Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাহাঙ্গীর সমর্থকদের আনন্দ মিছিল : আজমত শিবিরে হতাশা

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন

| প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মো. দেলোয়ার হোসেন, গাজীপুর থেকে : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায় আনন্দ মিছিল করেছে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সমর্থকরা। অপরদিকে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় চরম হতাশা বিরাজ করছে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক টঙ্গী পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান সমর্থকদের মধ্যে। বিশেষ করে গোটা টঙ্গী শিল্প শহরে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
এ অবস্থায় বহু প্রতীক্ষার পর অবশেষে গাসিকে নৌকার মাঝি নির্ধারণ হলেও থামছে না আওয়ামী লীগের কোন্দল। দলের মনোনয়ন পাওয়া অথবা না পাওয়াকে অস্থিত্বের লড়াই হিসেবেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাভাপতি সাবেক টঙ্গী পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। এখন জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেওয়ায় শুধু আজমত উল্লা খাঁনই নয়; বরং স্থানীয় আওয়ামী লীগের জ্যৈষ্ঠ নেতাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে বলেও মনে করছেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এমনিতেই এতো অল্প সময়ে কম বয়সী জাহাঙ্গীর আলমের উত্থানকে কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছিলেন না দলের সিনিয়র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, জাহাঙ্গীর সিনিয়র নেতাদের যেভাবে অবমূল্যায়ন করে চলেছেন তিনি মেয়র নির্বাচিত হলে আজমত উল্লা খান ও স্থানীয় দুই জন এমপিসহ দীর্ঘ দিনের অনেক ত্যাগী সিনিয়র নেতার ধারাবাহিক রাজনৈতিক পদ পদবির অপমৃত্যু ঘটবে বলে তাদের আশঙ্কা। এদিকে এসব আশঙ্কা আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যেও আনন্দ মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকরা। রোববার দলীয় মনোনয় পাওয়ার ঘোষণা আসার পর রাতেই জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকরা নগরির বিভিন্ন এলাকায় খন্ড খন্ড মিছিল বের করে। জাহাঙ্গীর আলম রাতে নিজেও মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে মহাসড়ক প্রদক্ষিণ করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরাসরি একাধিক নেতাকর্মীর সাথে আলাপকালে তারা আরো জানান, নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীরের এখনো অনেক সময় ছিল। আজমত উল্লা খানকে তার ছাড় দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি সেই সৌজন্যবোধ না দেখিয়ে শুধুমাত্র টাকার জোরে বহু আগে থেকেই সিনিয়র নেতাদের সাথে অসম রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। তার এই ক্ষমতালিপ্সু মনোভাব দলের ভেতর বিভাজন সৃষ্টি করে।
জাহাঙ্গীর আলমকে দলের মনোনয়ন দেওয়ায় এস.এম রকিব উদ্দিন রনি নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম, দুনিয়াকে করেছে টাকার গোলাম’। সাইফুল ইসলাম সিসির মুখের ওপর একশত টাকার নোট সাটিয়ে শিকল ও তালা এঁটে লিখেন, ‘সততা যখন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়; মুখের ভাষা তখন শেকলবন্ধী হয়’। এতে মেহেদী হাসান মন্তব্য করে বলেন, ‘প্রিয় নেত্রী, আমার ব্যর্থতা আমি সৎ, আমার কালো টাকার পাহাড় নাই। তাই আমি আজ কালো টাকার কাছে হেরে গেলাম’।
ইঞ্জিনিয়ার হাবীব খান নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমিও ভাবছি আজ থেকে টাকা কামাবো। নেতার আদর্শ বুকে নিয়ে সততা দেখিয়ে পকেট ফাঁকা নিয়ে কি লাভ, প্রয়োজনে গুÐা হবো’। পৃথক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় একটা গান শুনেছিলাম-টাকা ধর্ম, টাকা কর্ম, টাকা হি পরোয়া মন্দির’ আজ সব খানেই টাকা কথা বলে’।
হাজী বাবলু লিখেছেন, ‘কাউকে হারিয়ে দেয়াটা খুব সহজ, কিন্তু কঠিন হলো কারোর মন জয় করা’। পৃথক অপর স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মাঠে উল্টা খাইলে অনেক কিছু শেখা যায়’।
রফিকুল ইসলাম ফিরোজ সরদার আজমত উল্লা খানকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘নীতি আদর্শ ও আপনার দিক নির্দেশনায় থাকবো আজীবন। রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নাই, সবে খেলা শুরু’। নাহিদ হাসান ওসমান লিখেছেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মনোনয়ন বাছাইয়ে সততা ও জনপ্রিয়তাকে গলা টিপে হত্যা করলো টাকা’। এইচএম আজিজুর রহমান লিখেছেন, ‘তারাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ যারা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে রাজনীতি করে। ইমতিয়াজ শুভ লিখেছেন, ‘জীবন থেমে থাকবে না। কিন্তু টাকা ছাড়া রাজনীতিতে ভাত নাই। ৭ মাস পরে দেখবা ভুলের মাসুল হারে হারে টের পাবে’। রাশেদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘রাজনীতির কোন ধর্ম নাই, রাজনীতির একটাই ধর্ম টাকা’। অ্যাডভোকেট জি এম ইব্রাহীম লিখেছেন, ‘সততাই হচ্ছে ব্যর্থতা’। আলী আসগর খান মন্তব্য করেন, ‘রাজনীতির ধর্ম আছে। কিন্তু রাজনীতিকদের স্বকিয়তা হারিয়েছে’। এ রহিম মিয়া লিখেছেন, ‘এই টাই ডিজিটাল বাংলাদেশ, যোগ্য মানুষের মূল্যায়ন নাই’। এইচএম আজম লিখেছেন, ‘এরকম রাজনীতি না করাই ভালো’।
এমডি ফরহাদ লিখেছেন, ‘কেয়ামত এর বড় আলামতের মধ্যে একটা হলো অযোগ্য লোক নেতা হবে, আমার মনে হয়, সেই সময় এখন চলছে বাংলাদেশে’। সাদিম হায়দার লিখেছেন, ‘রাজনীতি আজ রাজনীতিবীদদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে.. প্রিয় নেত্রী’। আজাড ট্রান্সপোর্ট লিখেছে, ‘জনাব আজমত উল্লা খাঁন নৌকা, জনাব জাহাঙ্গীর আলমও নৌকা, আমরা যারা আজমত উল্লা খান এর সাপোর্ট করলাম, আমরা কি সবাই খারাপ হয়ে গেলাম।’ মিজানুর রহমান লিখেছেন, ‘আগে শুনেছিলাম ১ জন ছাড়া সবাই বিক্রি হয়। গতকাল দেখলাম টাকার কাছে সবাই অসহায়’। আরমান খান লিখেছেন, ‘সৎ পথে চলিলে নাকি সব কিছু পাওয়া যায় ? এটাই কি সেই পাওয়া ? যদি তাই হয় তাহলে সৎ হয়ে কোন লাভ নেই’। মনির হোসাইন রাজু লিখেছেন, ‘টাকার কাছে হেরে গেলেন আজমত উল্লাহ’। মিজানুর রহমান লিখেছেন, ‘একজন গ্রেটকে জিন্দালাশ হয়ে বেচে থাকতে হবে’। অ্যাডভোকেট জিএম ইব্রাহীম লিখেছেন, ‘আজমত উল্লাহ খান স্যার আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। এটাই আমার গর্ব’। রাজিব যায়যায়দিন লিখেছেন, ‘আওয়ামীলীগের রাজনীতি আজ রাজনীতি নাই’। কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘অনেক হয়েছে মেয়র প্রার্থী নিয়ে, এখন আসেন সকলে মিলে নৌকার জয় নিশ্চিত করি’।
এদিকে জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় নগরির বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গোটা টঙ্গী শহরের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। থমকে গেছে নির্বাচনী আমেজ। টঙ্গীতে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সর্বত্রই নীরব নিস্তব্দতা। চায়ের স্টল, টঙ দোকানসহ বিভিন্ন আড্ডাস্থলে শুধু আপসোস ও ধিক্কার। টঙ্গী ট্রাক টার্মিনালের এক শ্রমিক নেতা আক্ষেপ করে বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গাজীপুরবাসীর যে আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল সেটা আর নেই। বঙ্গবন্দুর আদর্শ এখন আর আওয়ামীলীগে নেই। এই দলই আর করমু না। আওয়ামী লীগের গোষ্ঠী মারি’।
এদিকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় নয়া দিগন্তকে বলেন, দলের সিদ্ধান্তে মানুষের মাঝে হতাশা আছে। এর পরও আমি যেহেতু সভাপতি সেহেতু দলকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড নিয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন গঠিত। এখানে মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০৪ জন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৩ সালের ৬ জুলাই। সে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এমএ মান্নান টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বদ্বী আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। এক লাখ ছয় হাজার ৫৭৭ ভোটের বিশাল ব্যবধানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হারতে হয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। সে সময় নির্বাচন কমিশনে তার প্রার্থিতা বাতিল হলে উচ্চ আদালতে রিট করে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেও ব্যালটে আনারস প্রতীকে মাত্র পাঁচ হাজার ভোট পান জাহাঙ্গীর। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান হারার পেছনে জাহাঙ্গীরের নিষ্ক্রিয়তা, স্থানীয় দলীয় এমপিদের নীরব ভূমিকা ছিল অন্যতম কারণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ