Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী ব্যাংকের নাজুক হাল

| প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

একটি বিশেষ রাজনৈতিকদলের কথিত প্রভাবমুক্ত করতে গত বছরের জানুয়ারীতে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানাসহ শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নানাবিধ অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির শিকার হয়ে বড় ধরণের সংকটে পতিত হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী মালিকানাধীন বড় ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। তবে ইসলামী ব্যাংক তার যাত্রার শুরু থেকেই নিজস্ব নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার আলোকে তার অগ্রযাত্রা অব্যহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালার কারণে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক এই ব্যাংকটি দেশের বৃহত্তম বেসরকারী ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোটি গ্রাহক এবং লাখ লাখ বিনিয়োগকারির ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে পড়েছে ইসলামী ব্যাংকের পথচলা। ব্যাংকিং সেক্টরের চরম দুর্দশা ও দুর্দিনেও আলোর পথ দেখানো এমন একটি সফল ব্যাংককে শ্রেফ রাজনৈতিক কারণে এখন বড় ধরনের সংকটের সম্মুখীন করা হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের জালিয়াতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে যেখানে অধিকাংশ সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, সেখানে সমহিমায় এগিয়ে চলা ইসলামী ব্যাংক ছিল অন্যদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ও প্রেরণার উৎস। অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দার সময়ও যে সব ব্যাংক সংকট কাটিয়ে দেশে বিনিয়োগ ও রেমিটেন্স প্রবাহ ঠিক রাখতে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল ইসলামী ব্যাংক তার অন্যতম।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে বেড়ে ওঠা ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপণা বদলের মাত্র ১৫ মাসের মধ্যেই ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পতিত হয়েছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারী রাজধানীর একটি হোটেলে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারির পদত্যাগের কথা ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রামভিত্তিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এসআলম গ্রæপের মালিকানাধীন কয়েকটি কোম্পানীর নামে বাজার থেকে শেয়ার কিনে মালিকানা পরিবর্তনের এই উদ্যোগ নেয়া হয়। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার পর নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরাস্তু খান ইসলামী ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালায় কোন পরিবর্তন না আনার কথাও ঘোষনা দিয়েছিলেন। তবে ব্যাংকের মালিকানা বদলের ১৫ মাসের মধ্যে আবারো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে আরাস্তু খানও বিদায় নিয়েছেন। এমনকি ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। একজন নন ব্যাংকার, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি শামিম আফজালের মত বিতর্কিত ব্যক্তিকে ইসলামিক ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় ব্যাংকের অভ্যন্তরে ও বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বলে জানা যায়। তিন দশকের বেশী সময় ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম ব্যাংকটির অগ্রযাত্রা ব্যহত করার নেপথ্যের সামগ্রিক তৎপরতা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য একটি বড় ধরণের অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে স্থিতিশীল ও মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি ও সূচকের উপর দাড়িয়ে থাকা ব্যাংকটি এখন অন্যান্য বেসরকারী ব্যাংকের মতই নাজুক, অস্থিতিশীল ও নড়বড়ে অবস্থায় পড়েছে। ইসলামী ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়তে বাধ্য। এক বছর আগেও যেখানে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা ইসলামী ব্যাংকের দ্বারস্থ হত সেখানে এখন ইসলামি ব্যাংকের তারল্য ও আর্থিক সংকটের কারণে ব্যাংককে আমানতের পেছনে ছুটতে হচ্ছে।
দেশের বিনিয়োগ, শিল্পায়ণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টর অনুঘটকের ভ‚মিকা পালন করে থাকে। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর সে কাঙ্খিত ভ‚মিকা পালনে কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। উপরন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। গতকাল প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংককিং ম্যানেজমেন্ট(বিআইবিএম)’র এক গবেষনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশ থেকে অর্থ পাচারের বড়(৮০ শতাংশ) অংশই যাচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ইনভয়েসিং জালিয়াতিসহ চারটি কৌশলে টাকা পাচার হচ্ছে। বেসরকারী ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদের সমর্থন বা যোগসাজশ ছাড়া এহেন কর্মকান্ড পরিচালিত হওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংক জালিয়াতির রাস্তা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার তাগিদ খোদ ব্যাংকিং সেক্টর সংশ্লিষ্ট এবং অর্থনীতিবিদদের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। ইসলামী ব্যাংকের মত বেসরকারী খাতের বৃহত্তম ও সফলতম ব্যাংকটিকে অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের মুখে ঠেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বিশৃঙ্খলাকে সর্বব্যাপ্ত করে তোলা হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে দেশের একমাত্র ব্যাংকটি দ্রততম সময়ে নেতিবাচক ও দুরবস্থায় পতিত হওয়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়না। ব্যাংকিং সেক্টরের বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, অব্যবস্থাপনা দূর করতে না পারলে দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে গতিশীল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। গত বছর ইসলামি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনকে দুশ্চিন্তার বিষয় বলে অভিহিত করেছিল সিপিডি। একই সঙ্গে তারা এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের আহŸান জানিয়েছিল। মাত্র এক বছরেই ইসলামি ব্যাংকের গ্রাহক, আমানতকারিদের মধ্যে দুশ্চিন্তার রেখাপাত তীব্র হয়ে উঠেছে। গ্রাহক ও আমানতকারির আস্থাপূর্ণ আশ্রয়স্থল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন বা অন্য কোন কারণে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার বাস্তবতা রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ও জরুরী উদ্যোগ প্রয়োজন।



 

Show all comments
  • সফিক আহমেদ ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:৫১ এএম says : 0
    আল্লাহই ভালো জানেন এই ব্যাংকের কপালে কি আছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামী ব্যাংক


আরও
আরও পড়ুন