Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা কর্মকর্তা ও গ্রাহকরা আতঙ্কে

আরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত : ২৫ এপ্রিলের বোর্ডসভার দিকে তাকিয়ে সবাই

| প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : হঠাৎ করে ইসলামী ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগে ব্যাংকের মধ্যে এক ধরণের স্থবিরতা বিরাজ করছে। কখন কি হয় এই নিয়ে আতঙ্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কারণে ব্যাংকে গ্রাহকদের উপস্থিতিও কম লক্ষ্য করা গেছে। গতকাল দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়, মতিঝিল অফিসসহ অধিকাংশ শাখায় সকলের মধ্যে এক ধরণের স্থবিরতা লক্ষ্য করা গেছে।
অথচ শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে ইসলামী ব্যাংকের সুনাম ছিল বিশ্বব্যাপী। গত তিন দশক ধরে ব্যাংকটি ব্যবসা করে আসছে। এই সময়ে লাখো উদ্যোক্তা তৈরিতে অবদান রেখেছে। কিন্তু অল্প সময়ে তা নষ্ট হতে চলেছে। ব্যাংকটিতে বর্তমানে চলছে চরম অস্থিরতা। একে একে বিদায় নিচ্ছেন ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ফলে ব্যাংকটি ইমেজ সংকটে পড়েছে। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তার সংকটে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংকটি। গত ১৬ মাসে পদত্যাগ করেছেন দুই চেয়ারম্যান, তিন এমডি, তিন ডিএমডিসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা।
ধারাবাহিকভাবে পদত্যাগের বিষয়ে আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ব্যাংকিংখাতের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংক নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হবে। তবে একদিক দিয়ে ভালো প্রচলন শুরু হয়েছে। ব্যাংকাররা এখন আর বোর্ডের কথা অনুযায়ী চলছেন না। পরিচালনা পরিষদের নির্দেশনা না মেনে তারা এখন পদত্যাগ করছেন।
সূত্র মতে, গত বছরের ৫ জানুয়ারি এভাবেই হঠাৎ বড় পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে আসেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর ৪ মাসের মাথায় সরে দাড়ালেন আরাস্তু খান। শুধু চেয়ারম্যানের পদ থেকেই নয়; ব্যাংকটির পরিচালক পদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেন। আরাস্তু খান তিন বছরের জন্য পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু আরাস্তু খানই নয়; ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও একই সময়ে পদত্যাগ করেন। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে নতুন পরিচালক করা হয়েছে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক সেলিম উদ্দিনকে। তিনি সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিনের স্থলাভিষিক্ত হলেন। এছাড়াও ইসলামী ব্যাংকে আরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ব্যাংকের উর্ধ্বতন সূত্র থেকে। আগামী ২৫ এপ্রিল ব্যাংকটির বোর্ড সভা। তাই ব্যাংকের সবাই তাকিয়ে আছেন ওইদিন কি হয় এর দিকে।
এদিকে গতকাল ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংক চেয়ারম্যানের কক্ষটি সংস্কার করা হচ্ছে। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আজ না হলে আগামী রোববার অফিস শুরু করবেন নতুন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নাজমুল হাসান।
সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভায় চেয়ারম্যান আরাস্তু খান, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম পদত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে এই দুই পদে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের ৫ কর্মকর্তাও পদত্যাগ করেন। এরা হলেনÑ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. শামসুজ্জামান, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাবিবুর রহমান ভুঁইয়া এফসিএ, ডিএমডি আব্দুস সাদেক ভুঁইয়া, ডিএমডি মোহাম্মদ মোহন মিয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) আমিরুল ইসলাম। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এভাবে পদত্যাগে ব্যাংক পাড়ায় নানা গুঞ্জনের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিত্য পদত্যাগ ও অপসারণে ব্যাংকটির শীর্ষ ম্যানেজমেন্টে ১১ জন কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচজনই পদত্যাগ করেছেন। এখন আছেন ছয় কর্মকর্তা। পদত্যাগকারীরা সবাই ব্যক্তিগত কারণ দেখালেও এ নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের অভিমত। অনেকেই মনে করছেন পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে কর্মকর্তাদের। এমনকি বোর্ড চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। অনেকের মতে, কয়েকজন কর্মকর্তা বোর্ডের সঙ্গে ভিন্নমতের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদত্যাগী এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান বোর্ডের কথামতো চললে ভবিষ্যতে দুদক, জেল, জরিমানা অবধারিত। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এতে সাময়িক সমস্যা হলেও পেশার মর্যাদা রক্ষা হলো। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ আইন-আদালত ও দুদকের ঝামেলা থাকল না।
ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, গত বছর ব্যাংকের মালিকানায় আসা চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে বেশ তাল মিলিয়েই চলছিলেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কর্মতৎপর ছিলেন তিনি। এর আগে এস আলম গ্রæপ এসআইবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় তার ভূমিকা ছিল বেশ আলোচিত। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকটিকে নতুন উদ্যমে পরিচালনা করতে নানা ধরনের উদ্যোগও নিয়েছেন আরাস্তু খান।
তবে ওই সূত্র আরও জানায়, এস আলম গ্রæপের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আরাস্তু খানসহ একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার। আর এ কারনেই এক এক করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগ করতে হলো।
এভাবে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে চলে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না কেউই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাংকার জানান, গত বছর থেকেই ব্যাংকের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। আগের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সূচকে ভাল করলেও ব্যাংকের মধ্যে সবসময়ই কখন কি হয় এ নিয়ে আতঙ্ক ছিল। চেয়ারম্যানসহ উর্ধ্বতনদের পদত্যাগে এই আতঙ্ক আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে হঠাৎ করেই গত মঙ্গলবার বোর্ড সভায় আরাস্তু খান কেন পদত্যাগ করেছেন তা এখনও পরিষ্কার নয়। যদিও আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংক থেকে সরানো হচ্ছে, তা গত প্রায় এক মাস থেকেই পরিচালকদের মধ্যে আলোচনা চলছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলেন আরাস্তু খান। সেখান থেকে তাকে মলিন মুখে বের হতে দেখা গিয়েছিল।
আরাস্তু খানের পদত্যাগের বিষয়ে ব্যাংকটির পদত্যাগকারী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ বলেন, ‘আরাস্তু খান ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই গোঁজামিল দিয়ে চালাচ্ছিলেন। ব্যাংকের মুনাফায় ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছেন। ব্যাংক বাঁচাতে তাকে সরানোর প্রয়োজন ছিল। সঠিক সময়ে তাকে সরিয়ে দেওয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আগ্রাসী ঋণের কারণে গত কয়েকমাস থেকে ইসলামী ব্যাংক তারল্য সঙ্কটে বিপর্যয়ের মুখে। একই সঙ্গে শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত ৯০ শতাংশ অনুমোদিত বিধি লঙ্ঘন করে ব্যাংকের অগ্রিম আমানত অনুপাত ৯২ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ইসলামী ব্যাংক এমনকি সা¤প্রতিক মাসগুলিতে বড় আকারের ঋণ বিতরণে সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
এদিকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়া ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালক প্রফেসর ড. নাজমুল হাসান আরাস্তু খানের ন্যায় আরমাডা স্পিনিং মিলের পক্ষে নতুন করে পরিচালক হয়েছেন। চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্তির পূর্বে তিনি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারি মাসে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পরিবর্তন আসে। ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে পরিচালনা পরিষদের প্রথম সভাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয় আরাস্তু খানকে। ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হকও পদত্যাগ করেন একই সঙ্গে। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে নতুন এমডি হিসেবে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরপর ব্যাংকটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা পরিবর্তন আসে বছর জুড়ে। বিভিন্ন স্তরের বেশ কিছু কর্মকর্তা পদত্যাগ করে যেমন স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। আবার বেশ কিছু কর্মকর্তাকে অপসারণ করে নতুন পরিচালনা পরিষদ। গত বছরের মে মাসে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় পরিচালনা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলমকে সরিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মাবুদকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। অপরদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হামিদ মিঞা গত মাসের ১০ তারিখে অবসরে গেছেন। এরপর নিয়োগ দেওয়া হয় ব্যাংকটির সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব-উল আলমকে।
দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগে দেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৬৩ শতাংশের বেশি মালিকানা ছিল ইসলামী ব্যাংকের। তবে গত তিন বছরে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।



 

Show all comments
  • Habib Bipu ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:০২ পিএম says : 0
    বোর্ড সভার দিকে আর তাকাই লাভ নাই যা হবার তা হই গেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Syed Nazmus Sakib ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:১৬ পিএম says : 0
    কি ঘটতে যাচ্ছে আসলে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি নাহ
    Total Reply(0) Reply
  • তামান্না ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:২২ পিএম says : 0
    ব্যাংকটাকে মনে হয় শেষ করে ছাড়বে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ