Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মসুলে নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা আজো নিরূপণ করা হয়নি

জোট বাহিনী ও ইরাকি সৈন্যদের নির্মমতা-2

দি আটলান্টিক | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২৪ জানুয়ারি ইরাকি কর্মকর্তারা পূর্ব মসুল দখলের কথা ঘোষণা করেন। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে ইরকি সৈন্যরা ঘন জনবসতি অধ্যুষিত পশ্চিম মসুলে অনুপ্রবেশের অনেক কঠিন কাজ শুরু করে। এ অংশ দখল করতে তাদের পাঁচ মাস লাগে। মসুলের পুরনো অংশে আইএসের সর্বশেষ পকেটগুলোতে চ‚ড়ান্ত লড়াইয়ের শেষ সপ্তাহগুলোতে সে সব স্থানের আটকাপড়া বেসামরিক মানুষগুলো বেরিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়।
মানবাধিকার তদন্তকারীরা বলেন, মসুলে ইরাকি বাহিনীর সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী যৌথ অভিযান চালায়। রকেট ব্যবহারে তাদের অনুমোদন দেয়ার ফলে মসুলে বহুসংখ্যক লোক নিহত হয় বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মাঠ গবেষক বেনজামিন ওয়ালসবাই জানান। জুলাইতে ওয়ালসবাই ও তার সহকর্মীরা মসুলে ধ্বংসকান্ড বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করেন। চিকিৎসাকর্মীসহ পশ্চিম মসুলের ১৫০ জনেরও বেশি অধিবাসীর সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে প্রণীত ঐ রিপোর্টে অ্যামনেস্টি আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে। তবে এটাও বলা হয় যে জোট বাহিনী বা ইরাকি সৈন্যরাও যুদ্ধাপরাধ করেছে। জুলাইতে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন জোট বাহিনী কমান্ডার লেঃ জেনাঃ স্টিফেন টাউনসেন্ড বলেন, আমি এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করছি যে জোট বাহিনী লক্ষ্যস্থল বহির্ভূত স্থানে , অন্যায় ভাবে ও অত্যধিক গোলাগুলি ব্যবহার করেছে। আমি এ সব অভিযোগের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা যে কারো বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে বলছি যে তাদের ঘটনাগুলো নিয়ে প্রথমে গবেষণা করা উচিত।
কয়েকমাস পর নিউইয়র্ক টাইসসের সাংবাদিক আজমত খান ও আনন্দ গোপাল ব্যাপক অনুসন্ধান চালানোর পর বলেন, উত্তর ইরাকের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় জোট বাহিনীর বিমান হামলায় সংঘটিত বেসামরিক লোকদের মৃত্যুর সংখ্যা জোটের বিমান থেকে গৃহীত ভিডিও ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে ৩১ গুণ বেশি। তারা বলেন. জোটের বিমান প্রায়ই ভুল লক্ষ্যে হামলা চালিয়েছে। ড্রোন ও ভিডিও ছবির সাহায্য নিয়েও তারা বেসামরিক লোকদের হত্যা করেছে যেখানে আইএসের কোনো উপস্থিলি ছিল না।
২০১৬-র ডিসেম্বরে গোপাল ও আনন্দ তাদের মাঠ গবেষণার মাঝামাঝি থাকাকালে ওবামা বিমান হামলার আহবান জানানোর ক্ষমতা কমান্ড চেইনের নি¤œ পর্যায়ে নামিয়ে আনেন। ফলে বিমন হামলারর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সদর দফতরের বাইরে ও মাঠ পর্যায়ে চলে যায় (ট্রাম্পের সময়ও এ সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে ও জোরদার হয়েছে। খান ও গোপাল এর ফলে তাদের জরিপকৃত এলাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন।
ইরাকি বাহিনীর সাথে থাকা সাংবাদিকরা মসুলে, বিশেষ করে পশ্চিম মসুলে জোট ও ইরাকি বাহিনী উভয় কর্তৃক বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন। তারা বলেন, বেসামরিক লোকেরা ছিল নিরুপায়, চারপাশে কি ঘটছিল সে ব্যাপারে তারা জানতে পারিছল না এবং অনেকেই জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল বেযমেন্টে। যারা বাড়িতে ও অনান্য ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল তারা শিকার হয়েছিল বোমা বর্ষণের।
ইরাকে কর্মরত একজন বিদেশী সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি শুনেছি কোনো কোনো বেযমেন্টে ৪০ থেকে ৫০ জন করে মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। আপনি সহজেই বুঝতে পারেন যে এক একটি গোটা পরিবার পিতা-মাতা,সন্তান ও নাতিসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আইএস বেসামরিক লোকদের চরম বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। তারা তাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা, বুবিট্র্যাপ ভবনে আটকে রাখা অথবা তাদের তাৎক্ষণিক ভাবে হত্যা করে। নভেম্বরের এক রিপোর্টে জাতিসংঘ বলে, আইএস মসুলের যুদ্ধে ৭৪১ জন বেসামরিক লোককে তাদের নিজস্ব রীতিতে হত্যা করে। আরো শত শত লোক নিহত হয় গোলাবর্ষণ ও গাড়ি বোমা হামলায়। জোট বাহিনীর হিসেবে ইরাকি সৈন্যরা মসুলে ১১শ’ গাড়ি বোমা হামলার সম্মুখীন হয়।
বাজফিডের সাংবাদিক মাইক গিগলিও একটি ঘটনার র্বনা করে বলেন, পশ্চিম মসুলে এক আইএস যোদ্ধা রাস্তার একটি টানেল থেকে বেরিয়ে এসে গুলি ছুঁড়ে আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। ইরাকি সৈন্যরা বিমান তলব করে। বোমাবর্ষণের পর টানেলটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার সাথে এক থেকে দু’টি বাড়িও ধ্বংস হয়। তিনি বলেন, এ রকম ঘটনা বহু ঘটেছে।
মসুল যুদ্ধে জোট বাহিনী মাত্র ৩৪২ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র মাত্র একটি ঘটনার কথা স্বীকার করেছে যেখানে বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ মসুলের আল জাদিদা এলাকার পশ্চিমাংশে বিমান হামলায় ১শ’রও বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, বেসামরিক লোক আশ্রয় নিয়েছিল এমন একটি ভবনের ছাদে ৫শ’পাউন্ডের দু’টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তার ফলে ভিতরে বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে।
মানবাধিকার কর্মীরা মসুলে যুদ্ধ চলাকালে তথ্য ঘাটতির কথা বলেন। মসুলের ওমর মোহাম্মদ ‘মসুল আই’ নামের একটি সামাজিক মাধ্যম চালান। আইএস শাসন ও মসুল যুদ্ধের সময় তিনি বহু দলিল সংগ্রহ করেন। ওমর জানান, মসুল লড়াইয়ের সময় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। প্রতিদিন আমি বিমান হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ২০-২৫ জন, কখনো ৪০ জন পর্যন্ত নিহত হওয়ার খবর পেয়েছি।
২০১৪ সাল থেকে শেষ পর্যন্ত ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ৮৪১ জন বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু ্ওয়ারওয়েজ-এর হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৬,২০০ বা তারও বেশি। খান ও গোপাল বলেন, নিহতের সংখ্যার হিসেবে এ বিরাট ফারাকের কারণ পদ্ধতিগত, বোমা বর্ষণের স্থান সম্পর্কে সামরিক বানিীর আগ্রহ, নিহতদের সংখ্যা বিষয়ে নয় এবং সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করাায় ব্যর্থতা।
মসুলবাসীরা আল জাদিদা হত্যাকান্ডের এক বছর পূর্তি স্মরণ করেছে। তবে এক বছর পার হলেও মার্কিন সরকার মসুল পুনর্দখলে নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যা নিরূপণে আগ্রহী নয়। আমেরিকানরা ক্ষতি না বুঝেই যুদ্ধ চালানো অব্যাহত রেখেছে, আর ইরাকি বেসামরিক মানুষ প্রাণ দিয়ে তার মূল্য দিচ্ছে। (সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ