Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সম্মিলিত কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার বিষয়ে বহুদিন ধরেই মিয়ানমার টালবাহানা করছে। উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে বারবার বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের পাশে আছে বলে অভয় দিয়ে আসছে। বিশ্বসংস্থার কর্মকর্তা ও বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানসহ অনেকেই নিয়মিত বিরতিতে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করে সমবেদনা জানাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়া হবে এবং তা অব্যাহত রাখা হবে বলেও আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কিছুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অব্যাহত থাকবে। চিঠিতে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ সরকার যে উদার মানবিক সাড়া দেখিয়েছে, সে জন্য তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র গভীর কৃতজ্ঞ। দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়াটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট বোঝা। বাংলাদেশের এই তৎপরতা হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, এটা বিশ্ব জানে। ট্রাম্পের এ বক্তব্য ইতিবাচক। এদিকে গত সপ্তাহে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছে। তারাও বলেছেন, এ সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকে করতে হবে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনই মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করতে চাচ্ছে না। বাংলাদেশ থেকে এই প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফরে যায়। সেখানে অং সান সুচি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে যুক্ত করা যায়। মিয়ানমারে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বব রে বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের জোর প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনসহ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের বিচার করতে হবে। আজ ঢাকায় শুরু হচ্ছে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। জানা গেছে, এ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যু বিশেষ গুরুত্ব পাবে। ওআইসি আগেই রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে এবং তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন দাবী করেছে।
গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা হঠাৎ করেই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সাঁড়াশি হামলা চালায়। তারা বাংলাদেশের নাগরিক উল্লেখ করে বিতাড়নের জন্য খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়। লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাসস্থান, খাদ্যসংস্থান, চিকিৎসা দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হয়। সীমিত সামর্থ্য নিয়েও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বিধানে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং এখনও যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের নৃশংস ও বর্বর এ হামলা বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও ধিক্কারের ঝড় ওঠে। বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহŸান জানাতে থাকে। কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার প্রধান ও প্রতিনিধিরা আসেন। তারা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং মিয়ানমারের নিন্দা জানান। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক এবং চুক্তি সই হয়। চুক্তি হয়ে যাওয়ার পরও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। মিয়ানমার নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে নিব-নিচ্ছি করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে এবং রোহিঙ্গা বিতাড়ন অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ গত মাসে নোম্যান্স ল্যান্ড থেকে এক পরিবারকে ফিরিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া শুরু হচ্ছে বলে চরম প্রতারণার আশ্রয় নেয়। এ প্রেক্ষিতে, জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের বক্তব্য-বিবৃতি অব্যাহত রেখেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তারা কেবল বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছে, মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে যে সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য বাধ্য করা প্রয়োজন, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। তারা মুখে মুখে বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ ও প্রশংসা করে যাচ্ছে। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটি কেউ করছে না। ফলে পুরো বিষয়টি এখন লিপ সার্ভিসে পরিণত হয়েছে। আসন্ন বর্ষায় রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে, অন্যদিকে বোঝা হয়ে চেপে বসা রোহিঙ্গাদেরও দেখভাল করতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অনেক সহানুভূতি প্রকাশ ও বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এসবে যে কোনো কাজ হচ্ছে না, তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এসবের পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোকে তাদের লিপ সার্ভিস বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন তা নিতে হবে। দশ লাখ রোহিঙ্গাকে অনিশ্চিতকাল ধরে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব। এটি এখন স্পষ্ট যে চীনকে ছাড়া এ সমস্যা সমাধান কষ্টসাধ্য। পাশাপাশি রাশিয়া ও ভারতের সহায়তা প্রয়োজন। এদের প্রত্যেকের সাথেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব, ওআইসি এবং চীন, রাশিয়া ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সামর্থ্য ও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হবে। সংকটের ন্যায়সঙ্গত ও দ্রæত সমাধানের বিকল্প নেই।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ