Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়াবহ ভূমিধসের শঙ্কা বাড়ছে আর্সেনিক বিষক্রিয়া এবং লবণাক্ততা

উদ্বেগজনক হারে কমছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

| প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম


মিজানুর রহমান তোতা : ভরা শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুর প্রায় পানিশূন্য। ভূপৃষ্টের পানি সংকট প্রকট। একই সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও উদ্বেগজনকহারে কমছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সামান্য ভূমিকম্পে মারাত্মক ভূমি ধসের শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া বাড়ছে আর্সেনিক বিষক্রিয়া এবং লবণাক্ততা। এসব ঝুঁকি কমাতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের একটা নীতিমালা এবং তার সুষ্ঠু প্রয়োগ জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সারাদেশের প্রায় সবখানেই কমবেশী পানির স্তর দ্রæত নিচে নেমে যাচ্ছে বলে বিএডিসি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রে জানা গেছে। সুত্র মতে, ভুমি থেকে ৫মিটার নীচে ভুগর্ভস্থ পানির স্বাভাবিক স্তর। বর্তমানে দেশের বিভিন্নস্থানে পানির স্তর ৮ থেকে ১১মিটার পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে। যার কারনে অনেক টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পানির জন্য পড়েছে হাহাকার। জনদুর্ভোগ ও দুর্দশা ক্রমেই বাড়ছে। বিএডিসির ভুগর্ভস্থ পানি জরিপ ও পরিবীক্ষণ বিভাগ থেকে জানা গেছে, ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, দিনাজপুর ও রাজশাহী এলাকায় পানির স্তর প্রায় ১১ মিটার নেমে গেছে মধ্য মার্চ থেকে। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানির স্তর নেমে গেছে ৮ থেকে ৮দশমিক ৬মিটার। এপ্রিলে আরো কমে যাবার আশংকা রয়েছে। এভাবে কমতে থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েে পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড,অধ্যাপক সাইবুর রহমান মোল্যা গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেলে নীচে ‘ক্যাবিটি’ বা গর্তের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে ভুমি ধসের আশংকা থাকে প্রবল। তাছাড়া ভুমিকম্প হলে মাটি দেবে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের একটা নিয়ম নীতি থাকা জরুরি। তার মতে, মাটিরতলার পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে সবাইকে যতœবান হওয়া দরকার। তা না হলে নীরবে দেশের মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের চরম সীমায় পৌছাবে। যা কোনভাবেই পুরণ করা সম্ভব হবে না।
কৃষি ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবেভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ব্যাপারে একটা নীতিমালা করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেলে আর্সেনিক বিষক্রিয়া ও লবনাক্ততা অনুপ্রবেশের আশংকা প্রবল হয়। ভুমি ধসেরও ঝুঁকি থাকে। সুত্রমতে, ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন খুবই জরুরি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বর্তমানে এককেজি ধান উৎপাদনে সাড়ে ৩ হাজার লিটার। অন্যান্য দেশের এর পানি ব্যয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৫শ’ থেকে ৭শ’ লিটার। আমাদের দেশে এটি খুব সহজেই দেড় হাজার লিটারে নামিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে দরকার বারিড পাইপের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেয়া। তাহলে উত্তোলিত পানি মোটেও অপচয় হবে না। সুত্র জানায়, দেশে প্রায় ৮৫ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির সিংগভাগই শুষ্ক মৌসুমে সেচনির্ভর চাষাবাদ হয়ে থাকে। সারাদেশে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য প্রায় ১৭ লাখ গভীর, অভীর ও পাওয়ার পাম্প ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন হয়। এছাড়া ঘর-গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দেশে প্রায় ৬০ লাখ টিউবওয়েল ও পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন হয়ে থাকে। সুত্র জানায়, কৃষি সেচ ও ঘর-গৃহস্থালিসহ সকল ক্ষেত্রেই পানির যে ব্যবহার বর্তমানে হচ্ছে তার প্রায় ৯০ ভাগই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। ভুপৃষ্টের সংকট পুরণ করতে হচ্ছে ভুগর্ভস্থ পানিতে।
বিএডিসি (সেচ) সুত্র জানায়, প্রতিটি ডিপ টিউবওয়েলে প্রতি সেকেন্ডে ২ কিউসেক ও শ্যালো টিউবওয়েলে শূন্য দশমিক ৫ কিউসেক পানি উত্তোলন হয়। যার প্রায় ৪০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে নানা কারণে। দেশে প্রায় ১৪ হাজার মাইল দৈর্ঘ্য ২শ’৬০টি ছোট-বড় নদী রয়েছে। বড় খাল রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। কয়েক বছর আগেও নদ-নদী ও খাল-বিল থেকে দোনা ও সেউতি পদ্ধতিতে একটা অংশের আবাদী জমিতে সেচের পানি ব্যবহারের সুযোগ পেত কৃষকরা। এখন সেই সুযোগ নেই। জানা যায়, ১৯৮৫ সালের দিকে সরকারী একটা নিয়মনীতি ছিল যে একটি ডিপ টিউবওয়েল থেকে আরেকটি ডিপ টিউবওয়েলের দুরত্ব কমপক্ষে ২ হাজার ৫শ’ ফুট এবং ডিপ টিউবওয়েল থেকে ১ হাজার ৭শ’ ফুট দুরত্বে শ্যালো টিউবওয়েল স্থাপন করতে হবে। একইভাবে একটি শ্যালো থেকে আরেক শ্যালোর দুরত্ব থাকতে হবে কমপক্ষে ৮শ’ ফুট। বর্তমানে যে যার মতো পানি উত্তোলন করছে।
সুত্রমতে, ভারী বর্ষণ হলে অবশ্য আবার রিচার্জ হয়ে যাবে। মার্চ ও এপ্রিলে পানির কষ্ট মারাত্মক হয়। আবহাওয়া দপ্তর সুত্র জানায়, সহসা ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা নেই। বিএডিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নামপ্রকাশ করতে নিষেধ করে গতকাল জানান, আমরা দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। এবারের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই অধিকাংশ এলাকায় ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ৫ থেকে থেকে ৮ মিটার নীচে নেমে যায়। যা অতীতে শুষ্ক মৌসুমের প্রথমদিকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। আসলেই ভুপৃষ্টের মতোই ভুগর্ভস্থ পানি সংকট দিনে দিনে মারাত্মক হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানায়, এগ্রিকালচার ইনফরমেশন সার্ভিস (এআইএস) থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত সংগ্রহ করা হয় বেশ আগে। তারই আলোকে নীতিমালা হয়েছে। একজন পানি বিশেষজ্ঞ জানান, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কৃষি সেচের জন্য পানি উত্তোলন করতে হলে নিয়মনীতি মানতে হয়। পরিকল্পিতভাবে পাকা ড্রেন তৈরী, পানি শুধুমাত্র যাতে জমিতে যায়, কোনভাবেই অপচয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। আমাদের দেশে এর উল্টোটা। বেশীরভাগই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার হয় না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিষক্রিয়া


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ