পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ইতিহাস গড়েছেন মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদী। নরেন্দ্র মোদীর ভারতকে তো বটেই, গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন- ইসলাম শান্তির ধর্ম ও তিনি তারই বার্তাবাহক এবং ভারতের রিয়েল হিরো। শান্তির ধর্ম ইসলামের একজন আলেম মসজিদের ইমাম হিসেবে যা করা দরকার তিনি তাই করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকিয়ে দিয়েছেন। ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল জেলার রানীগঞ্জে। চতুর্দিকে উত্তেজনা। কফিনবন্দী লাশের সামনে এসে দাঁড়ালেন ইমদাদুল্লাহ রাশিদী। লাশটা তার ছোট ছেলে সিবতুল্লাহ রাশিদীর। আগের দিন নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে সিবতুল্লাহ রাশিদীর নামাজে জানাজায় দাঁড়িয়েছেন। ওদের সবার চোখে ক্রোধের আগুন। প্রতিশোধের আগুনে টকটকে লাল হয়ে থাকা চোখগুলোর আগুনের ফুলকি তার নজর এড়ায়নি। যে কোনো সময় সংঘর্ষ এবং রক্তপাত শুরু হবে। পুড়বে ঘরবাড়ি, হবে হত্যাযজ্ঞ। একজন আলেম হিসেবে এসব তিনি দেখতে চাননি; এমন শিক্ষাও তিনি পাননি।
পুত্রশোকে কাতর আসানসোলের নূরানী মসজিদের ইমাম মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদী নামাজে জানাজা পড়ানোর জন্য সামনের সারিতে দাঁড়ালেন। অতপর যে ঘোষণা দিলেন, তা ইতিহাস। শোনালেন ইসলামের শ্বাসত বাণী, মানবতার ধর্ম। সন্তানের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে সবার প্রতি অনুরোধ করলেন, এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার। প্রতিশোধের আগুনে যাদের চোখ তখনো জ্বলছিল, সেই উত্তেজিত জনতা পুত্রহারা পিতার কথায় নিবৃত্ত হলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শঙ্কা থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচল পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং ভারতের মোদী প্রশাসন। অথচ তখনো ওই আসন (আসানসোল) থেকে নির্বাচিত এমপি এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রী কণ্ঠশিল্পী বাবুল সুপ্রিয় ফেসবুক ও টুইটারে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য প্রচার করে মুসলিম সম্প্রদায়কে উসকে দিচ্ছিলেন। ভারতের মিডিয়াগুলো বাবুল সুপ্রিয়’র কঠোর সমালোচনা করে তাকে ধিক্কার দিয়ে রিপোর্ট প্রচার করলেও বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোয় সেটা চোখে পড়েনি।
হিন্দুত্ববাদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আসানসোলের নাগরিক মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদী। আরএসএসের ভাবশিষ্য বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশটিকে ‘শুধুমাত্র হিন্দুদের দেশ’ করার নীল নকশা আঁকা হয়। সেই নকশার অংশ হিসেবে মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে জুলুম নির্যাতন শুরু হয়। বাধে রাজ্যে রাজ্যে সাম্প্রদায়িত দাঙ্গা; প্রাণ হারায় অনেকেই। কখনো গরুর গোশত খাওয়া ইস্যুতে, কখনো নানা রকম ছলছুতোয় মানুষ খুনের ঘটনা ঘটে। সংখ্যালঘুরা চরম দুর্দশায় থাকা দেশটির পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল জেলার রানীগঞ্জে গত সপ্তাহে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আসানসোল পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে; রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে আরএসএসের কিছু উগ্র সদস্য। ভরদুপুরে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মাওলানা রাশিদীর ছোট ছেলে সিবতুল্লাহ রাশিদীকে। তরুণ সিবতুল্লাহ কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মুসলিম হওয়ায় তাকে হত্যা করে উল্লাস করে হিন্দুত্ববাদী কিছু মানুষ। ছেলের জন্য উদ্বিগ্ন মাওলানা রাশিদী খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আসানসোলের এক হাসপাতালের মর্গে ছেলের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। হত্যার পর বুক চিরে ফেলা হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন। মেরে ফেলার আগে উপড়ে ফেলা হয় হাতের নখ। রক্তাক্ত শরীর আগুনে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ায় উত্তপ্ত হয়ে উঠে আসানসোল শহর। হত্যার বদলা নেয়ার প্রস্তুতি চলে। বিজেপির প্রতিমন্ত্রীর মুসলিমবিদ্বেষী উসকানি সে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। কিন্তু ইসলামের রিয়েল হিরোর মতোই মাওলানা রাশিদী সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ করলেন। প্রথমে তিনি ছেলের লাশ শনাক্ত করে হাসপাতালের মর্গ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন; তারপর হাতে মাইক নিয়ে ছুটে যান রাস্তায়। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। করজোড়ে নিবেদন করেন; কেউ যাতে সহিংসতায় লিপ্ত না হন। পুত্রশোকে কাতর আলেম সমাজ নামাজে জানাজায় ১০ হাজার মানুষের সামনে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতোই একটানা উর্দুতে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেন। মাওলানা রাশিদী পরিষ্কার উর্দুতে বললেন, ‘আল্লাহ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছিলেন, ততদিন সে বেঁচেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যারা হত্যা করেছে, আল্লাহ তাদের কেয়ামতের ময়দানে শাস্তি দেবেন। আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) আপনাদের কারো নেই। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য একটি মানুষের (হিন্দু ধর্মাবলম্বী) ওপরও আক্রমণ করা চলবে না। একটি মানুষকেও হত্যা করা যাবে না। বাড়িঘর, দোকানপাট কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা চলবে না।’ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আবার বলতে শুরু করেন। বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম আমাদের নিরীহ কোনো মানুষকে হত্যা করতে শেখায়নি। ইসলাম আমাদের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে পাশাপাশি বসবাস করতে শেখায়। আমাদের আসানসোলে আজ শান্তি-শৃঙ্খলার প্রয়োজন। গত ৩০ বছর ধরে আমি এখানে আছি আপনাদের একজন হয়ে। আপনারা যদি আমাকে আপন মনে করেন, আপনাদের ভাই ভাবেন, তাহলে ইসলামে যে শান্তির কথা বলা হয়েছে; সেটা ধরে রাখবেন। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদের। যদি আপনারা শান্তি বজায় রাখতে না পারেন, তা হলে ভাববো- আমি আপনাদের আপন নই। আমি আসানসোল ছেড়ে চিরতরে চলে যাব।’
এই পৃথিবীতে একজন বাবার কাছে সবচেয়ে কঠিন নিজ সন্তানের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। আর সেটা যদি কোনো সন্ত্রাসীর হাতে খুন হয় তবে আরো কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়। একদিকে পুত্রশোক, অন্যদিকে শত্রুকে দেখে নেয়ার মানসিকতা-এক জটিল রসায়ন মননে কাজ করে। সেই কঠিন সময়ে যদি ‘ক্ষমার আদর্শ’ নিয়ে কেউ মৃত পুত্রের দাফন সম্পন্ন করেন; তবে তিনি হলেন মহান পুরুষ। মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদীর সময়োপযোগী সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে ভারতকে বাঁচালেন। অথচ তার নায়োকোচিত ভ‚মিকা নিয়ে মিডিয়াগুলোর তেমন উচ্চবাচ্য নেই! রাশিদী আলেম বা মসজিদের ইমাম না হয়ে যদি অন্য কোনো পেশার মানুষ হতেন আর এমন ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করতেন, তাহলে কি আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো নীরব থাকত? ধন্য ধন্য বলে হৈচৈ ফেলে দিত না? আলেম সমাজের খুঁত ধরতে ব্যস্ত বুদ্ধিজীবী মহলও মাওলানা রাশিদীকে নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছে বলে দেখা যাচ্ছে না। এরা কি পশ্চিমাদের হাতের পুতুল না দিল্লির দাস? ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা দুনিয়া যখন মুসলমাদের বিষোদ্গার করেন; তখন সেটা প্রচারে মিডিয়াগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি কোনো ঐতিহাসিক কাজ করেন তখন তাদের নিয়ে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। অথচ একজন আলেম মসজিদের ইমাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে ভারতকে রক্ষা করল; তাকে নিয়ে কারো মাতামাতি নেই। নিজের পুত্রের লাশের সামনে এমন ঐতিহাসিক ভ‚মিকা রাখতে পারেন এমন মানুষ আমাদের সমাজে কতজন আছে? তবে সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাওলানা রাশিদীকে ভারতের রিয়েল হিরো, মহা-নায়কের মর্যাদাই দিয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।