Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বায়ুদূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ফাহিম আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


স¤প্রতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঢাকার তিনটি এলাকা (দারুসসালাম, ফার্মগেট, সংসদ ভবন), চট্টগ্রামের দুটি এলাকা (টিভি স্টেশন, আগ্রাবাদ), গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল শহরের বাতাস পর্যবেক্ষণ করে এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য শহরের বায়ু দূষণের বর্তমান পরিস্থিতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা যাক।
পিএম-১০ (১০ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যসের বস্তুকণা) এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি নারায়ণগঞ্জে। শহরটিতে পিএম-১০ এর পরিমাণ ২১২ দশমিক ২৯ মাইক্রোগ্রাম যেখানে এর সহনীয় মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম। নারায়ণগঞ্জের পরেই অবস্থান রাজশাহীর। শহরটিতে পিএম-১০ এর পরিমাণ ১৪৭ দশমিক ৭০ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকা, গাজীপুর, বরিশাল এবং চট্টগ্রামে পিএম-১০ এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৩৬ দশমিক ৯১ মাইক্রোগ্রাম, ১৩৬ দশমিক ৬৯ মাইক্রোগ্রাম, ১৩২ দশমিক ১৪ মাইক্রোগ্রাম এবং ১২১ দশমিক ১২ মাইক্রোগ্রাম।
পিএম-২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যসের বস্তুকণা) এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জে। শহরটিতে পিএম-২.৫ এর পরিমাণ ৯৪ দশমিক ০৫ মাইক্রোগ্রাম যেখানে এর সহনীয় মাত্রা ১৫ মাইক্রোগ্রাম। নারায়ণগঞ্জের পরেই অবস্থান রয়েছে ঢাকার। শহরটিতে পিএম-২.৫ এর মাত্রা ৮৪ দশমিক ৫৩ মাইক্রোগ্রাম। গাজীপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং রাজশাহীতে পিএম-২.৫ এর মাত্রা যথাক্রমে ৮৪ দশমিক ৩৯ মাইক্রোগ্রাম, ৭৮ দশমিক ৭৮ মাইক্রোগ্রাম, ৬৫ দশমিক ৯৪ মাইক্রোগ্রাম এবং ৬১ দশমিক ৬৭ মাইক্রোগ্রাম। দেখা যাচ্ছে ঢাকা এবং গাজীপুরে পিএম-১০ এবং পিএম-২.৫ এর পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি ।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সারা বছর এমন দূষণ হয় কিন্তু তা নয়। প্রতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়ন কাজ পরিচালনা, বৃষ্টি না হওয়া, ইটভাটা এবং নির্মাণকাজ পরিচালনা করার কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সময় বাতাসে পিএম-১০ এবং পিএম-২.৫ এর পরিমাণ সহনীয় মাত্রায় থাকে বলে মনে করা হয়।
বায়ুদূষণের মূল কারণগুলোর মধ্যে ইটভাটা অন্যতম। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোন প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠছে ইটভাটা। বেআইনিভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, এর ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য অন্যদিকে দূষিত হচ্ছে বায়ু। পরিবেশ রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটার বিকল্প নেই। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো এবং টপ সয়েল ব্যবহার বন্ধ না করলে বায়ুদূষণ ঠেকানো সম্ভবপর নয় একই সাথে ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে জনগণের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা।
নরওয়ে ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউ-এর সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদফতরের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী। ইটভাটাগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমানোসহ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ দূষণ কমানো সম্ভব।
বায়ুদূষণের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মোনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন অন্যতম। কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রধান উৎস কলকারখানা, যানবাহন। কার্বন মনো-অক্সাইড মানুষের শ্বাসক্রিয়ার চূড়ান্ত ক্ষতিকারক এই গ্যাস বায়ুমÐলের গ্যাসীয় ভারসাম্যের বিঘœ ঘটায়। পুরনো যানবাহন থেকে এই গ্যাসের উৎপত্তি। ট্যানারি এবং অন্যান্য কলকারখানার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার অন্যতম উপাদান সালফার ডাই-অক্সাইড। বাতাসের ভাসমান জলীয় বাষ্পের সাথে মিশে গিয়ে এই গ্যাস অতি ক্ষতিকারক অ্যাসিড বৃষ্টি ঘটাতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থাপত্যের ক্ষতির মূল কারণ এই গ্যাস।
এসব গ্যাস ছাড়াও সোনার কারখানাতে ব্যবহৃত নাইট্রিক অ্যাসিডজনিত গ্যাস যেমন নাইট্রোজেন মোনো-অক্সইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি প্রায় সব কারখানাতেই ব্যবহৃত সালফারের যৌগ, ক্লোরিনের যৌগ ইত্যাদি থেকে নির্গত গ্যাস বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।
বিগত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশন’-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পরিস্থিতি-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয় বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে নাগরিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণের কারণে সার্বিকভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে শ্বাস নালির সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, অ্যাঁজমার ঝুঁকি ইত্যাদি। তাছাড়া বায়ুদূষণের ফলে গর্ভবতী নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের প্রতি বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যা দেশের সুস্থ মানব সম্পদ তৈরির মূল অন্তরায়।
বাংলাদেশে এখনো বায়ুদূষণ রোধে উল্লেখযোগ্য কোন আইন প্রণয়ন করা হয়নি। বায়ুদূষণরোধে প্রয়োজন কঠোর আইন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর না হলে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্মাণকাজ পরিচালনা করার সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্মাণ সামগ্রীর যথাযথ সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দেশের সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের। অনেক সময় দেখা যায় বায়ুদূষণের কারণে অভিযুক্ত হওয়া সত্তে¡ও কর্মকর্তারা অন্যায়ভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। সমঝোতা করে থাকেন কর্তৃপক্ষের সাথে। এরূপ গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। পেশাদারিত্বে সাথে পালন করতে হবে কর্মকর্তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। কোন একক কর্তৃপক্ষের বায়ুদূষণ রোধে কাজ করে সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়। সরকার, জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন