাদলাদিঘীর মধ্যবর্তি ধান ক্ষেতে ৪টি গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এছাড়া ফরিদপুরে জোড়া খুন, দিনাজপুর, জামালপুর ও বাগেরহাটে খুনাখুনির ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর দারুসালামের লালকুঠি এলাকা থেকে বিউটি (৪৫) নামে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার খুনের রেশ ধরে পর দিন ব্রাশফায়ারে আরো ৪টি খুনের ঘটনা ঘটে। অপরদিকে গত সোমবার ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলি এলাকার একটি বাসা থেকে সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের এক শিক্ষিকা সাজিয়া বেগম (৩৬) ও সোনালি ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা ফারুক হাসান (৩৮)। শিক্ষিকার লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় এবং ব্যাংক কর্মকর্তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ব্যক্তিগত দ্বন্ধসহ বেশ কিছু কারনে খুনের ঘটনা ঘটছে। এতে করে দেশে ভীতি তৈরি হচ্ছে। খুনের পর প্রকৃত কারনটা জানা যাচ্ছে খুবই কম। এক ধরনের ফায়দা লুটের জন্যও খুনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তাছাড়া খুনের পর লাশ এখানে সেখানে ফেলে রেখে এক ধরনের ম্যাসেজ দেয়া হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে ভীতি বাড়ছে। প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে দ্রæত বিচার করা হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ব্যক্তিগত শত্রæুতার জের ধরে অনেক খুনের ঘটনা ঘটে। এ ধরনের খুন পুলিশের পক্ষে বন্ধ করা কঠিন। প্রতিটি খুনের সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। খুনের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য পুলিশ কাজ করছে। কখনো কখনো খুনীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে কিছুটা সময় লাগলেও কেউ খুন করে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই বলে ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন মন্তব্য করেন।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি এএফএম নাসিম সাংবাদিকদের বলেছেন, নিহত শিক্ষিকার লাশ দরজার পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় এবং ব্যাংক কর্মকর্তার লাশ ফ্যানের হুকের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার বুকেও আঘাতের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে রক্তমাখা ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্ত করে ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানা যাবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানিয়েছেন, পার্বত্য অঞ্চলে চারটি সশস্ত্র গ্রæপের সন্ত্রাসীরাই একের পর এক এই খুনোখুনির ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। আঞ্চলিকভাবে এ খুনোখুনিকে ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ বলে উলেখ করা হয়েছে। আর এই চারটি গ্রæপের কাছে বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্রের মজুত রয়েছে। প্রায়ই এসব অস্ত্রের আস্তানায় হানা দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তার পরও সশস্ত্র গ্রæপগুলোর অস্ত্রের মজুত কমছে না। ফলে খুন-গুম ও অপহরণের ঘটনা ঘটছেই। অপরদিকে গত শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর দারুসসালামের লালকুঠি এলাকা থেকে বিউটি (৪৫) নামে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লালকুঠি এলাকার ৩য় কলোনির ২৫২/১ নম্বর টিনশেড বাসা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। বিউটি লালকুঠি এলাকার ওই বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তার স্বামী মো. কামাল হোসেন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। তিনি মাগুরা সদর উপজেলায় কর্মরত। দারুসসালাম থানার কর্মকর্তা আনোয়ারুল হুদা জানান, কেন ও কি কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ভুষিরবন্দর তেঁতুলিয়া শাহাপাড়া এলাকার ব্রিজ সংলগ্ন ধানক্ষেত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় (৩৫) এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়কের পাশ থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। দিনাজপুর চিরিরবন্দর থানার ওসি মো. হারেসুল ইসলাম জানান, লাশ একটি প্লাস্টিকে মোড়ানো ছিল। নিহতের পরিচয় উদ্ধারে চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অপরদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে একজন সন্দেহভাজন আসামির মৃত্যু হয়েছে। গত শনিবার রাতে আটক করা হয়েছিল এক নিকট আত্মীয়কে অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে। পরে সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের নাম আসলাম (৪৫)। তিনি পেশায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক। গত ২৫ ফের্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর মহাখালী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদে টাইলস ফিটিংয়ের কাজ তদারকি করতে যান ঠিকাদার নাসির কাজী। ৮টার কয়েক মিনিট আগে মসজিদের উত্তর পাশের গলিতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে তার বুক ও পেট ঝাঁজরা হয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। খুনিরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান নাসির। কলেজ ছাত্রী আঁখি আক্তারকে খুন করে লাশ ট্রাভেল ব্যাগে ভরে ফেলে রাখা হয় বিমানবন্দর রেলস্টেশনে। ২৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। একই দিন রাতে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের ছাদে সাকিব খান নামে এক কিশোরের লাশ পাওয়া যায়। তাকে খুন করে সেখানে ফেলে রাখে দুর্বৃত্তরা। এখনও গ্রেফতার হয়নি খুনিরা।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছেন ৩ হাজার ৫৪৯ জন। ২০১৬ সালে ৮৭৯ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন খুন হয়েছেন। গত ৫ বছরে রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২১৮ জন, ২০১৬ সালে ৪৮ জন, ২০১৫ সালে ২৩৯ জন, ২০১৪ সালে ২৬২ জন, ২০১৩ সালে ২৪৫ জন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: লাশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ