চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
\ শেষ \
যে জন্মেছে সে মৃত্যুবরণ করবেই। যার সূচনা হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটবেই। এটা আল্লাহপাকের শাশ্বত বিধান। এ অমোঘ বিধানের কোন পরিবর্তন নেই। পৃথিবীর বুকে অবধারিত সত্য হলো মৃত্যু। প্রত্যেক প্রাণীকে মরতে হবে। ছারপোঁকা থেকে শুরু করে প্রাণওয়ালা যত সৃষ্টিজীব আছে সবাইকে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জগতের কোন তাবৎ পরাশক্তি, কোন প্রযুক্তি কাউকে বাঁচাতে পারবে না। এখানে সবাই পরাজিত। জগতের কোন দাপট ও প্রতাপশালী মোড়ল মৃত্যুর নির্ধারিত সময় থেকে এক সেকেন্ড কমবেশি করার ক্ষমতা রাখে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, “প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে”- সূরা আলে ইমরানঃ ১৮৫।
মৃত্যু এমন এক বিষয় যার হাত থেকে পলায়ন করার সাধ্য কারো নেই। এ কথা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহতায়ালা যার মৃত্যু যেখানে নির্ধারিত করে রেখেছেন, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হবে। মৃত্যু যে নির্ধারিত সময় ও স্থানে সুনিশ্চিত তা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের যুগে তাঁর নিজের এক মন্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম নিজের এক মন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় খুব সুন্দর চেহারা ও দামি পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি সুলাইমান আলাইহিস সালামের মজলিশে প্রবেশ করল এবং কিছুক্ষণ বসার পর চলে গেল। তাঁর যাওয়ার পর মন্ত্রী হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর নবী! এ মাত্র আপনার নিকট যে লোকটি এসেছিলে, সে কে? হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম বললেন, সে ‘মালাকুল মাউত’ অর্থাৎ মৃত্যু ফেরেশতা। মালাকুল মাউত এর নাম শুনে মন্ত্রীর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং শরীর কাঁপতে থাকে আর বলতে থাকে, হযরত অনুগ্রহ করে বাতাসকে হুকুম দেন, বাতাস যেন আমাকে হিন্দুস্তানে (সেখান থেকে অনেক দূর) পৌঁছে দেয়। কারণ আমার জন্য অসম্ভব যে, আমি ঐ জায়গায় বসি যেখানে মৃত্যুর ফেরেশতা বসেছে। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম মন্ত্রীর আবেদন মঞ্জুর করে বাতাসকে নির্দেশ দেন, মন্ত্রীকে হিন্দুস্থান পৌঁছে দেয়ার জন্য। সাথে সাথে বাতাস নির্দেশ মোতাবেক তাই করল। একটু পরে পুনরায় মৃত্যুর ফেরেশতা সুলাইমান আলাইহিস সালামের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল হে আল্লাহর নবী আপনার মন্ত্রী কোথায়? হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম জানালেন, আপনার ভয়ের কারণে বাতাস তাঁকে হিন্দুস্থানে পৌছে দিয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা বলল, কিছুক্ষণ পূর্বে আমি যখন আপনার মজলিসে এসেছিলাম, তখন ঐ মন্ত্রীকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম! কেননা আল্লাহ তায়ালা আমাকে আদেশ দিয়েছেন যে, হিন্দুস্তান থেকে তার রূহ কবজ করার জন্য। আমি এসে দেখলাম সেই ব্যক্তি হাজার মাইল দূরে আপনার নিকট বসে আছে? সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কী অপার মহিমা! মৃত্যুর সময় এবং স্থান পরিবর্তন হয় না। মৃত্যুর ফেরেশতা আরো বলেন, আমি নির্দিষ্ট সময়ে হিন্দুস্তান পৌঁছি তখন আপনার মন্ত্রী হিন্দুস্তানে উপস্থিত! তার রূহ কবজ করে পুনরায় আপনার নিকট ফিরে আসলাম।
এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট মৃত্যু অবধারিত সত্য। আমরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছি। মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছি। আমরা সবাই মৃত্যুযাত্রী। এক ফারসী কবি বলেনঃ “দু’টি জিনিস মানুষকে সর্বদা টানে/ এক. রিযক দুই. কবর পানে। সবাইকে মৃত্যুর উন্মুক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। আমাদের মম চিত্তকে পরিশুদ্ধ করা প্রয়োজন। পরকালে সুখ-শান্তিতে থাকার উপকরণ সংগ্রহ করা আবশ্যক। মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা দরকার। প্রত্যেকটা কাজের প্রারম্ভে করোটিতে মৃত্যু নামক বাস্তব চিত্র আঁকা জরুরী। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেন, দুনিয়ার স্বাদকে বিলুপ্তকারী মৃত্যুকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ করো- তিরমিজিঃ ২৩০৭। নশ্বর পৃথিবীর শাশ্বত চিরন্তন সত্য হলো মৃত্যু। মৃত্যুর চেয়ে অপরিবর্তনীয় শব্দ জগতের অভিধানে খুব কম। রসায়নে বলা হয়, “বস্তু নিঃশেষ হয় না, রূপ পালটায়”। কীভাবে মানুষের রূপান্তর ঘটে তা একটু ভেবে দেখলেই পরিস্কার বুঝা যায়। আমাদের প্রথম ঠিকানা যথাক্রমে “আ’লমে আরওয়াহ” তথা রূহ জগত। সেখান থেকে মায়ের পেট। মায়ের পেট থেকে দুনিয়ার পিঠ। দুনিয়ার পিঠ থেকে দুনিয়ার পেট। দুনিয়ার পেট থেকে কিয়ামতের মাঠ। কিয়ামতের মাঠ থেকে সর্বশেষ ঠিকানা জান্নাত বা জাহান্নাম। এভাবে মানুষের স্থান পরিবর্তন হতে থাকে। অতএব, মানুষ মরে গেলেই শেষ হয় না বরং স্থানান্তর হয় মাত্র। নতুন করে বরজখ জীবন শুরু হয়। মানুষ মরণশীল। তবে মরণই সবকিছু শেষ নয়। রূহ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,“রূহ হল তোমার প্রভুর আদেশমাত্র। এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেয়া হয়েছে-সূরা আল-ইসরাঃ ৮৫। আল্লাহর আদেশে রূহ প্রদান করা হয়েছে আবার আল্লাহর আদেশেই রূহ প্রত্যাহার হবে। আল্লামা ইকবাল বলেন, “মৃত্যু অবিনশ্বর জীবনপথের ফজরবেলা”। শেষ বিচারের পর জান্নাত ও জাহান্নামই হচ্ছে শেষ পরিণতি, চুড়ান্ত জীবন ও স্থায়ী ঠিকানা! এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, এই পার্থিব জীবন ছলনাময়, প্রতারণার সামগ্রীমাত্র। পরকালের জীবনই আসল জীবন, প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত!-সূরা আল আনকাবুত : ৬৪।
বিদেশে গিয়ে নিজ দেশ, মাতৃভূমি ও জন্মভূমির কথা ভুলে যাওয়া কখনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। অনুরূপভাবে ক্ষণস্থায়ী সুখ-শান্তির পিছনে পড়ে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির কথা ভুলে যাওয়া কখনো সচেতনতার পরিচয় বহন করে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে গাফেল না করে, আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসিন না করে। আর যারা উদাসিন হয়, আল্লাহকে ভুলে যায় তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। আর আমি তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর মৃত্যু আসার আগে। অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু সময়ের জন্য অবকাশ দিলে, আমি সাদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অর্ন্তভূক্ত হতাম। কিন্তু নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহপাক কাউকে অবকাশ দিবেন না - সূরা মুনাফিকুনঃ ৯-১১।
সফলতা ও ব্যর্থতা এ দু’টি শব্দ এখন সর্বত্রই খুব বেশি প্রচলিত। সচেতন মানুষ এ দুটি শব্দ নিয়ে খুব বেশি গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে। চুড়ান্ত সফলতার একটি সূত্র ও মাপকাটি আল্লাহপাক মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বর্ণনা করেছেন। আসুন, আমরা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত সূত্রের কষ্টিপাথরে যাচাই করি, আমাদের জীবন কী সফল! নাকি ব্যর্থ! পবিত্র সংবিধান, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, সব সমস্যার সমাধানঃ “প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর কিয়ামতের দিন, তোমাদের কর্মফল তথা প্রতিদান দেয়া হবে। তখন যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সেই প্রকৃত সফলকাম”-৩ঃ১৮৫।
পরিশেষে সবাইকে ইহজগত ছেড়ে পরপারে যেতে হবে এটিই চুড়ান্ত, খাটিঁ ও বাস্তবতা। আল-কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, “প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপস্থিত হও”- সূরা আত্-তাকাছুর। রাসূল (সাঃ) বলেন, “আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন”-বুখারীঃ ২৮৩৪। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের পূর্ব প্রস্তুতি থাকা একান্ত জরুরী। সুতরাং ধরার সব পাঠ চুকিয়ে, ইসলামী জীবন ধারণ করে, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গণনা করাই হচ্ছে সচেতন, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানের কাজ। হাদিসে মরণের পরের জীবনের প্রস্তুতিকে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে মৃত্যুর পূর্বে খাঁটি তাওবা করে ইসলামী জীবনবিধান পালনের মাধ্যমে সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন, ইয়া রব্বাল আলামিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।