Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামে মেহনতি পশুর অধিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ইসলাম শুধুমাত্র শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের কথা বলে শেষ করেনি বরং ইসলামী বিধান আল্লাহর সকল সৃষ্টজীবের উপর প্রযোজ্য। পশু মানুষের মতই জীবনের অধিকারী। তাদের খাদ্য প্রয়োজন, সুখ-শান্তি প্রয়োজন অর্থাৎ জীবন ধারনের জন্য সবই প্রয়োজন। কিন্তু তারা তাদের প্রয়োজনের জন্য কথা বলতে পারে না, বক্তৃতা ও মিছিল করতে পারে না। তাই তাদের প্রয়োজন ও চাহিদা বুদ্ধিমান মানুষকে বুঝতে হবে। পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্য জাতি আসেনি যারা মানুষের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করে জীবজন্তুর সুখ-শান্তিও নিশ্চিত করেছে। কোনো কোনো সমাজে পশুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু আইন থাকলেও তা পশুর শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। ইসলাম বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর বিধান তাই সৃষ্টির সকলের সুখ-শান্তির বিধান এর মধ্যে রয়েছে। পশুদেরকে মহান আল্লাহ মানুষের খেদমত ও কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানুষ পশু থেকে তার প্রয়োজনীয় সকল খেদমত গ্রহণ করবে যেমন বাহন হিসাবে ব্যবহার করা, মাল বহন করা, চাষাবাদ করা, যুদ্ধে ব্যবহার করা, দুধপান করা, গোশত খাওয়া, চামড়া ও হাড্ডি ব্যবহার করা ইত্যাদি। কিন্তু পশুদের প্রতি মানুষের অনেক দায়িত্ব আছে যা একটি মুহুর্তের জন্যও অবহেলা করার মতো নয়।
আল কুরআনের বহুস্থানে পশু সম্পর্কে এবং তাদের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। পশুকে আল্লাহ সৌন্দর্যের প্রতীক আখ্যায়িত করেছেন। ‘তিনিই চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে তোমাদের জন্য শীতের কম্বলও রয়েছে, আরও বহু উপকারিতা রয়েছে, এবং এগুলোর মধ্যে হতে তোমরা ভক্ষণও করে থাক। আর সেগুলোতে তোমাদের জন্য সৌন্দর্যও রয়েছে- যখন গোধূলীলগ্নে তাদেরকে চারণভূমি থেকে গৃহে আনয়ন কর আর যখন প্রভাতে তাদেরকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও। এরা তোমাদের বোঝা এমন দূরদেশে বহন করে নিয়ে যায় যেখানে তোমরা প্রাণান্ত ক্লেশ ছাড়া পৌছাতে পারতে না। বাস্তবিক তোমাদের রব অত্যন্ত কৃপাবান, দায়িত্বশীল। তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা, যেন তোমরা এর উপর আরোহন করতে পার এবং শোভারও জন্যও। তিনি এরূপ বহু বস্তু সৃষ্টি করেন যার সম্পর্কে তোমরা খবরও রাখ না।’ (সূরা নাহাল-৫-৮)। ‘এরা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি তাদের জন্য আমার বস্তুসমূহের মধ্যে নিজ হাতে চতুস্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি। অতঃপর এরা এ সকল পশুর মালিক হয়েছে। আমি যে সকল চতুষ্পদ জন্তুকে তাদের বশীভূত করে দিয়েছি এদের কতক তাদের বাহন, আর কতক তারা আহার করে। আর তাদের জন্য এগুলোতে আরও অনেক উপকার রয়েছে আর আছে পানীয় দ্রব্যাদি। তবুও কি তারা শোকর করবে না?’ (সূরা ইয়াসিন-৭১-৭৩)
আল কুরআনে পশু সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে দুটো বিধান নির্ধারিত হয়েছে, যেসব পশুর মালিক মানুষ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এর মালিক মহান আল্লাহ। তিনি এগুলো সৃষ্টি করে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। যদি আল্লাহ এগুলোকে মানুষের অধীন করে না দিতেন তাহলে মানুষের কি ক্ষমতা ছিল তার চেয়ে বড় ও শক্তিশালী পশুগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার? এটা শুধু মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর মেহেরবানি। যেভাবে আল্লাহ পশুগুলোকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন ঠিক তেমনিভাবে মানুষ অধীনস্ত পশুর সাথে সে রকম ব্যবহার করবে যেমন আমানতদার তার আমানত রক্ষা করে। রসূল স. বাহনের উপর সওয়াব হওয়ার সময় নিম্নের দোয়া পড়ার জন্য বলেছেন-“সুবহানাল্লাযী সাখ্খারা লানা হাযা ওমা কুন্নালাহু মুকরিনীন” পশু আল্লাহর সৃষ্ট জীব অতএব জীব হিসেবে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষের মত তাদেরও আছে অধিকার।
মহান আল্লাহ বলেন, ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোনো পাখী ওড়ে না কিন্তু এরা তোমাদের মত এক একটি উম্মত।’ (সূরা আনআম-৩৮)। একবার হযরত উবায়দুল্লাহ হযরত আবদুল্লাহ ইবন বশিরের খেদমতে এসে জিজ্ঞেস করলেন যে, এক ব্যক্তি ঘোড়ার পিঠে আরোহন করে ঘোড়াকে চাবুক মারে, এ সম্পর্কে রসূল স. এর কোন নির্দেশনা আছে কি? তিনি কোনো জবাব দিলেন না। পর্দার আড়াল থেকে একজন মহিলা জবাব দিলেন, মহান আল্লাহ নিজেই বলেছেন- মানুষ মানুষের সাথে যেমন ভালো আচরণ করে পশুর প্রতিও তেমনি ভালো আচরণ করবে। হুজুর স. বলেছেন- “যদি কুকুর উম্মতের মধ্যে একটি উম্মত না হত তাহলে আমি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিতাম। ইসলামে বিনা কারণে কুকুর পর্যন্ত হত্যা করা বৈধ নয়, কেন না ওরাও আল্লাহর সৃষ্ট। রসূল স. বলেছেন, এক ব্যক্তি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করাবার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি নবী করীম স. কে বললেন, হে আল্লাহর রসূল স. পশুর সাথে ভালো ব্যবহার করলে তার কোনো প্রতিদান ও সওয়াব আছে কি? নবীজী স. বললেন, প্রত্যেক জীবের সাথে ভালো ব্যবহার করার মধ্যে সওয়াব আছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মহামানব সমগ্র সৃষ্টির প্রতি দয়ালু নবী মুহাম্মদ স. পশুদের জন্য বিধিবিধান প্রণয়ন করে গেছেন যা পৃথিবীর সকল মানুষের নিকট সমানভাবে গ্রহণীয়। যা চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে।
পশুকে অপ্রয়োজনীয় ও অধিক পরিশ্রম না করানো ঃ পশুকে অপ্রয়োজনীয় এবং অস্বাভাবিক পরিশ্রমের কাজে নিয়োগ করতে আল্লাহর রসূল নিষেধ করেছেন। যে পশুকে যে কাজের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সে পশুকে সে কাজে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ উট সৃষ্টি করেছেন এ জন্য যে, তোমরা যেখানে সহজে পৌঁছতে না পার সেখানে সে তোমাদেরকে সহজভাবে পৌছে দেয়। অতএব বিনা প্রয়োজনে তাদের পিঠে বসে থেকো না। তাদের পিঠ পাথর নয় কাঠ নয় যে, যা ইচ্ছা তাই বোঝা চাপাবে। পশুকে কাজে ব্যবহার করার সময় তার প্রতি দয়ার দৃষ্টি রাখবে।
পশুর জন্য খাদ্য ও বিশ্রামের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ঃ পশুর বাক শক্তি নেই তাই তারা মালিকের নিকট তাদের প্রয়োজন, সমস্যা ও চাহিদার কথা বলতে পারে না। তাই অন্তর দিয়ে মালিককে তার অধীনস্থ পশুগুলোর সুবিধা অসুবিধাগুলো বুঝার চেষ্টা করতে হবে এবং আন্তরিকতার সাথে তা সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। তার খাদ্য মানসম্মত হতে হবে এবং মৌসুম অনুযায়ী তার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সে আরাম বোধ করে। অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। রসূল স. বলেছেন, তোমরা বাকহীন পশুর সাথে ব্যবহারের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। সুস্থ ও ভালো অবস্থায় তার পিঠে আরোহণ কর। (আবু দাউদ) তাকে কোন রকম কষ্ট দিলে, বেশি ও কঠোর পরিশ্রম করালে, খাদ্যের প্রতি যতœ না নিলে, মারধর করলে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। একজন আনসারী তার উটকে বেশি বেশি খাটাতো কিন্তু তার যতœ, খাদ্য ও আরাম আয়েশের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করত। রসূল স. তাকে ডেকে গুরুত্ব সহকারে বললেন, এ জন্তুর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাকে তুমি কি ভয় করো না? অথচ তিনি তার রহমত দ্বারা পশুগুলোকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন। তুমি এর থেকে কাজ বেশি নাও অথচ তাকে অভূক্ত রাখ। উল্লেখিত হাদীসের গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে ওলামায়ে কেরাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, পরিশ্রমের পরে নিজের খাবার ও বিশ্রামের পূর্বে পশুর খাবার ও আরামের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরী।
পশুর মুখে মারা ও দাগ দেয়া নিষেধ ঃ পশুকে প্রয়োজন মোতাবেক শাস্তি দেয়া যাবে। কিন্তু পশুর মুখের উপর আয়াত করা ও দাগ দিতে রসূল স. নিষেধ করেছেন। এরূপ ব্যক্তির প্রতি রসূল স. লানত করেছেন। দুই পশুর মধ্যে লড়াই করানো নিষেধ করা হয়েছে। ‘দুই পশুর মধ্যে লড়াই করাতে রসূল স. নিষেধ করেছেন।’ (আবু দাউদ) এতে পশুর কষ্ট হয় এবং অনেক সময় পরাজিত পশু মারা যায়।
পশুর প্রতি লানত বর্ষণ করা নিষেধ ঃ মানুষকে যেভাবে গালি দেয়া, লানত করা নিষেধ তেমনিভাবে পশুকে গালি দেয়াও লানত করা নিষেধ। একবার রসূল স. শুনতে পেলেন কে যেন একটি পশুকে লানত করছে। রসূল স. জিজ্ঞেস করলেন কে পশুকে লানত করেছে? লোকেরা বলল, একজন মহিলা তাকে বহনকারী পশুকে লানত করছে, নবীজী স. শুনে বললেন, বাহনের উপর থেকে হাওদা নামিয়ে দাও, সে তো নিজেই লানতের কাজ করেছে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইমামগণ ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালকদের জন্য পশুর ব্যাপারে কয়েকটি নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। হযরত আবু হানিফা র. বলেছেন, রাষ্ট্রের ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিবিধানের মধ্যে মালিককে পশুর খাদ্যের ব্যবস্থা করা, পশুর আরামের ব্যবস্থা গ্রহণ ও জুলুম না করার নির্দেশ জারী করাও জরুরী। ইমাম মালেক র. ইমাম শাফেয়ী র. ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল র. এর সম্মিলিত মত হচ্ছে- ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ র.এর অভিমত হলো, যদি কেউ পশুর সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ নেয় অথবা তার ওপর বোঝা চাপায় তাহলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিরত রাখবে। (ইসলামের খেটে খাওয়া মানুষের আইন)
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এর মধ্যে মানুষের দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং কবরের জীবন থেকে হাশরের জীবন তারপর জান্নাত ও জাহান্নাম আসমান ও জমিন, তার মধ্যে যা কিছু আছে সকল বিষয় ইসলামের নিকট সুস্পষ্ট রয়েছে। তাই পশুর বিষয়টিও বাকী রাখা হয় নি। পশুর অধিকার আদায় ও পশুর খাদ্যের ব্যবস্থা গ্রহণ, বাসস্থান ও আরাম আয়েশের বিষয়টি ইসলামি আইনে গুরুত্ব লাভ করেছে এবং রসূল স. পশুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে বলেছেন। পশুর অধিকার ও যতেœর ব্যাপারে যদি এত তাকিদ প্রদান করা হয়ে থাকে তাহলে অধীনস্থ শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকের বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষ অবহেলিত, ঘৃণিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িতও নির্যাতিত। শ্রমজীবী মানুষ যদি তাদের অধিকার লাভ করতে চায় তাহলে ইসলামী বিধানের কাছে তাদের ফিরে আসতে হবে। অন্যথায় মানব রচিত বিধান শ্রমজীবী মানুষের শোষণের হাতিয়ার। ইসলাম যদি পশুর জীবনের শান্তি নিশ্চিত করতে পারে তাহলে শ্রমজীবী মানুষের জীবনের সুখ শান্তি কি নিশ্চিত করতে পারবে না? যারা বলে ইসলাম শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে নি তারা আসলে ইসলামের দুশমন এবং শ্রমজীবী মানুষেরও দুশমন। তারা শ্রমজীবী মানুষকে বিভ্রান্ত করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছাতে চায়। যে ইসলাম পশুর অধিকার দেয় পরিপূর্ণভাবে যে ইসলামই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার একশত ভাগই নিশ্চিত করেছে এবং তারই মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ।



 

Show all comments
  • জাহিদ ১৯ এপ্রিল, ২০১৮, ২:৫৬ এএম says : 0
    লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামে


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ