Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিষ্ঠুর বর্বরতা : তিন মাসে ধর্ষণের পর ১৯ হত্যা

ধর্ষণকারীরা বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর, সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহতা বেড়েছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৮৭ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নিঠুর বর্বরতার শিকার হচ্ছে শিশু ও নারী। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণের মতো অনৈতিক কর্মকান্ড। বিচারহীনতার কারণে দিন দিন ধর্ষণকারীরা আরো বেপরোয়া হচ্ছে। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে উল্টো ভিকটিম ও তার পরিবারই পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের পর হত্যা করেই কান্ত হচ্ছে না ধর্ষণকারী। কোন কোন সময় লাশও গুম করা হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থির খবর হলো পিতা, ভাই, চাচা, মামা,খালু ও নিকট আত্মীয়দের হাতে নিরাপদ নয় শিশু কন্যা ও নারী। পিতার হাতে মেয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনায় উদ্বেগ উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সমাজ বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, সামাজিক মূলোবোধের অবক্ষয় বিবেকের ধস নেমেছে সমাজে। ধর্ষণের মতো বর্বরতার পর হত্যা করার ঘটনা ঘটেই চলেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে ১৮৭ জন কন্যা শিশু ও নারী ধর্ষিত হয়েছেন। এ তিন মাসের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও অধিকাংশ অপরাধী রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শূধু তাই নয় মামলা করতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ভিকটিম ও তাদের পরিবার।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেক ধর্ষণকরীর শাস্তি হচ্ছে না। তিনি বলেন,রাষ্ট্র চাইলে দ্রæত বিচার নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু গরিব এই নারীদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের গরজ খুব কম।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) জরিপের বরাতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে দেশে মোট ১৮৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৯ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন দু’জন এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ২১ জন নারীকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, মহানগরের প্রতিটি থানায় নারী ও শিশুবান্ধব সহায়তা ডেস্ক খোলা হয়েছে। সেখানে নারী কর্মকর্তা থাকেন। নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগে নারী কর্মকর্তা আছেন। অভিযোগগুলো তারপরও উঠছে।
একজন আইনজীবী জানান,পুলিশের অবহেলা ও তদন্ত কার্যক্রমের দীর্ঘসুত্রতার কারণে অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না। তিনি বলেন,রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা এলাকা ২০০৪ সালের মার্চে একজন মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিলেন। তিনি একজন পোষাকশ্রমিক। এ ঘটনার প্রায় ১৪ বছর হলো অপরাধীদের বিচার হওয়াতো দুরের কথা পুলিশ তাদের গ্রেফতারই করতে পারেনি। এ মামলায় ঢাকার ৪ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একটি ধর্ষণ মামলার বিচার চলছে। অপরাধীদের পুলিশ সনাক্ত করতে পারেনি। ফলে তারা আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মামলার পলাতক দুই আসামির ঠিকানা না মেলায় তাঁরা অব্যাহতি পান। অচেনা দুজনের কোনো হদিসই মেলেনি। তবে ঘটনার সময় লোকজন বাসার এক তত্ত¡াবধায়ককে আটকে ফেললে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মামলায় তিনি অভিযুক্ত হন। পরে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান।
এ মামলায় রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন ১৪ জন। মেয়েটি ২০০৫ সালে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দিয়েছেন ডাক্তারসহ চারজন। তবে ২০১৬ সালের এপ্রিলের পর থেকে পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আর কোনো সাক্ষীকে হাজির করেননি। ধর্ষণের শিকার ওই মেয়েটির চিকিৎসা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। পরে একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে আশ্রয় পান। মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে রাস্তা ফেলে রাখলে পথচারীরা উদ্ধার করে। পরে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম বলেন, বর্তমানে ওসিসিতে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার শিশু বেশি আসে। এসব শিশুর অনেকের ক্ষেত্রেই ধর্ষক নানা ধরনের বীভৎসতার চিহ্ন রেখে গেছে। কারও ক্ষেত্রে অঙ্গ কাটাছেঁড়া, কারও ক্ষেত্রে শারীরিক নানা নির্যাতনের চিহ্ন থাকে। এই অবুঝ শিশুদের পতি এধরনের আচরণের কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা কঠিন। এধরনের নৃশংসতা শিশুদের আজীবনের জন্য নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করিয়ে দেয়।
ধর্ষণের ঘটনায় কেন এমন বীভৎসতা প্রশ্নে মনোরোগ বিশ্লেষক মেখলা সরকার বলেন, ধর্ষণ যারা করে তাদের নৈতিকতার জায়গায় কমতি থাকে। ধর্ষণ যৌন বিকৃতি না, মানসিকভাবে তাদের স্বাভাবিক নৈতিকতার জায়গায় অভাব আছে। যে ব্যক্তি ধর্ষণের বীভৎসতা করে তার ব্যক্তিত্বে ত্রুটি থাকে। সে অন্যদের প্রতি হিংস্রতা প্রয়োগ করে মজা পায়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা বীভৎস আচরণ করে, হয়তো সামনে আসে না।
চট্রগ্রাম মহানগরীতে নিজের বাবার বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৬ মার্চ এঘটনায় অভিযুক্ত বাবাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। বুকে ছুরি ধরে, ভয় দেখিয়ে বাবা নিয়মিত যৌন নির্যাতন করতেন বলে অভিযোগ করেছেন মেয়ে। তার আগের মাসে ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সার্সন রোডের পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে নয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার খবর প্রচরিত হয়। এই শিশুটিকে ধর্ষণের ও হত্যার ১৭ দিন আগে নগরীর আকবরশাহ থানার বিশ্ব কলোনির একটি ভবনে ডেকে নিয়ে আরেক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়।
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে ১০ বছরের সিমুকে ধর্ষণের পর কুপিয়ে হত্যা করা হয়। শিশুটিকে ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্নস্থানে কোপানো হয়। তার শরীরে অন্তত ৫/৬টি কোপের আঘাত পাওয়া গেছে।
ধর্ষণের মতো অপরাধ করে ক্ষান্ত না হয়ে নির্মমভাবে হত্যা এবং অঙ্গহানির মতো নানা খবরে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। আর মনোরোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণ যৌনবিকৃতি না, যারা ধর্ষণ করছেন, বীভৎস আচরণ ও হত্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন,মানসিকভাবে তাদের স্বাভাবিক নৈতিকতার অভাব আছে। তারা অন্যদের প্রতি হিং¯্রতা প্রয়োগ করে মজা পায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনি সহায়তা কার্যক্রমের পরিচালক অ্যাডভোকেট মাকছুদা আখতার বলছেন,ধর্ষিতা মেয়েটি সব সময় ভয়ভীতির মধ্যে সময় অতিবাহিত করেন। মামলা করতে গেলে বিপক্ষের আইনজীবী তো বটেই, পুলিশ-ডাক্তার আর রাষ্ট্রপক্ষেরও অনেকের মধ্যে অবিশ্বাস আর মেয়েটির দোষ খোঁজার মানসিকতা থাকে।
তিনি বলেন, ধর্ষণের মামলার বিচার দ্রæত নিস্পত্তি করার পাশাপাশি ভিকটেমের ও তার পরিবারের নিরাপত্ত নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলে এবং তা দ্রæত বাস্তবায়ন হলে ধর্ষণকারীদের মধ্যেও ভয়ভীতি কাজ করবে।
আসক -এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন,ক্ষমতার নানা দিক থাকে। ধর্ষণকে যখন প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়, তখন বীভৎসতার পরিমাণ বাড়ে। কেবল ধর্ষণ করে সে তার ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হচ্ছে ভাবলে, তখন সে আরও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। অন্য অনেকে তার এই নিষ্ঠুরতা নিয়ে কথা বলবে, সেটিকে সে এনজয় করে।’ তিনি আরও বলেন, কাঠামোর যে ক্ষমতা, সেখানে ধর্ষক সবসময়ই সুবিধাবাদী জায়গায় থাকে। ফলে সে চায় প্রতিশোধটি কত বেশি নিষ্ঠুরভাবে নেওয়া যায়।
তিনি বলেন, সবার মনেই নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্রবৃত্তি থাকে। আমরা নেতিবাচক প্রবৃত্তিগুলো দমিয়ে রাখি। এই হিং¯্রব্যক্তিরা প্রবৃত্তিগুলো চর্চা করে এবং শাস্তি না হওয়ায় প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ এক ধরনের ক্ষমতা প্রদর্শনও উল্লেখ করে মেখলা বলেন, ধর্ষণ করে হত্যা করা মানে একটি নেতিবাচক জায়গা কীভাবে আরেকটি নেতিবাচক জায়গাকে উৎসাহিত করে। এই ভয়ঙ্কর মানসিকতার অপরাধীরা মানুষজনকে জানাতে চায়, সে কী কী করতে পারে। মানুষ যে এগুলো নিয়ে কথা বলছে তাও তাদেরকে আত্মতৃপ্তি দেয়। এমনকি ভেতরে কোনও হীনমন্যতা থাকলেও এমনটা ঘটতে পারে। হীনমন্যতাগুলোকে মানুষ ছাপিয়ে তোলার জন্য নানা অপরাধে সম্পৃক্ত হয়। অ্যাবিউজ থেকেও বিষাক্ততা তৈরি হয় এবং যৌনতার স্বাভাবিক ধারণা সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা শেখে।



 

Show all comments
  • ash ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ৫:০৩ এএম says : 0
    pasher barir kudumder shongskriti tai Bangladesh e ashche akhon !! 10 bosor ageo amon ta silo na , jeta akhon hoche ohoroho . etakei bole kudum shongskriti
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ