Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারত চায় ভাঙতে, পাকিস্তান চায় সার্ককে বড় করতে

| প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাউথ এশিয়ান মনিটর : ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা স¤প্রতি যে পাকিস্তান সফর করেন, সেটা শুধু সামরিক মহড়া দেখার বিষয় ছিল না। এই অঞ্চলে পাকিস্তানের গুরুত্ব নিয়ে সেটা ছিল একটা অর্থপূর্ণ বিবৃতি। তাছাড়া শ্রীলংকার তামিল সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তান যে উল্লেখযোগ্যে ভূমিকা রেখেছিল সেটার স্বীকৃতিও ছিল সফরের আরেকটা দিক।
পাকিস্তান ১৯তম সার্ক সম্মেলন আয়োজনের জন্য আঞ্চলিক সমর্থন অর্জনের যে চেষ্টা করছে, সিরিসেনার উপস্থিতিকে তার প্রতি সমর্থন হিসেবেও দেখা যায়। ভারত আবারও এই সম্মেলন বয়কটের মাধ্যমে স্যাবোটাজের চেষ্টা করছে, যাতে অন্য সদস্য দেশগুলোকে এর ধকল সামলাতে হয়।
কিন্তু পাকিস্তান পাল্টা-পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। সিরিসেনা পাকিস্তানে আসার কয়েক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আব্বাসি নেপাল সফরে যান। আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে ইতিবাচকভাবে এতে অন্তর্ভুক্ত করার নীতি থেকেই ওই সফরে যান তিনি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ওলি নেপালের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর আব্বাসিই প্রথম বিদেশী কোন দেশের সরকার প্রধান হিসেবে নেপাল সফর করেন। এতেও পুরো প্রচেষ্টার গুরুত্ব বোঝা যায়।
কিছু দেশের মনোভাব হলো সার্ককে আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›িদ্বতার ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা উচিত। তবে অন্যরাও রয়েছে যাদের ভাবনাটা ভিন্নরকম। তারা এই ফোরাম নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়, বহু সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যেটার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, যে সমস্যাগুলো আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পর্যায়ে নেতিবাচক কালো ছায়া ফেলেছে।
ভারতের ‘সার্ক-বিরোধী’ মনোভাব এ অঞ্চলকে এরইমধ্যে বিভক্ত করে ফেলেছে। তবে বিমসটেকের মতো অন্যান্য গ্রæপের প্রতি ভারতের সমর্থন থেকে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের সাথে শত্রুতাকে পুঁজি করে সার্ককে জিম্মি করে রাখতে চায় ভারত। কিন্তু অন্যান্য গ্রæপের সাথে ঠিকই কাজ করতে চায় ভারত যেগুলো দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রিক নয়। ভারত একই সাথে জ্বালানি-সমৃদ্ধ মধ্য এশিয়ার সাথে আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপনের সুযোগ থেকে সার্কের সদস্য দেশগুলোকে বঞ্চিত করতে চায়, কারণ সে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উপর দিয়েই কেবল মধ্য এশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপন হতে পারে বা লাভজনক হতে পারে।
বিমসটেকের নিজস্ব সুবিধা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু যেটা বুঝতে হবে সেটা হলো বিমসটেক সার্কের খুব দুর্বল বিকল্প হবে কারণ এর আঞ্চলিক ফোকাস সম্পূর্ণ আলাদা।
পাকিস্তান অন্যদিকে শুধু যে সার্ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, তা নয়, বরং চীনকে এতে অন্তর্ভুক্ত করে একে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চাচ্ছে। ভারত অবশ্যই সেটা চাইবে না, কিন্তু অন্যান্য দেশ বিশেষ করে যারা এরইমধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের সহযোগী হয়েছে, তারা পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ সঠিক হিসেবেই বিবেচনা করবে।
মার্চ মাসে নেপালে প্রধানমন্ত্রী আব্বাসির সফরের সময় এর কিছু ঝলক দেখা গেছে। উভয় দেশই সে সময় সার্ককে পুনরুজ্জীবিত ও স¤প্রসারিত করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। নয়াদিল্লীর কাছে সেটা ছিল সতর্ক সঙ্কেতের মতো।
নেপালের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এটা নিশ্চিত করা হয় যে, পাকিস্তান ও নেপাল আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে এবং সার্ককে আরও কার্যকরি করে তুলতে সম্মত হয়েছে। অন্য বিষয়গুলো থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে, এই পদক্ষেপ অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ বিশেষ করে শ্রীলংকার কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাবে। চীনকে যদি সার্কে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে শুধু যে ভারতের প্রভাবই এখানে কমবে, তা নয়। বরং এই ফোরামে তখন বাড়তি শক্তি যুক্ত হবে এবং মিয়ানমার সঙ্কট এবং বিবাদপূর্ণ বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সঙ্কটগুলো সমাধানেও এটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা ও এর স¤প্রসারণ করাটা খুবই কাজে লাগবে। কারণ এটা শুধু যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো সমস্যাগুলো আঞ্চলিক ফোরামে সমাধানের জন্য সাহায্য করবে তা-ই নয়, বরং বড় একটা অর্থনৈতিক শক্তি সংস্থায় যুক্ত হলে তা ভারতের আধিপত্য কমাতেও সাহায্য করবে।
এটা নিয়ে কোন বিতর্ক থাকতে পারে না যে, নয়াদিল্লীর তুলনায় বেইজিং থেকে সবসময় বেশি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই চীনকে সার্কে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে এমনকি নেপাল ও শ্রীলংকার চেয়েও বেশি আগ্রহী হওয়া উচিত ঢাকার। এতে করে অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশও এশিয়ার দুটো বড় শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারবে এবং দুটো দেশ থেকেই সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারবে।
চীনের দিক থেকে সার্কে অন্তর্ভুক্ত হলে এর সদস্য দেশগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে এবং যে অঞ্চলটাতে চীনের প্রভাবকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে চীনের প্রভাব আরও বাড়বে।
ভারতের কাছে তাই চীনের অন্তর্ভুক্তির ভয়ে সার্ককে হত্যা করা এবং স্যাবোটাজ করাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্কের ব্যাপারে অব্যাহত স্যাবোটাজ এবং বিমসটেককে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে এটা ভালোই বোঝা গেছে যে, ভারত ছোট ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর তার একক আধিপত্য বজায় রাখতে চায় এবং তাদেরকে এমন একটা গ্রুপের মধ্যে বেঁধে রাখতে চায় যেখানে পাকিস্তান বা চীন কেউই নেই। আর এভাবেই ‘আঞ্চলিক সর্বশক্তিধর’ এবং সবচেয়ে আধিপত্যবাদী শক্তি হয়ে উঠতে চায় ভারত।
আঞ্চলিক ছোট দেশগুলো দেখতে পাবে যে, সার্ককে স্থায়ীভাবে অকার্যকর করে রেখে ভারত এর সদস্য দেশগুলোকে তাদের সুমিষ্ট যুক্তি গেলানোর চেষ্টা করছে এবং এভাবেই ভারতীয় আধিপত্য মেনে নিতে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ভারতের অনুকূলে আর নেই যেমনটা ২০১৬ সালে ঘটেছিল। ভারত সে সময় সফলভাবে সার্ক সম্মেলনকে হত্যা করতে পেরেছিল। এখন ঠিক উল্টাটা হতে চলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইচ্ছাই হোক বা অনিচ্ছায় বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভুটান যদি ২০১৮ সালে সার্ক সম্মেলন না হওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে হয়তো সেটা ভারতের জন্য ভূ-রাজনৈতিক বিজয় হবে। কিন্তু সম্মেলন আয়োজনের পক্ষে এবং সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে নেপাল, শ্রীলংকা এবং এমনকি মালদ্বীপের সমর্থন থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ভারতের পক্ষে সমর্থনটা আর সর্বসম্মত পর্যায়ে নেই।
অন্যদিকে, চীনকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ভারতের অবস্থানকে আরও নড়বড়ে করে তুলবে বলে ধারণা করা যায়। দীর্ঘমেয়াদে এতে দিল্লীর হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ ফসকে যেতে পারে। এতে ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিও ক্ষতিগ্রস্থ হবে আর সার্ককে বিলুপ্ত করাটাও তখন আরও বেশি কঠিন হয়ে যাবে।
সব সদস্য দেশেরই এখন সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত এবং ‘সম্মেলন বাতিলের’ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত। এ পরিস্থিতির কারণেই সার্ক কর্মসূচিগুলো থমকে আছে এবং এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যেটা শুধু পাকিস্তানের জন্যই ক্ষতিকর নয় - যেমনটা ভারত ভেবে আনন্দ পাচ্ছে - বরং সকল সদস্য দেশের জন্যই ক্ষতিকর।

 



 

Show all comments
  • তানিয়া ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:২৭ এএম says : 0
    সার্ক ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য জরুরী
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ